১১:২৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫, ২৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

“চেতনার মুক্তি” ধর্মের এক গভীর অনুসন্ধান

বুদ্ধ মুক্তির কথা বলেছেন। কিসের মুক্তি? চেতনার মুক্তি। মুক্তি হয় চেতনার (চিত্তের), যা কোনো স্থির সত্তা নয়, বরং অভিজ্ঞতা, অভিপ্রায় ও সচেতনতায় গঠিত এক প্রবাহ, যা কারণে-অকারণে গঠিত হয়।

পালিতে দুইটি শব্দ প্রায়ই ব্যবহৃত হয় —চেতো-বিমুত্তি (চিত্তের মুক্তি) ও পঞ্ঞা-বিমুত্তি (প্রজ্ঞার দ্বারা মুক্তি)। এ দুয়ের সমন্বয়ে বুঝায়—মানসিক গঠনশীলতার বিশুদ্ধতা ও বাস্তবতার গভীর অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে মুক্তি।

“যেমন আগুন তখনই নিভে যায় যখন জ্বালানির যোগান বন্ধ হয়, তেমনি চেতনা তখনই মুক্ত হয় যখন আসক্তি থেমে যায়।” (সংযুক্ত নিকায় ২২.৫৩)

এখানে মুক্তি কোনো ব্যক্তির স্বাধীনতা নয়, বরং বন্ধনের অনুপস্থিতি — যে বন্ধন দুঃখের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে।

কী থেকে মুক্তি? বুদ্ধের মতে, মুক্তি হলো দুঃখের মূল-ভিত্তির গঠনগুলো থেকে।

দুঃখ হচ্ছে — অপ্রাপ্তি, অসন্তুষ্টি, অশান্তি। এটি শারীরিক কষ্ট, মানসিক যন্ত্রণা এবং অস্তিত্বের অন্তর্নিহিত অতৃপ্তি ইত্যাদিকে অন্তর্ভুক্ত করে। এটি নৈরাশ্যবাদ নয়, বরং একটি চিকিৎসকসুলভ রোগ নির্ণয় — যা সঠিকভাবে দেখা ও বোঝার আমন্ত্রণ জানায়।

সংসার হচ্ছে জন্ম-মৃত্যুর চক্র। মূলপরিয়ায় সুত্ত (মজ্ঝিমনিকায় ১) অনুসারে, মনের প্রবণতা হচ্ছে “চেতনার মধ্য দিয়ে” বস্তুকে উপলব্ধি করা, তাতে আসক্ত হওয়া এবং ধরে রাখা, এমনকি ‘পৃথিবী’, ‘দেবতা’, কিংবা ‘সর্ববিষয়’ এর মতো ধারণাকেও। এমন মনগড়া ভাবনার (পপঞ্ছ) কারণে চেতনা পুন পুন জন্মলাভ করে।

ধর্মজ্ঞানে দূর্বল বলেই (অবিদ্যার কারণে) সাধারণ মানুষ সব জিনিস, সব চিন্তাকে ‘আমার’ বলে ভাবেন, ধারণ করেন — যা দুঃখের মূল।”

কিলেস হচ্ছে মানসিক কলুষতা। তিনটি মূল কিলেস হলো লোভ, দ্বেষ, মোহ। এই কলুষতা চেতনার স্বচ্ছতাকে আচ্ছন্ন করে এবং প্রতিক্রিয়া ও অভ্যাসের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখে।

উপাদান হচ্ছে আঁকড়ে ধরা। অলগদ্দোপম সুত্তে (মজ্ঝিমনিকায় ২২) বুদ্ধ এক চমৎকার উপমা দিয়েছেন —”ভুলভাবে ধর্মকে ব্যবহার করার অর্থ হলো — বিষাক্ত সাপের কামড় খাওয়া। ধর্মেও যদি আসক্তি তৈরি হয়, তবে সেটিও বন্ধনরূপে কাজ করে।” ধর্ম হলো পারাপারের জন্য একটি ভেলা — সেটি মাথায় তুলে রাখার জন্যে নয়।

চার ধরনের আসক্তি (উপাদান) রয়েছে:
১. কামোপাদান (কামপ্রবৃত্তিতে আসক্তি) – রূপ, শব্দ, গন্ধ, স্বাদ এবং স্পর্শজনিত আনন্দের প্রতি আকর্ষণ, যা তৃষ্ণা (তণ্হা) দ্বারা চালিত হয়। এটি সবচেয়ে সাধারণ আসক্তি, কারণ এটি কামনার মাধ্যমে পুনর্জন্মের চক্রকে টিকিয়ে রাখে।

২. দিট্ঠুপাদান (দৃষ্টি আসক্তি) – মতামত, মতবাদ বা দার্শনিক বিশ্বাসের প্রতি কঠোরভাবে আসক্ত থাকা, তা আত্মা, বিশ্ব বা ধর্মীয় মতাদর্শ ইত্যাদি যে সম্পর্কিত হোক না কেন। এর মধ্যে রয়েছে চিরস্থায়িত্ববাদ (সাস্সত-দিট্ঠি) এবং বিনাশবাদ (উচ্ছেদ-দিট্ঠি)। এই উভয় মতবাদকেই বুদ্ধ প্রত্যাখ্যান করেছেন।

৩. সীলবত্তুপাদান (আচার ও আনুষ্ঠানিকতায় আসক্তি) – বাহ্যিক আচার, অনুষ্ঠান বা নৈতিক বিধি মেনে চলার প্রতি আঁকড়ে থাকা — এই বিশ্বাসে যে, এগুলোই একমাত্র মুক্তির পথ। এর মধ্যে অন্ধবিশ্বাস বা প্রজ্ঞাহীনভাবে ধর্মীয় প্রথা মেনে চলাও অন্তর্ভুক্ত।

৪. অত্তবাদুপাদান (আত্মার ধারণায় আসক্তি) – একটি স্থায়ী, স্বাধীন আত্মার (অত্তা) ধারণার প্রতি আসক্তি। এটি সবচেয়ে গভীর ও সূক্ষ্ম আসক্তি, কারণ এটি অন্যান্য সমস্ত আসক্তির ভিত্তি এবং আত্মপরিচয়ের মাধ্যমে দুঃখ সৃষ্টি করে ও পুনরুৎপাদন করে।

এই চার ধরনের আসক্তি জীবকে সংসারে আবদ্ধ রাখে, দুঃখকে সংহত করে এবং মুক্তি (নিব্বান) অর্জনে বাধা সৃষ্টি করে।

মুক্তি হলো এসব আসক্তির মূল অন্বেষণ ও পরিত্যাগ।

কীভাবে মুক্তি? মুক্তির জন্যে বুদ্ধের নিখুঁত ও গভীর পদ্ধতি হলো — আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ, যা তিনটি অনুশীলনে বিভক্ত।

শীল অর্থাৎ নৈতিক শৃঙ্খলা মূলভিত্তি গঠন করে। সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা হলো শীল যা নৈতিক আচরণে হিতকামনা নিয়ে আসে এবং অশুভ কর্ম থেকে দূরে রাখে।

সমাধি হচ্ছে মানসিক প্রশিক্ষণ।
এখানে মন প্রশিক্ষিত হয় — সম্যক প্রয়াস, সম্যক স্মৃতি এবং সম্যক একাগ্রতার মাধ্যমে।
সতিপট্ঠান সুত্তে (মজ্ঝিমনিকায় ১০) বুদ্ধ স্মৃতি বা মননশীলতার চারটি ভিত্তি বর্ণনা করেছেন।
কায়ানুপস্সনা — দেহ পর্যবেক্ষণ
বেদনানুপস্সনা —অনুভূতি পর্যবেক্ষণ
চিত্তানুপস্সনা —–চেতনার অবস্থা পর্যবেক্ষণ
ধম্মানুপস্সনা —– ধর্মসমূহ পর্যবেক্ষণ

“এটিই বিশুদ্ধির একমাত্র পথ (একায়নো মগ্গো) “।

এই অনুশীলন অনাসক্তি জন্মায় এবং অনিত্য (অনিচ্চা), দুঃখ, অনত্তা উপলব্ধিতে সহায়তা করে।

প্রজ্ঞা — জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত। সম্যক দৃষ্টি (চতুরার্য্য সত্য উপলব্ধি), সম্যক সংকল্প (ত্যাগ, করুণাশীলতা, অহিংসা) অনুশীলনের মাধ্যমে এটি পরিণত হয়, জ্ঞান-দর্শনের পর্যায়ে উন্নীত করে — যা সক্কায়দিটঠি বা আত্মপরিচয়ের বন্ধন ছিন্ন করে।

বর্ণিত বিষয়গুলো বোঝার প্রথম ধাপ: পরিয়ত্তি অর্থাৎ শ্রবণ ও অধ্যয়ন। জ্ঞান শুরু হয় ধর্ম শুনে বা পাঠ করে। ধম্মচক্কপবত্তন সুত্ত (সংযুক্ত নিকায় ৫৬.১১) চতুরার্য্য সত্য বর্ণনা করে, যা চিন্তনকে উদ্বুদ্ধ করে।

দ্বিতীয় ধাপ: পটিপত্তি অর্থাৎ অনুশীলন। অনুশীলনের মাধ্যমে পঠন ও শ্রবণজনিত ধারণা পরিণত হয় সচেতন চর্চায়।

পরিয়ত্তি এবং পটিপত্তি অর্থাৎ ধর্মশ্রবণ, পঠন এবং অনুশীলন চলাকালে মনে প্রশ্ন জাগে “এটা কি আসক্তি না ত্যাগ?” “আমি কি বুদ্ধের শিক্ষাকে আঁকড়ে ধরছি?” “এটা কি আমাকে স্পষ্টতা দিচ্ছে না বিভ্রান্তি?” এভাবে জন্ম নেয় যুক্তিমূলক মনোযোগ (যোনিসো মনসিকার)।

তৃতীয় ধাপ: পটিবেধ — প্রত্যক্ষ উপলব্ধি। বিশেষত বিপস্‌সনা ধ্যান চর্চা দ্বারা উপলব্ধি করা — কিভাবে উদয়-বিলয় হয়, কোনো ‘আমি’ বা ‘আত্ম’ ধারণা ছাড়াই।

এই পথে নিষ্ঠার সাথে এগুতে থাকলেই জন্ম নেয় জাগরণের স্তরসমূহ: সোতাপন্ন (স্রোতে প্রবেশ), সকৃদাগামী (একবার প্রত্যাবর্তন), অনাগামী (আর ফিরে না আসা) এবং অরহন্ত (পূর্ণ মুক্তি)।

এভাবেই প্রজ্ঞার প্রস্ফুটন হয়। বুদ্ধের মুক্তির শিক্ষা একটি রূপান্তরমূলক দৃষ্টিভঙ্গি — বিভ্রমের অবসান। কোন কিছু গভীরভাবে দেখা হলে, সেটার প্রতি আসক্তি থাকেনা। চেতনা হয়ে ওঠে পদ্মের মতো — কাদা জল থেকে উৎসারিত পরিচ্ছন্ন, প্রস্ফুটিত পুষ্প।

মুক্তি কোনো চরমতায় বিলীন হওয়া নয়, বরং নিভে যাওয়া (নিব্বান) — যা সমস্ত বন্ধনকে শেষ করে। এটি ‘কিছুর স্বাধীনতা’ নয়, ‘কিছু থেকে স্বাধীনতা’। এই পথ সূক্ষ্ম, গভীর, অথচ পুরোপুরি উপলব্ধিযোগ্য।

“যেমন সাগরের একটিই স্বাদ — লবণের স্বাদ, তেমনি ধর্মেরো একটিই স্বাদ — মুক্তির স্বাদ।”

শেয়ার করুন
আরও সংবাদ দেখুন

জনপ্রিয়

You cannot copy content of this page

“চেতনার মুক্তি” ধর্মের এক গভীর অনুসন্ধান

আপডেট সময় ১০:০২:৪৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫

বুদ্ধ মুক্তির কথা বলেছেন। কিসের মুক্তি? চেতনার মুক্তি। মুক্তি হয় চেতনার (চিত্তের), যা কোনো স্থির সত্তা নয়, বরং অভিজ্ঞতা, অভিপ্রায় ও সচেতনতায় গঠিত এক প্রবাহ, যা কারণে-অকারণে গঠিত হয়।

পালিতে দুইটি শব্দ প্রায়ই ব্যবহৃত হয় —চেতো-বিমুত্তি (চিত্তের মুক্তি) ও পঞ্ঞা-বিমুত্তি (প্রজ্ঞার দ্বারা মুক্তি)। এ দুয়ের সমন্বয়ে বুঝায়—মানসিক গঠনশীলতার বিশুদ্ধতা ও বাস্তবতার গভীর অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে মুক্তি।

“যেমন আগুন তখনই নিভে যায় যখন জ্বালানির যোগান বন্ধ হয়, তেমনি চেতনা তখনই মুক্ত হয় যখন আসক্তি থেমে যায়।” (সংযুক্ত নিকায় ২২.৫৩)

এখানে মুক্তি কোনো ব্যক্তির স্বাধীনতা নয়, বরং বন্ধনের অনুপস্থিতি — যে বন্ধন দুঃখের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে।

কী থেকে মুক্তি? বুদ্ধের মতে, মুক্তি হলো দুঃখের মূল-ভিত্তির গঠনগুলো থেকে।

দুঃখ হচ্ছে — অপ্রাপ্তি, অসন্তুষ্টি, অশান্তি। এটি শারীরিক কষ্ট, মানসিক যন্ত্রণা এবং অস্তিত্বের অন্তর্নিহিত অতৃপ্তি ইত্যাদিকে অন্তর্ভুক্ত করে। এটি নৈরাশ্যবাদ নয়, বরং একটি চিকিৎসকসুলভ রোগ নির্ণয় — যা সঠিকভাবে দেখা ও বোঝার আমন্ত্রণ জানায়।

সংসার হচ্ছে জন্ম-মৃত্যুর চক্র। মূলপরিয়ায় সুত্ত (মজ্ঝিমনিকায় ১) অনুসারে, মনের প্রবণতা হচ্ছে “চেতনার মধ্য দিয়ে” বস্তুকে উপলব্ধি করা, তাতে আসক্ত হওয়া এবং ধরে রাখা, এমনকি ‘পৃথিবী’, ‘দেবতা’, কিংবা ‘সর্ববিষয়’ এর মতো ধারণাকেও। এমন মনগড়া ভাবনার (পপঞ্ছ) কারণে চেতনা পুন পুন জন্মলাভ করে।

ধর্মজ্ঞানে দূর্বল বলেই (অবিদ্যার কারণে) সাধারণ মানুষ সব জিনিস, সব চিন্তাকে ‘আমার’ বলে ভাবেন, ধারণ করেন — যা দুঃখের মূল।”

কিলেস হচ্ছে মানসিক কলুষতা। তিনটি মূল কিলেস হলো লোভ, দ্বেষ, মোহ। এই কলুষতা চেতনার স্বচ্ছতাকে আচ্ছন্ন করে এবং প্রতিক্রিয়া ও অভ্যাসের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখে।

উপাদান হচ্ছে আঁকড়ে ধরা। অলগদ্দোপম সুত্তে (মজ্ঝিমনিকায় ২২) বুদ্ধ এক চমৎকার উপমা দিয়েছেন —”ভুলভাবে ধর্মকে ব্যবহার করার অর্থ হলো — বিষাক্ত সাপের কামড় খাওয়া। ধর্মেও যদি আসক্তি তৈরি হয়, তবে সেটিও বন্ধনরূপে কাজ করে।” ধর্ম হলো পারাপারের জন্য একটি ভেলা — সেটি মাথায় তুলে রাখার জন্যে নয়।

চার ধরনের আসক্তি (উপাদান) রয়েছে:
১. কামোপাদান (কামপ্রবৃত্তিতে আসক্তি) – রূপ, শব্দ, গন্ধ, স্বাদ এবং স্পর্শজনিত আনন্দের প্রতি আকর্ষণ, যা তৃষ্ণা (তণ্হা) দ্বারা চালিত হয়। এটি সবচেয়ে সাধারণ আসক্তি, কারণ এটি কামনার মাধ্যমে পুনর্জন্মের চক্রকে টিকিয়ে রাখে।

২. দিট্ঠুপাদান (দৃষ্টি আসক্তি) – মতামত, মতবাদ বা দার্শনিক বিশ্বাসের প্রতি কঠোরভাবে আসক্ত থাকা, তা আত্মা, বিশ্ব বা ধর্মীয় মতাদর্শ ইত্যাদি যে সম্পর্কিত হোক না কেন। এর মধ্যে রয়েছে চিরস্থায়িত্ববাদ (সাস্সত-দিট্ঠি) এবং বিনাশবাদ (উচ্ছেদ-দিট্ঠি)। এই উভয় মতবাদকেই বুদ্ধ প্রত্যাখ্যান করেছেন।

৩. সীলবত্তুপাদান (আচার ও আনুষ্ঠানিকতায় আসক্তি) – বাহ্যিক আচার, অনুষ্ঠান বা নৈতিক বিধি মেনে চলার প্রতি আঁকড়ে থাকা — এই বিশ্বাসে যে, এগুলোই একমাত্র মুক্তির পথ। এর মধ্যে অন্ধবিশ্বাস বা প্রজ্ঞাহীনভাবে ধর্মীয় প্রথা মেনে চলাও অন্তর্ভুক্ত।

৪. অত্তবাদুপাদান (আত্মার ধারণায় আসক্তি) – একটি স্থায়ী, স্বাধীন আত্মার (অত্তা) ধারণার প্রতি আসক্তি। এটি সবচেয়ে গভীর ও সূক্ষ্ম আসক্তি, কারণ এটি অন্যান্য সমস্ত আসক্তির ভিত্তি এবং আত্মপরিচয়ের মাধ্যমে দুঃখ সৃষ্টি করে ও পুনরুৎপাদন করে।

এই চার ধরনের আসক্তি জীবকে সংসারে আবদ্ধ রাখে, দুঃখকে সংহত করে এবং মুক্তি (নিব্বান) অর্জনে বাধা সৃষ্টি করে।

মুক্তি হলো এসব আসক্তির মূল অন্বেষণ ও পরিত্যাগ।

কীভাবে মুক্তি? মুক্তির জন্যে বুদ্ধের নিখুঁত ও গভীর পদ্ধতি হলো — আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ, যা তিনটি অনুশীলনে বিভক্ত।

শীল অর্থাৎ নৈতিক শৃঙ্খলা মূলভিত্তি গঠন করে। সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা হলো শীল যা নৈতিক আচরণে হিতকামনা নিয়ে আসে এবং অশুভ কর্ম থেকে দূরে রাখে।

সমাধি হচ্ছে মানসিক প্রশিক্ষণ।
এখানে মন প্রশিক্ষিত হয় — সম্যক প্রয়াস, সম্যক স্মৃতি এবং সম্যক একাগ্রতার মাধ্যমে।
সতিপট্ঠান সুত্তে (মজ্ঝিমনিকায় ১০) বুদ্ধ স্মৃতি বা মননশীলতার চারটি ভিত্তি বর্ণনা করেছেন।
কায়ানুপস্সনা — দেহ পর্যবেক্ষণ
বেদনানুপস্সনা —অনুভূতি পর্যবেক্ষণ
চিত্তানুপস্সনা —–চেতনার অবস্থা পর্যবেক্ষণ
ধম্মানুপস্সনা —– ধর্মসমূহ পর্যবেক্ষণ

“এটিই বিশুদ্ধির একমাত্র পথ (একায়নো মগ্গো) “।

এই অনুশীলন অনাসক্তি জন্মায় এবং অনিত্য (অনিচ্চা), দুঃখ, অনত্তা উপলব্ধিতে সহায়তা করে।

প্রজ্ঞা — জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত। সম্যক দৃষ্টি (চতুরার্য্য সত্য উপলব্ধি), সম্যক সংকল্প (ত্যাগ, করুণাশীলতা, অহিংসা) অনুশীলনের মাধ্যমে এটি পরিণত হয়, জ্ঞান-দর্শনের পর্যায়ে উন্নীত করে — যা সক্কায়দিটঠি বা আত্মপরিচয়ের বন্ধন ছিন্ন করে।

বর্ণিত বিষয়গুলো বোঝার প্রথম ধাপ: পরিয়ত্তি অর্থাৎ শ্রবণ ও অধ্যয়ন। জ্ঞান শুরু হয় ধর্ম শুনে বা পাঠ করে। ধম্মচক্কপবত্তন সুত্ত (সংযুক্ত নিকায় ৫৬.১১) চতুরার্য্য সত্য বর্ণনা করে, যা চিন্তনকে উদ্বুদ্ধ করে।

দ্বিতীয় ধাপ: পটিপত্তি অর্থাৎ অনুশীলন। অনুশীলনের মাধ্যমে পঠন ও শ্রবণজনিত ধারণা পরিণত হয় সচেতন চর্চায়।

পরিয়ত্তি এবং পটিপত্তি অর্থাৎ ধর্মশ্রবণ, পঠন এবং অনুশীলন চলাকালে মনে প্রশ্ন জাগে “এটা কি আসক্তি না ত্যাগ?” “আমি কি বুদ্ধের শিক্ষাকে আঁকড়ে ধরছি?” “এটা কি আমাকে স্পষ্টতা দিচ্ছে না বিভ্রান্তি?” এভাবে জন্ম নেয় যুক্তিমূলক মনোযোগ (যোনিসো মনসিকার)।

তৃতীয় ধাপ: পটিবেধ — প্রত্যক্ষ উপলব্ধি। বিশেষত বিপস্‌সনা ধ্যান চর্চা দ্বারা উপলব্ধি করা — কিভাবে উদয়-বিলয় হয়, কোনো ‘আমি’ বা ‘আত্ম’ ধারণা ছাড়াই।

এই পথে নিষ্ঠার সাথে এগুতে থাকলেই জন্ম নেয় জাগরণের স্তরসমূহ: সোতাপন্ন (স্রোতে প্রবেশ), সকৃদাগামী (একবার প্রত্যাবর্তন), অনাগামী (আর ফিরে না আসা) এবং অরহন্ত (পূর্ণ মুক্তি)।

এভাবেই প্রজ্ঞার প্রস্ফুটন হয়। বুদ্ধের মুক্তির শিক্ষা একটি রূপান্তরমূলক দৃষ্টিভঙ্গি — বিভ্রমের অবসান। কোন কিছু গভীরভাবে দেখা হলে, সেটার প্রতি আসক্তি থাকেনা। চেতনা হয়ে ওঠে পদ্মের মতো — কাদা জল থেকে উৎসারিত পরিচ্ছন্ন, প্রস্ফুটিত পুষ্প।

মুক্তি কোনো চরমতায় বিলীন হওয়া নয়, বরং নিভে যাওয়া (নিব্বান) — যা সমস্ত বন্ধনকে শেষ করে। এটি ‘কিছুর স্বাধীনতা’ নয়, ‘কিছু থেকে স্বাধীনতা’। এই পথ সূক্ষ্ম, গভীর, অথচ পুরোপুরি উপলব্ধিযোগ্য।

“যেমন সাগরের একটিই স্বাদ — লবণের স্বাদ, তেমনি ধর্মেরো একটিই স্বাদ — মুক্তির স্বাদ।”