০৮:৪২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৩ মার্চ ২০২৫, ৯ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সুরের আকাশে ধ্রুবতারা : ওস্তাদ নীরদ বরণ বড়ুয়া

  • এস এম আক্কাছ
  • আপডেট সময় ০৪:৩১:২৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • ৬৪৫ বার পড়া হয়েছে

কিছু মানুষ থাকেন, যাঁদের জন্মই হয় পৃথিবীকে আলোকিত করতে; তাঁদের মেধা, মনন আর প্রজ্ঞা যেন বিধাতার নিজ হাতে গড়া। তেমনই একজন মানুষ ছিলেন আমাদের ওস্তাদ নীরদ বরণ বড়ুয়া। সংগীতের এই মহান গুরু তাঁর প্রতিভার আলোয় শুধু বাংলাদেশ নয়, আলোকিত করেছেন উপমহাদেশকেও। নীরবে, নিভৃতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। আর তাই তো সরকারও তাঁকে ভোলেনি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ যে ১৪ জন বিশিষ্টজনকে ২০২৫ সালের একুশে পদকের জন্য মনোনীত করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ফটিকছড়ির এই কৃতিসন্তান। গত ৬ ফেব্রুয়ারি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এই ঘোষণায় চট্টগ্রামের আকাশেও যেন আনন্দের বন্যা বয়ে গেল।

ksrm
দেশের আনাচে-কানাচে কত শত গুণী মানুষের জন্ম হয়! তাঁদের মেধা, তাঁদের শ্রম, তাঁদের আত্মত্যাগ নীরবে আমাদের সমাজকে আলোকিত করে, সমৃদ্ধ করে। কিন্তু আমরা কি তাঁদের মনে রাখি? নতুন প্রজন্মের কাছে কি তুলে ধরি তাঁদের কীর্তিগাথা? এইসব গুণী মানুষেরা যাতে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে না যান, সেই দায়িত্ব কি আমাদের নয়?

ফটিকছড়ির আবদুল্লাপুর গ্রামের সবুজ ছায়াঘেরা পরিবেশে ১৯৩৬ সালে জন্ম নিয়েছিলেন উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সংগীতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, ওস্তাদ নীরদ বরণ বড়ুয়া। বাবা নিকুঞ্জ বিহারী বড়ুয়া আর মা বিরলা বালা বড়ুয়ার কোলজুড়ে এসেছিলেন তিনি। শৈশবেই সংগীতের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ জন্মায়। মাত্র ১৪ বছর বয়সে বাবাকে হারানোর পর, ১৫ বছর বয়সে সংগীতের টানেই তিনি পাড়ি জমান কলকাতায়। সেখানে ওস্তাদ নাটু ঘোষের কাছে তাঁর সংগীতশিক্ষার হাতেখড়ি। এরপর একে একে তিনি শিক্ষা নেন বিশিষ্ট ধ্রুপদী গায়ক অনিল ঘোষ এবং সঙ্গীতাচার্য প্রফুল্ল কুমার সেনের মতো গুণীজনের কাছে। অল-ইন্ডিয়া মিউজিক কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে ১৯৬৫ সালে তিনি ফিরে আসেন নিজের দেশে।

চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্টের তৎকালীন সিনিয়র মেডিকেল অফিসার কামাল এ খান এই প্রতিভাবান শিল্পীকে চিনতে ভুল করেননি। তিনি নীরদ বরণ বড়ুয়াকে নিজের কাছে রেখে চট্টগ্রামের সুধী সমাজের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এরপর চট্টগ্রাম বেতারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি ছড়িয়ে দিতে থাকেন সংগীতের সুধা।

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আর্য সংগীত সমিতি তাঁকে সাদরে গ্রহণ করে ‘সুরেন্দ্র সংগীত বিদ্যাপীঠ’-এর শিক্ষক হিসেবে। দীর্ঘ ২৫ বছর এই বিদ্যাপীঠের অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি চট্টগ্রামে শাস্ত্রীয় সংগীতের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। তাঁর হাতে গড়া কত শত শিক্ষার্থী আজ দেশ-বিদেশে সুনামের সঙ্গে সংগীতচর্চা করছেন! ১৯৮৮ সালে আর্য সংগীত থেকে অবসর নিলেও, সংগীতের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ফুরিয়ে যায়নি। শিক্ষার্থীদের অনুরোধে মোমিন রোডের বাসভবনে তিনি আবারও শুরু করেন সংগীত শিক্ষাদান, যা আজ ‘সুর সপ্তক সংগীত বিদ্যাপীঠ’ নামে পরিচিত।

নীরদ বরণ বড়ুয়ার প্রতিভার আরেক নিদর্শন হলো সংগীত বিষয়ক নাটক ‘সুরের সন্ধান’। সম্ভবত এটিই দেশের একমাত্র সংগীতভিত্তিক নাটক, যা পরপর দুবার মঞ্চস্থ হয়ে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। তাঁর লেখা ‘আরোহ-আবরোহ’ গ্রন্থটি সংগীত শিক্ষার্থীদের কাছে আজও এক অমূল্য সম্পদ।

২০০১ সালের ৯ আগস্ট, এক গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করে তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। কিন্তু রেখে গেলেন তাঁর সুরের মায়া, তাঁর সংগীতের গভীরতা। গ্রামের সেই সাদামাটা ছেলেটি যে একদিন দেশের এত বড় সম্মানে ভূষিত হবেন, মানুষের চাওয়া-পাওয়াকে সংগীতে এমন দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলবেন – তা কে জানত?

এই মহান শিল্পীর নামে যদি ফটিকছড়ির কোনো সড়ক বা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়, তবেই হয়তো তাঁর প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা জানানো হবে। নয়তো কালের নিয়মে তিনিও একদিন হারিয়ে যাবেন বিস্মৃতির অতলে। কিন্তু তাঁর সৃষ্টি? সে তো রয়ে যাবে আমাদের হৃদয়ে, চির অমলিন হয়ে। মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত এই সংগীতগুরুকে জানাই আমাদের অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা।

শেয়ার করুন
আরও সংবাদ দেখুন

You cannot copy content of this page

সুরের আকাশে ধ্রুবতারা : ওস্তাদ নীরদ বরণ বড়ুয়া

আপডেট সময় ০৪:৩১:২৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

কিছু মানুষ থাকেন, যাঁদের জন্মই হয় পৃথিবীকে আলোকিত করতে; তাঁদের মেধা, মনন আর প্রজ্ঞা যেন বিধাতার নিজ হাতে গড়া। তেমনই একজন মানুষ ছিলেন আমাদের ওস্তাদ নীরদ বরণ বড়ুয়া। সংগীতের এই মহান গুরু তাঁর প্রতিভার আলোয় শুধু বাংলাদেশ নয়, আলোকিত করেছেন উপমহাদেশকেও। নীরবে, নিভৃতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। আর তাই তো সরকারও তাঁকে ভোলেনি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ যে ১৪ জন বিশিষ্টজনকে ২০২৫ সালের একুশে পদকের জন্য মনোনীত করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ফটিকছড়ির এই কৃতিসন্তান। গত ৬ ফেব্রুয়ারি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এই ঘোষণায় চট্টগ্রামের আকাশেও যেন আনন্দের বন্যা বয়ে গেল।

ksrm
দেশের আনাচে-কানাচে কত শত গুণী মানুষের জন্ম হয়! তাঁদের মেধা, তাঁদের শ্রম, তাঁদের আত্মত্যাগ নীরবে আমাদের সমাজকে আলোকিত করে, সমৃদ্ধ করে। কিন্তু আমরা কি তাঁদের মনে রাখি? নতুন প্রজন্মের কাছে কি তুলে ধরি তাঁদের কীর্তিগাথা? এইসব গুণী মানুষেরা যাতে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে না যান, সেই দায়িত্ব কি আমাদের নয়?

ফটিকছড়ির আবদুল্লাপুর গ্রামের সবুজ ছায়াঘেরা পরিবেশে ১৯৩৬ সালে জন্ম নিয়েছিলেন উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সংগীতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, ওস্তাদ নীরদ বরণ বড়ুয়া। বাবা নিকুঞ্জ বিহারী বড়ুয়া আর মা বিরলা বালা বড়ুয়ার কোলজুড়ে এসেছিলেন তিনি। শৈশবেই সংগীতের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ জন্মায়। মাত্র ১৪ বছর বয়সে বাবাকে হারানোর পর, ১৫ বছর বয়সে সংগীতের টানেই তিনি পাড়ি জমান কলকাতায়। সেখানে ওস্তাদ নাটু ঘোষের কাছে তাঁর সংগীতশিক্ষার হাতেখড়ি। এরপর একে একে তিনি শিক্ষা নেন বিশিষ্ট ধ্রুপদী গায়ক অনিল ঘোষ এবং সঙ্গীতাচার্য প্রফুল্ল কুমার সেনের মতো গুণীজনের কাছে। অল-ইন্ডিয়া মিউজিক কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে ১৯৬৫ সালে তিনি ফিরে আসেন নিজের দেশে।

চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্টের তৎকালীন সিনিয়র মেডিকেল অফিসার কামাল এ খান এই প্রতিভাবান শিল্পীকে চিনতে ভুল করেননি। তিনি নীরদ বরণ বড়ুয়াকে নিজের কাছে রেখে চট্টগ্রামের সুধী সমাজের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এরপর চট্টগ্রাম বেতারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি ছড়িয়ে দিতে থাকেন সংগীতের সুধা।

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আর্য সংগীত সমিতি তাঁকে সাদরে গ্রহণ করে ‘সুরেন্দ্র সংগীত বিদ্যাপীঠ’-এর শিক্ষক হিসেবে। দীর্ঘ ২৫ বছর এই বিদ্যাপীঠের অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি চট্টগ্রামে শাস্ত্রীয় সংগীতের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। তাঁর হাতে গড়া কত শত শিক্ষার্থী আজ দেশ-বিদেশে সুনামের সঙ্গে সংগীতচর্চা করছেন! ১৯৮৮ সালে আর্য সংগীত থেকে অবসর নিলেও, সংগীতের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ফুরিয়ে যায়নি। শিক্ষার্থীদের অনুরোধে মোমিন রোডের বাসভবনে তিনি আবারও শুরু করেন সংগীত শিক্ষাদান, যা আজ ‘সুর সপ্তক সংগীত বিদ্যাপীঠ’ নামে পরিচিত।

নীরদ বরণ বড়ুয়ার প্রতিভার আরেক নিদর্শন হলো সংগীত বিষয়ক নাটক ‘সুরের সন্ধান’। সম্ভবত এটিই দেশের একমাত্র সংগীতভিত্তিক নাটক, যা পরপর দুবার মঞ্চস্থ হয়ে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। তাঁর লেখা ‘আরোহ-আবরোহ’ গ্রন্থটি সংগীত শিক্ষার্থীদের কাছে আজও এক অমূল্য সম্পদ।

২০০১ সালের ৯ আগস্ট, এক গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করে তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। কিন্তু রেখে গেলেন তাঁর সুরের মায়া, তাঁর সংগীতের গভীরতা। গ্রামের সেই সাদামাটা ছেলেটি যে একদিন দেশের এত বড় সম্মানে ভূষিত হবেন, মানুষের চাওয়া-পাওয়াকে সংগীতে এমন দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলবেন – তা কে জানত?

এই মহান শিল্পীর নামে যদি ফটিকছড়ির কোনো সড়ক বা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়, তবেই হয়তো তাঁর প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা জানানো হবে। নয়তো কালের নিয়মে তিনিও একদিন হারিয়ে যাবেন বিস্মৃতির অতলে। কিন্তু তাঁর সৃষ্টি? সে তো রয়ে যাবে আমাদের হৃদয়ে, চির অমলিন হয়ে। মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত এই সংগীতগুরুকে জানাই আমাদের অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা।