০৬:৫৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নারী দিবস ও নারীর করণীয় কর্তব্য 

  • ঝর্না বড়ুয়া
  • আপডেট সময় ০৭:২৫:০৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৮ মার্চ ২০২৩
  • ১০৯২ বার পড়া হয়েছে

আজ ৮ই মার্চ বিশ্ব নারী দিবস। প্রায় দেড়শত বছরেরও অধিককালের ইতিহাস ও সংগ্রামের নাম বিশ্ব নারী দিবস।

নারী শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রাম এই দিনটিকে গিয়ে। ১৮৫৭সালে মজুরি বৈষম্য, কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে নিউইয়র্কের রাস্তার নেমে এসেছিল সুতা কারখানার সংগ্রামী নারী শ্রমিকেরা আর সেই প্রতিবাদী মিছিলে চরম অমানবিক নির্যাতন চালায় শাসক বাহিনী। তারপরও সচেতন নারী সমাজ থেমে থাকেননি।

অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে অবিচল সংগ্রামী নারী সমাজ তারই ধারাবাহিকতায় ১৯০৯ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্ক সোশ্যাল ডেমোক্রেট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তিনি ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ ও পেশায় স্থপতি।পরবর্তীতে ১৯১০সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন।১৭টি দেশ থেকে প্রায় ১০০ জন সচেতন ও মেধাবী নারী নেত্রীরা এই সম্মেলনে যোগদান করেন। এই দ্বিতীয় নারী সম্মেলন থেকে সুযোগ্য নারী নেত্রী ক্লারা সর্বপ্রথম দাবী জানান ৮ই মার্চকে বিশ্ব নারী দিবস হিসাবে পালন করার। সর্বসম্মতিতে সিদ্ধান্ত হয় ১৯১১ সাল থেকে ৮ই মার্চ নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসাবে পালিত হবে।
এভাবে বেশ কয়েকটি দেশ প্রতিবছর দিনটি প্রতিপালনে এগিয়ে এসেছেন। সর্বশেষে জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালের ৮ই মার্চকে “আন্তর্জাতিক নারী দিবস” হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। সেই খেকে বিশ্বের প্রতিটি দেশে এই দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদার প্রতিপালিত হয়ে থাকে।

বিশ্বের অনেক দেশে দিনটিকে সরকারী ছুটির দিন ঘোষনা করেদিনটিকে আরো অর্থবহ ও নারীর প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করেছেন। অদূরভবিষ্যৎ আমাদের দেশেও নারীদের কন্ঠে জোরালো দাবী উঠলে একসময় সরকারী ছুটির দিন অনুমোদন লাভ করবে। প্রতিবছর জাতিসংঘ কর্তৃক একটা প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়। গতবছর ২০২২সালে ছিল, ” যত্নসই আগামীকালের জন্য আজ লিঙ্গ সমতা”।

সংসার সুখের হয় নারীর গুণে। নারী সর্বদা মমতাময়ী কখনো গর্ভধারিণী মাতা, কখনো স্নেহময়ী বোন, কখনো ভালোবাসাময় প্রেমিকা, কখনো প্রিয়তমা স্ত্রী সব পরিচয়ে নারী কোমলপরম মায়াময় হৃদয়ের অধিকারী। অপরিসীম ধৈর্য, সহমর্মিতা, পরিশ্রম, শক্তি ও সাহসের অনন্য প্রতীক নারী।

সভ্যতার শুরুতে নারীর হাত ধরে প্রথম মানুষ দলবদ্ধভাবে বাস করতে শুরু করে।আদিম যুগে ঘর্ষণে ঘর্ষণে আগুন আবিষ্কারের পর পুরুষেরা খাদ্য সংগ্রহের জন্য পশু শিকারে বনে যাওয়া শুরু করলে নারীরা বসবাসের আশেপাশে বীজ বপনের মধ্য দিয়ে কৃষির সূচনা করেছিলেন। সেই নারীর হাত ধরে কৃষিকাজের সূচনা হলেও কালের পরিক্রমায় আজও “নারীর সম্পত্তির আইন” প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার এখনো নারীরা কৃষকের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত। কারণ নারীর কোন কৃষি জমি নেই , জমির মালিক নই বলে নারী কৃষকের মর্যাদা থেকেও বাদ পড়েছে।যদিও এখনো পুরো কৃষিকাজকে ২১ ভাগে ভাগ করা হলে ১৭ টা কাজ করে নারীরা। কিন্তু আরোপরিতাপের বিষয় বীজ সংরক্ষণ, জমি তৈরী করা, ফসল তোলা ও ফসল সংরক্ষণ প্রভৃতি কাজে নিষ্ঠার সাথে শ্রম দিয়েও সেই কষ্টের সুফল ও আনন্দের ভাগীদার হতে পারে না নারী ফসল বিক্রিতে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ও দামদর জানার কোন অধিকার এখনো নারীর নেই। আবার বিশ্বঅর্থনীতিতে নারীর এ শ্রম বার্ষিক আয়ে যোগ হয় না তাতে ১১ ট্রিলিয়ন ডলার প্রতিবছর হারিয়েযায় বিনা স্বীকৃতিতে এই হলো নারীর জীবন।তারপরও নারী থেমে থাকেনি।

শত বাধা বিপত্তি পার হয়ে নারী সগৌরবে আপন মহিমায় এগিয়ে চলেছে অপরিসীম প্রাণশক্তি দিয়ে এভারেস্টের চূড়া থেকে মহাশূন্যে আর সীমান্ত প্রহরী থেকে রাষ্ট পরিচালনায়।

তাই সেই সাম্যবাদী বিপ্লবী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন “নারী” কবিতায়,
“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার; নর।”

শিক্ষা হচ্ছে সকলের মৌলিক অধিকার। আর শিক্ষা মানুষের ইতিবাচক পরিবর্তন করে।একমাত্র প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ স্বাধীন ও মুক্তভাবে চিন্তা করার জ্ঞান লাভ করে।আপাতত দৃষ্টিতে নারী শিক্ষার অগ্রগতি মনে হলেও উচ্চশিক্ষায় ক্রমান্বয়ে কমে কমে পেশাগত কর্মক্ষেত্রে এর হার খুবই নগণ্য। কিন্তু কথায় আছে, যে জাতি যত উন্নত সে জাতি তত শিক্ষিত। আমাদের দেশে নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারী শিক্ষার উন্নয়নে আমৃত্যু লড়াই করেছেন। নারী শিক্ষা সুপ্রতিষ্ঠিত করা, নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর অধিকারপ্রতিষ্ঠা করা ও নারী শিক্ষার প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তাঁর আজীবনের স্বপ্ন। তাই প্রত্যেক অভিভাবক বিশেষ করে মাতৃজাতির প্রথম ও প্রধান কাজ নারী শিক্ষার হার বাড়ানো এবং অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করা।

উচ্চশিক্ষায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে অর্থনৈতিক মুক্তি সাধনে, স্বাধীনমত প্রকাশ করার ক্ষমতা, গ্রহণযোগ্যতা ও পরিবার তথা সমাজে কল্যানকর কাজে অংশগ্রহণ ও সিদ্ধান্ত প্রদান করার মেধা ও যোগ্যতা অর্জন করতে পারলে নারীর নিজস্ব স্বকীয়তা ও মর্যাদাবহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। পরিবার গঠনে, প্রজন্মের মেধা মনন গঠনে, বিহার ও গ্রামের উন্নয়ন কর্মকান্ডে তথা সমাজ সদ্ধর্ম ও জাতি গঠনে অনন্য ভূমিকা প্রতিপালন করবে পুরুষের সমকক্ষ হয়ে। এতে সমাজের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে, পুরুষের উপর অর্পিত দায়িত্ব সমবন্টন হবে, আর্থিক, কায়িক ওশ্রমে নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণে বহু কল্যাণমুখী মানব হিতকর কাজ দ্রুত সম্পাদন হবে। যুগেযুগে কালেকালে নারীদের সহনশীল মনোভাব , দৃঢ়চেতা ও অধিকার সচেতন নারীরা আর নারী সহায়ক পুরুষদের সর্বাত্মক সহযোগিতায় আজ নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে স্বমহীমায়।

মনে পড়ে সেই ঐতিহাসিক উক্তি বোনাপার্ট নেপোলিয়নের, “তোমরা আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি দেবো”।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, যদিও রাজা শুদ্ধোধনের ঔরসে মহামায়া দেবীর গর্ভজাত সন্তানসিদ্ধার্থ কুমার।মহামায়া দেবীর মৃত্যুর পর শিশুপুত্র সিদ্ধার্থ কুমারের দেখাশুনার দায়িত্ব নিলেনমাসিমা বা বিমাতা মহাপ্রজাপতি গৌতমী।মাতা গৌতমীর নামের সাথে মিল রেখে শিশু সিদ্ধার্থকুমার পরবর্তীতে সিদ্ধার্থ গৌতম নামে প্রসিদ্ধ হলেন। রাজার আধিপত্য ও ক্ষমতা থাকলেওরাজার নাম রাজপুত্রের সাথে রাখা হয়নি। এখানে নারীকে মর্যাদাবান করা হয়েছে।

বুদ্ধ ভগবান মঙ্গল সূত্রে ৩৮টি মঙ্গল বর্ননায় ১১তম ও ১২তম মঙ্গলে বলেছেন,“মাতা-পিতু উপট্ঠানং, পুত্র- দারস্স সঙ্গহো”- মাতা-পিতার সেবা করা, স্ত্রী পুত্রের উপকার করা উত্তম মঙ্গল।

এখানেও মাতৃজাতিকে অগ্রগণ্য ভূমিকায় প্রকাশ করেছেন এবং মাতৃজাতিকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করারউপদেশ দিয়েছেন।প্রত্যেক স্ত্রীর ভরণ পোষণসহ সুন্দর মার্জিত আচার ব্যবহারে সন্তুষ্ট করারনির্দেশ দিয়েছেন। বর্তমান যুগে ধর্মের শ্রীবৃদ্ধি প্রচার-প্রকাশ সমৃদ্ধময় হলেও নারী জাতির প্রকৃত সম্মানের জায়গাটা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি। যদিও নারীরা চোখবুজে সহ্য করে যাচ্ছে নীরবে মানসম্মান ভয়ে।আপাতত দৃষ্টিতে পরিবারকে সুখী সমৃদ্ধ মনে হলেও অনেক অজানা অব্যক্ত ব্যাথা আর দুঃখভোগ করে যাচ্ছে অগনিত নারীসমাজ। নারী সমাজের সমন্বয়, নারীর প্রতি নারীর সহমর্মিতা, নারী কন্ঠে গড়ে উঠতে পারে নারী বান্ধব পরিবেশ। নারীর ঐক্যতা আর পুরুষের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে নারী ভিতরে আর বাহিরে সর্বত্র সুন্দর আন্তরিক পরিবেশে নারীর মেধা মননচিন্তনের সৃজনশীল সৃষ্টিতে প্রগতিশীল আধুনিক বিজ্ঞান মনষ্ক একবিংশ শতাব্দীর নতুন বিশ্বগড়ে উঠতে পারে।
যেমন বৌদ্ধ ইতিহাসে মহাউপাসিকা বিশাখা, প্রধান অগ্রশ্রাবিকা ক্ষেমা ও উৎপলবর্ণা আরো প্রজ্ঞা জ্ঞানে আলোকিত মহাপ্রজাপতি গৌতমী, কৃষা গৌতমী, মল্লিকা দেবী, যশোধরা, ভদ্রা কপিলানী, ধম্মদিন্না, আম্রপালি ও পটাচারা প্রমূখ বহু শীর্ষস্থানীয় রাজকীয় নারীপৃষ্টপোষক বিদ্যমান ছিল তদ্রূপ আবারও সমাজ জাতি সদ্ধর্মের সেবা, দান, উন্নয়ন ও নেতৃত্বেনারীরা অগ্রগণ্য ভূমিকা প্রতিপালন করবে। কথায় আছে, রাজা রাজ্যশাসন করলেও রাজাকে শাসন করেন নারী। পরিশেষে বলি, কবি শরদিন্দু কর্মকার “নারী” কবিতার বলেছেন, “বাপের ঘরে লক্ষী আমি, স্বামীর ঘরে অন্নপূর্ণা, ছেলের ঘরে জননী আমি, আমি ছাড়া সংসার অসম্পূর্ণ”।

সকলের চিন্তাকরা উচিত দেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী। নারীরা এগিয়ে আসলে পুরুষেরা সুফলভোগ করবে বেশী। নারীরা দেশ ও জাতিকে প্রান দিয়ে ভালোবাসেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে , মুক্তিযুদ্ধে, জাতির সংকটময় যে কোন মুহূর্ত নারীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবেঅংশগ্রহণ করে দেশ গঠন করেছেন , শিক্ষিত প্রজন্ম গঠনে নারীরা অনন্য ভূমিকা প্রতিপালনকরেন।নারী পুরুষের পরস্পর আন্তরিক সৌহার্দ্যে সমাজ সদ্ধর্ম ও জাতির সার্বিক কল্যাণে নিবেদিত হয়ে সময়োপযোগী আধুনিক বিশ্ব বিনির্মান করা সম্ভব। আর নারীসমাজ প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও সাহসে মেধা মনন ও চিন্তনে শিক্ষাকে মনেপ্রাণে ধারণ করে নিজেদেরকে যে কোনউপায়ে যোগ্য করে তুলতে হবে নিজগুনে। পরিবার, সমাজ, বিহার, সংগঠন, জাতীয় প্রতিষ্ঠানে গ্রহণযোগ্যতা, অংশগ্রহণ ও সিদ্ধান্ত প্রদানে নিজেদের সম্পৃক্ততা বাড়ানোসহ মেধা, শক্তি ও সাহসে এগিয়ে যেতে হবে আপন মহিমায়। নারীর সকল অগ্রযাত্রা সুগম হোক।

নারীর জয়হোক। জয়তু নারী।

জয়তু বুদ্ধ সাসনম। জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।

লেখক: ঝর্না বড়ুয়া ,

প্রাবন্ধিক ও প্রাক্তন এনজিও কর্মী লং বীচ, ক্যালিফোর্নিয়া, আমেরিকা তারিখ: ৫ই মার্চ, ২০২৩

শেয়ার করুন
আরও সংবাদ দেখুন

সৈয়দবাড়ী ধর্ম প্রবর্তন বৌদ্ধ বিহার দ্বিতীয় ভবনের দ্বারোদ্‌ঘাটন , কর্মবীর করুণাশ্রী থের’র “মহাথের বরণ” ১৯ , ২০ ডিসেম্বর

You cannot copy content of this page

নারী দিবস ও নারীর করণীয় কর্তব্য 

আপডেট সময় ০৭:২৫:০৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৮ মার্চ ২০২৩

আজ ৮ই মার্চ বিশ্ব নারী দিবস। প্রায় দেড়শত বছরেরও অধিককালের ইতিহাস ও সংগ্রামের নাম বিশ্ব নারী দিবস।

নারী শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রাম এই দিনটিকে গিয়ে। ১৮৫৭সালে মজুরি বৈষম্য, কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে নিউইয়র্কের রাস্তার নেমে এসেছিল সুতা কারখানার সংগ্রামী নারী শ্রমিকেরা আর সেই প্রতিবাদী মিছিলে চরম অমানবিক নির্যাতন চালায় শাসক বাহিনী। তারপরও সচেতন নারী সমাজ থেমে থাকেননি।

অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে অবিচল সংগ্রামী নারী সমাজ তারই ধারাবাহিকতায় ১৯০৯ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্ক সোশ্যাল ডেমোক্রেট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তিনি ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ ও পেশায় স্থপতি।পরবর্তীতে ১৯১০সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন।১৭টি দেশ থেকে প্রায় ১০০ জন সচেতন ও মেধাবী নারী নেত্রীরা এই সম্মেলনে যোগদান করেন। এই দ্বিতীয় নারী সম্মেলন থেকে সুযোগ্য নারী নেত্রী ক্লারা সর্বপ্রথম দাবী জানান ৮ই মার্চকে বিশ্ব নারী দিবস হিসাবে পালন করার। সর্বসম্মতিতে সিদ্ধান্ত হয় ১৯১১ সাল থেকে ৮ই মার্চ নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসাবে পালিত হবে।
এভাবে বেশ কয়েকটি দেশ প্রতিবছর দিনটি প্রতিপালনে এগিয়ে এসেছেন। সর্বশেষে জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালের ৮ই মার্চকে “আন্তর্জাতিক নারী দিবস” হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। সেই খেকে বিশ্বের প্রতিটি দেশে এই দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদার প্রতিপালিত হয়ে থাকে।

বিশ্বের অনেক দেশে দিনটিকে সরকারী ছুটির দিন ঘোষনা করেদিনটিকে আরো অর্থবহ ও নারীর প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করেছেন। অদূরভবিষ্যৎ আমাদের দেশেও নারীদের কন্ঠে জোরালো দাবী উঠলে একসময় সরকারী ছুটির দিন অনুমোদন লাভ করবে। প্রতিবছর জাতিসংঘ কর্তৃক একটা প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়। গতবছর ২০২২সালে ছিল, ” যত্নসই আগামীকালের জন্য আজ লিঙ্গ সমতা”।

সংসার সুখের হয় নারীর গুণে। নারী সর্বদা মমতাময়ী কখনো গর্ভধারিণী মাতা, কখনো স্নেহময়ী বোন, কখনো ভালোবাসাময় প্রেমিকা, কখনো প্রিয়তমা স্ত্রী সব পরিচয়ে নারী কোমলপরম মায়াময় হৃদয়ের অধিকারী। অপরিসীম ধৈর্য, সহমর্মিতা, পরিশ্রম, শক্তি ও সাহসের অনন্য প্রতীক নারী।

সভ্যতার শুরুতে নারীর হাত ধরে প্রথম মানুষ দলবদ্ধভাবে বাস করতে শুরু করে।আদিম যুগে ঘর্ষণে ঘর্ষণে আগুন আবিষ্কারের পর পুরুষেরা খাদ্য সংগ্রহের জন্য পশু শিকারে বনে যাওয়া শুরু করলে নারীরা বসবাসের আশেপাশে বীজ বপনের মধ্য দিয়ে কৃষির সূচনা করেছিলেন। সেই নারীর হাত ধরে কৃষিকাজের সূচনা হলেও কালের পরিক্রমায় আজও “নারীর সম্পত্তির আইন” প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার এখনো নারীরা কৃষকের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত। কারণ নারীর কোন কৃষি জমি নেই , জমির মালিক নই বলে নারী কৃষকের মর্যাদা থেকেও বাদ পড়েছে।যদিও এখনো পুরো কৃষিকাজকে ২১ ভাগে ভাগ করা হলে ১৭ টা কাজ করে নারীরা। কিন্তু আরোপরিতাপের বিষয় বীজ সংরক্ষণ, জমি তৈরী করা, ফসল তোলা ও ফসল সংরক্ষণ প্রভৃতি কাজে নিষ্ঠার সাথে শ্রম দিয়েও সেই কষ্টের সুফল ও আনন্দের ভাগীদার হতে পারে না নারী ফসল বিক্রিতে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ও দামদর জানার কোন অধিকার এখনো নারীর নেই। আবার বিশ্বঅর্থনীতিতে নারীর এ শ্রম বার্ষিক আয়ে যোগ হয় না তাতে ১১ ট্রিলিয়ন ডলার প্রতিবছর হারিয়েযায় বিনা স্বীকৃতিতে এই হলো নারীর জীবন।তারপরও নারী থেমে থাকেনি।

শত বাধা বিপত্তি পার হয়ে নারী সগৌরবে আপন মহিমায় এগিয়ে চলেছে অপরিসীম প্রাণশক্তি দিয়ে এভারেস্টের চূড়া থেকে মহাশূন্যে আর সীমান্ত প্রহরী থেকে রাষ্ট পরিচালনায়।

তাই সেই সাম্যবাদী বিপ্লবী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন “নারী” কবিতায়,
“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার; নর।”

শিক্ষা হচ্ছে সকলের মৌলিক অধিকার। আর শিক্ষা মানুষের ইতিবাচক পরিবর্তন করে।একমাত্র প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ স্বাধীন ও মুক্তভাবে চিন্তা করার জ্ঞান লাভ করে।আপাতত দৃষ্টিতে নারী শিক্ষার অগ্রগতি মনে হলেও উচ্চশিক্ষায় ক্রমান্বয়ে কমে কমে পেশাগত কর্মক্ষেত্রে এর হার খুবই নগণ্য। কিন্তু কথায় আছে, যে জাতি যত উন্নত সে জাতি তত শিক্ষিত। আমাদের দেশে নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারী শিক্ষার উন্নয়নে আমৃত্যু লড়াই করেছেন। নারী শিক্ষা সুপ্রতিষ্ঠিত করা, নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর অধিকারপ্রতিষ্ঠা করা ও নারী শিক্ষার প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তাঁর আজীবনের স্বপ্ন। তাই প্রত্যেক অভিভাবক বিশেষ করে মাতৃজাতির প্রথম ও প্রধান কাজ নারী শিক্ষার হার বাড়ানো এবং অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করা।

উচ্চশিক্ষায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে অর্থনৈতিক মুক্তি সাধনে, স্বাধীনমত প্রকাশ করার ক্ষমতা, গ্রহণযোগ্যতা ও পরিবার তথা সমাজে কল্যানকর কাজে অংশগ্রহণ ও সিদ্ধান্ত প্রদান করার মেধা ও যোগ্যতা অর্জন করতে পারলে নারীর নিজস্ব স্বকীয়তা ও মর্যাদাবহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। পরিবার গঠনে, প্রজন্মের মেধা মনন গঠনে, বিহার ও গ্রামের উন্নয়ন কর্মকান্ডে তথা সমাজ সদ্ধর্ম ও জাতি গঠনে অনন্য ভূমিকা প্রতিপালন করবে পুরুষের সমকক্ষ হয়ে। এতে সমাজের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে, পুরুষের উপর অর্পিত দায়িত্ব সমবন্টন হবে, আর্থিক, কায়িক ওশ্রমে নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণে বহু কল্যাণমুখী মানব হিতকর কাজ দ্রুত সম্পাদন হবে। যুগেযুগে কালেকালে নারীদের সহনশীল মনোভাব , দৃঢ়চেতা ও অধিকার সচেতন নারীরা আর নারী সহায়ক পুরুষদের সর্বাত্মক সহযোগিতায় আজ নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে স্বমহীমায়।

মনে পড়ে সেই ঐতিহাসিক উক্তি বোনাপার্ট নেপোলিয়নের, “তোমরা আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি দেবো”।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, যদিও রাজা শুদ্ধোধনের ঔরসে মহামায়া দেবীর গর্ভজাত সন্তানসিদ্ধার্থ কুমার।মহামায়া দেবীর মৃত্যুর পর শিশুপুত্র সিদ্ধার্থ কুমারের দেখাশুনার দায়িত্ব নিলেনমাসিমা বা বিমাতা মহাপ্রজাপতি গৌতমী।মাতা গৌতমীর নামের সাথে মিল রেখে শিশু সিদ্ধার্থকুমার পরবর্তীতে সিদ্ধার্থ গৌতম নামে প্রসিদ্ধ হলেন। রাজার আধিপত্য ও ক্ষমতা থাকলেওরাজার নাম রাজপুত্রের সাথে রাখা হয়নি। এখানে নারীকে মর্যাদাবান করা হয়েছে।

বুদ্ধ ভগবান মঙ্গল সূত্রে ৩৮টি মঙ্গল বর্ননায় ১১তম ও ১২তম মঙ্গলে বলেছেন,“মাতা-পিতু উপট্ঠানং, পুত্র- দারস্স সঙ্গহো”- মাতা-পিতার সেবা করা, স্ত্রী পুত্রের উপকার করা উত্তম মঙ্গল।

এখানেও মাতৃজাতিকে অগ্রগণ্য ভূমিকায় প্রকাশ করেছেন এবং মাতৃজাতিকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করারউপদেশ দিয়েছেন।প্রত্যেক স্ত্রীর ভরণ পোষণসহ সুন্দর মার্জিত আচার ব্যবহারে সন্তুষ্ট করারনির্দেশ দিয়েছেন। বর্তমান যুগে ধর্মের শ্রীবৃদ্ধি প্রচার-প্রকাশ সমৃদ্ধময় হলেও নারী জাতির প্রকৃত সম্মানের জায়গাটা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি। যদিও নারীরা চোখবুজে সহ্য করে যাচ্ছে নীরবে মানসম্মান ভয়ে।আপাতত দৃষ্টিতে পরিবারকে সুখী সমৃদ্ধ মনে হলেও অনেক অজানা অব্যক্ত ব্যাথা আর দুঃখভোগ করে যাচ্ছে অগনিত নারীসমাজ। নারী সমাজের সমন্বয়, নারীর প্রতি নারীর সহমর্মিতা, নারী কন্ঠে গড়ে উঠতে পারে নারী বান্ধব পরিবেশ। নারীর ঐক্যতা আর পুরুষের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে নারী ভিতরে আর বাহিরে সর্বত্র সুন্দর আন্তরিক পরিবেশে নারীর মেধা মননচিন্তনের সৃজনশীল সৃষ্টিতে প্রগতিশীল আধুনিক বিজ্ঞান মনষ্ক একবিংশ শতাব্দীর নতুন বিশ্বগড়ে উঠতে পারে।
যেমন বৌদ্ধ ইতিহাসে মহাউপাসিকা বিশাখা, প্রধান অগ্রশ্রাবিকা ক্ষেমা ও উৎপলবর্ণা আরো প্রজ্ঞা জ্ঞানে আলোকিত মহাপ্রজাপতি গৌতমী, কৃষা গৌতমী, মল্লিকা দেবী, যশোধরা, ভদ্রা কপিলানী, ধম্মদিন্না, আম্রপালি ও পটাচারা প্রমূখ বহু শীর্ষস্থানীয় রাজকীয় নারীপৃষ্টপোষক বিদ্যমান ছিল তদ্রূপ আবারও সমাজ জাতি সদ্ধর্মের সেবা, দান, উন্নয়ন ও নেতৃত্বেনারীরা অগ্রগণ্য ভূমিকা প্রতিপালন করবে। কথায় আছে, রাজা রাজ্যশাসন করলেও রাজাকে শাসন করেন নারী। পরিশেষে বলি, কবি শরদিন্দু কর্মকার “নারী” কবিতার বলেছেন, “বাপের ঘরে লক্ষী আমি, স্বামীর ঘরে অন্নপূর্ণা, ছেলের ঘরে জননী আমি, আমি ছাড়া সংসার অসম্পূর্ণ”।

সকলের চিন্তাকরা উচিত দেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী। নারীরা এগিয়ে আসলে পুরুষেরা সুফলভোগ করবে বেশী। নারীরা দেশ ও জাতিকে প্রান দিয়ে ভালোবাসেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে , মুক্তিযুদ্ধে, জাতির সংকটময় যে কোন মুহূর্ত নারীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবেঅংশগ্রহণ করে দেশ গঠন করেছেন , শিক্ষিত প্রজন্ম গঠনে নারীরা অনন্য ভূমিকা প্রতিপালনকরেন।নারী পুরুষের পরস্পর আন্তরিক সৌহার্দ্যে সমাজ সদ্ধর্ম ও জাতির সার্বিক কল্যাণে নিবেদিত হয়ে সময়োপযোগী আধুনিক বিশ্ব বিনির্মান করা সম্ভব। আর নারীসমাজ প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও সাহসে মেধা মনন ও চিন্তনে শিক্ষাকে মনেপ্রাণে ধারণ করে নিজেদেরকে যে কোনউপায়ে যোগ্য করে তুলতে হবে নিজগুনে। পরিবার, সমাজ, বিহার, সংগঠন, জাতীয় প্রতিষ্ঠানে গ্রহণযোগ্যতা, অংশগ্রহণ ও সিদ্ধান্ত প্রদানে নিজেদের সম্পৃক্ততা বাড়ানোসহ মেধা, শক্তি ও সাহসে এগিয়ে যেতে হবে আপন মহিমায়। নারীর সকল অগ্রযাত্রা সুগম হোক।

নারীর জয়হোক। জয়তু নারী।

জয়তু বুদ্ধ সাসনম। জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।

লেখক: ঝর্না বড়ুয়া ,

প্রাবন্ধিক ও প্রাক্তন এনজিও কর্মী লং বীচ, ক্যালিফোর্নিয়া, আমেরিকা তারিখ: ৫ই মার্চ, ২০২৩