প্রখ্যাত রবীন্দ্র-জীবনীকার কৃষ্ণ কৃপালনির জবানিতে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে, ‘জীবনে একবারমাত্র একটি মূর্তির সামনে আমার প্রণত হওয়ার প্রেরণা জেগেছিল, সেটা বুদ্ধগয়ায়, যখন আমি বুদ্ধমূর্তি দর্শন করি।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই উক্তির তাৎপর্য এই যে, ব্যাপারটি তাঁর পরিবার ও সমাজের পক্ষে মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কারণ তাঁরা ব্রাহ্ম, নিরাকার ব্রহ্মের উপাসক, মূর্তিপূজার ঘোরতর বিরোধী। সেই রবীন্দ্রনাথের হৃদয় ভগবান বুদ্ধ এমনভাবে জয় করেছিলেন যে তাঁর পবিত্র মূর্তির সামনে প্রণাম নিবেদনের জন্য তাঁর অন্তর প্রস্তুত হয়েছিল।
কৃপালনি যে কোনও অতিশয়োক্তি করেননি তার ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত কবি নিজে রেখে গিয়েছেন—কবিতায়, গানে, ভাষণে, ধর্মতত্ত্ব আলোচনায়। ভগবান বুদ্ধদেবকেই কবি ‘অন্তরের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলে উপলব্ধি’ করেছেন এবং তাঁর বিচিত্র সৃষ্টির ভিতর দিয়ে তাঁর প্রতি বারবার প্রণাম নিবেদন করে ধন্য হয়েছেন।
১৩৪২ সালে বৈশাখী পূর্ণিমায় কলকাতা মহাবোধি সোসাইটি হলে কবি আমন্ত্রিত ছিলেন। বুদ্ধ-জন্মোৎসব উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেদিন যে দীর্ঘ ভাষণটি দেন সেটি বিশ্বসাহিত্যের একটি অমূল্য সম্পদ। তাঁর সেই স্মরণীয় ভাষণ শুরু হয়েছিল এইভাবে—‘আমি যাঁকে অন্তরের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলে উপলব্ধি করি আজ এই বৈশাখী পূর্ণিমায় তাঁর জন্মোৎসবে আমার প্রণাম নিবেদন করতে এসেছি। এ কোনও অনুষ্ঠানের উপকরণগত অলংকার নয়, একান্তে নিভৃতে যা তাঁকে বার বার সমর্পণ করেছি সেই অর্ঘ্যই আজ এখানে উৎসর্গ করি।’
কবি কৃতজ্ঞচিত্তে বারবার উচ্চারণ করেছেন, অমেয় প্রেমের মন্ত্র ‘বুদ্ধের শরণ লইলাম’। আমাদের কৌতূহল হয়, রবীন্দ্রনাথের উপর বুদ্ধের এই অপরিমেয় প্রভাব কেন? খোঁজ নিলে দেখা যায় যে, বুদ্ধের জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথই প্রথম পরিচিত হননি, তাঁর পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ-সহ তাঁর পরিবারের পরিচয় বরং আরও আগে। বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির বিশিষ্ট স্থান ছিল সিংহল (আজকের শ্রীলঙ্কা)। ১৮৫৯ সালে দেবেন্দ্রনাথ স্বয়ং সিংহল ভ্রমণে যান। সঙ্গী ছিলেন পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ এবং ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম নেতা কেশবচন্দ্র সেন। বঙ্গদেশে মাঝে ক্ষীণ হয়ে আসা বুদ্ধচেতনা নিয়ে তাঁরা ফিরে আসেন। ঠাকুর পরিবারে তা চর্চারও বিষয় হয়ে ওঠে। সত্যেন্দ্রনাথ ‘বৌদ্ধধর্ম’ নামে একটি বই লেখেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ লেখেন ‘আর্যধর্ম্ম এবং বৌদ্ধধর্ম্মের পরস্পর ঘাত-প্রতিঘাত ও সঙ্ঘাত’। সত্যেন্দ্রনাথ বিলেতে গিয়ে প্রখ্যাত ভারতত্ত্ববিদ ম্যাক্সমুলারের সংস্পর্শে পৌঁছে এই বিষয়ে আরও সম্পৃক্ত হয়ে ওঠেন। রবীন্দ্রনাথের উপর তাঁর পিতা ও বহু কৌণিক প্রতিভাধর দাদাদের বিরাট প্রভাবের কথা আমাদের অজানা নয়। অতএব রবীন্দ্রনাথের সমগ্রসত্তা বুদ্ধের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কারণটি সহজেই অনুমেয়। বুদ্ধের প্রতি রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধামিশ্রিত কৌতূহল জাগিয়েছিলেন আর একজন—ইংরেজ কবি এডুইন আর্নল্ড। আর্নল্ডের ‘লাইট অব এশিয়া’ কাব্যগ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ ও আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাধনায় এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছিল। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় যে বুদ্ধগয়াতেও আর্নল্ডের বইটি নিয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
কবি একবার নয়, অন্তত দু’বার বুদ্ধগয়ায় গিয়েছিলেন—১৯০৪ এবং ১৯১৪ সালে। প্রথমবার তাঁর সঙ্গী ছিলেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র, ভগিনী নিবেদিতা, ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার-সহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি। তাঁরা একত্রে বসে আর্নল্ডের ‘লাইট অব এশিয়া’ এবং হার্ভার্ডের প্রাচ্যবিশারদ হেনরি ক্লার্ক ওয়ারেনের ‘বুদ্ধিজম’ বই থেকে অংশবিশেষ পড়ে আলোচনা করতেন। শান্তিনিকেতনের শিক্ষক গোঁসাইজিকে উদ্ধৃত করে অধ্যাপক সুধাংশুবিমল বড়ুয়া লিখেছেন, ‘এবার (১৯০৪) বুদ্ধগয়া থেকে আসার পর রবীন্দ্রনাথ মস্তক মুণ্ডন করেছিলেন। তখন কবির মনে নাকি বৈরাগ্যের সঞ্চার হয়েছিল।’ কবি দ্বিতীয়বার বুদ্ধগয়ায় গিয়ে তিনদিনে দশটি গান লিখেছিলেন—যেগুলিতে ভগবান বুদ্ধের প্রতি অনুরাগ প্রচ্ছন্ন। জাপানযাত্রী কবি ১৯১৬-তে ব্রহ্মদেশের (আজকের মায়ানমার) তৎকালীন রাজধানী রেঙ্গুনে (আজকের ইয়াঙ্গন) পা রাখেন। পরদিন ছিল ২৫ বৈশাখ। জন্মদিনের সকালে কবি সেখানকার বিখ্যাত শোয়েডেগান বৌদ্ধমন্দির দর্শন করে অভিভূত হন। ওই মন্দিরের ভিতরেই তিনি বিরাট ব্রহ্মদেশের নিজস্বতার প্রকাশ আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, কোনও এককালে ভারতীয় সাধনার আলোকে ব্রহ্মদেশের হৃদপদ্ম বিকশিত হয়েছিল। ওই মন্দিরের ভিতরে কবি উপলব্ধি করেছিলেন তারই প্রকাশ। সেদিন তাঁর মনে এমন ভাবের উদয় হয়েছিল যে, শুধুমাত্র ব্রহ্মদেশের অচেনা কোনও এক গাঁয়ের বৌদ্ধমঠে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে পারলে বেশ আরাম পাবেন ভেবেছিলেন। কবি চীনে যাওয়ার পথে ১৯২৪-এও ফের রেঙ্গুনে অবস্থান করেন। নাগরিক সংবর্ধনার উত্তরে রবীন্দ্রনাথ ‘মৈত্রীর আদর্শ’কেই ভারতের শ্রেষ্ঠ দান বলে উল্লেখ করেন। এর ভিতরে তিনি যে বুদ্ধের নীতিকেই ইঙ্গিত করেছিলেন তা বুঝতে বাকি থাকে না। বৌদ্ধ সংস্কৃতির টানে কবি তিনবার সিংহলে এবং দ্বীপময় ভারতে (থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জাভা, সুমাত্রা, বালি প্রভৃতি) গিয়েছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিংসার নীতি কবিকে ভীষণ ব্যথিত করে। আক্রান্ত চীনের জন্য কবির মন কেঁদে উঠেছিল। দুই সুপ্রাচীন সভ্য দেশের ধর্ম ও সংস্কৃতির নিবিড় আত্মীয়তাকে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। চীনবাসীদের জন্য প্রাণভরা ভালোবাসা শুভেচ্ছা নিয়ে কবি চীনে পাড়ি দেন ১৯২৪-এ। কবি সেদিন নানাভাবে চীনের জয় কামনা করেছিলেন। তিনি আশা ব্যক্ত করেছিলেন, অতীতের সাধনা যেমন ভারত ও চীনকে মৈত্রীর বাঁধনে বেঁধেছিল অদূর ভবিষ্যতেও সেই শক্তি দুই প্রতিবেশীকে প্রীতির বাঁধনে বাঁধবে। গত কয়েক দশকে ভারত-চীন সম্পর্কের তিক্ততা দেখে, আজ হলে, কবি কতটা ব্যথা পেতেন অনুমান করা শক্ত নয়। ভারত ও চীন দুই রাষ্ট্রের বিষয়টি নতুন করে ভাবা উচিত। হাংচৌ, সাংহাই, পিকিং, নানকিং প্রভৃতি শহরে কবির জন্য অনেকগুলি সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়। পিকিঙে অবস্থানকালে নির্বাসিত মাঞ্চু সম্রাট কবিকে তাঁর প্রাসাদে সাদর অভ্যর্থনা জানান। কবির হাতে উপহার হিসেবে সম্রাট তুলে দেন অমূল্য এক বুদ্ধমূর্তি—চীনের ইতিহাসে এক বিরল সম্মান প্রদর্শন। কবির চীন সফরকালে পড়ল ২৫ বৈশাখ, কবির জন্মদিন। ক্রিসেন্ট মুন সোসাইটি বিশেষ চৈনিক রীতিতে সেদিন তাঁর সম্মানে এক উৎসবের আয়োজন করে। বিশিষ্টজনেরা তাঁকে ভারত-চীন ঐক্যের প্রতীক হিসেবে উল্লেখসহ ‘চু-চেন-তান’ উপাধি প্রদান করেন।
বৌদ্ধ কালচারের প্রতি কবির অনুরাগ এতটাই গভীর ছিল যে, পৃথিবীর নানা প্রান্তের বৌদ্ধ পণ্ডিতদের শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতীতে শামিল করেছিলেন। যেমন ফ্রান্সের সিলভ্যাঁ লেভি, চীনের লিন ও-চিয়াং এবং রোমের জোসেপ তুচ্চি। লেভিই বিশ্বভারতীর প্রথম অতিথি অধ্যাপক। আচার্য লেভিরই আন্তরিকতায় বিশ্বভারতীতে চীনভবন প্রতিষ্ঠা-সহ বৌদ্ধশাস্ত্র গবেষণার ব্যবস্থা হয়। বলা বাহুল্য, ভারতীয় বৌদ্ধ পণ্ডিতও ছিলেন একাধিক।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করার মতো একটি তথ্য এই যে, কলকাতায় মহাবোধি সোসাইটি প্রতিষ্ঠার দু’বছর বাদে ১৮৯৩-তে শিকাগো বিশ্ব ধর্মমহাসভায় বৌদ্ধধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেন সিংহলের তরুণ অনাগারিক ধর্মপাল। সেখানেই স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের এই দুই তরুণ নেতার প্রীতির সম্পর্কের বিষয়টি কবিরও দৃষ্টি এড়ায়নি। ধর্মপাল কলকাতায় ফিরে বুদ্ধচেতনায় ভারতবাসীকে জাগাতে চেষ্টা করেন। বৈশাখী পূর্ণিমায় বুদ্ধ-জয়ন্তী পালনেরও উদ্যোগ নেন তিনি। বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ লেখেন তাঁর বিখ্যাত দু’টি গান—‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী’ এবং ‘সকল কলুষ-তামস হর’।
শুধু ধর্ম নয় রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তার ভিতরেও বুদ্ধের আদর্শের কোমল স্পর্শ ছিল। ভগবান বুদ্ধকে উদ্ধৃত করে কবি আমাদের সাবধান করে গিয়েছেন, বাহুবলের সাহায্যে ক্রোধ-প্রতিহিংসাকে জয়ী করে শান্তি মিলবে না। শান্তির উপায় হচ্ছে ক্ষমা। রাষ্ট্র ও সমাজনীতিতে এই জিনিস মানুষ যতদিন না স্বীকার করবে ততদিন অপরাধ বেড়ে চলবে। রাষ্ট্রগত বিরোধের আগুন নিভবে না। পৃথিবীর মর্মান্তিক পীড়া উত্তরোত্তর দুঃসহ হতে থাকবে। কোথাও এর শেষ পাওয়া যাবে না।
যুদ্ধক্লান্ত তৎকালীন ইউরোপ রবীন্দ্রনাথকে মানবপ্রেমিক আবিষ্কার করেছিল। কিন্তু সে ছিল রাজনীতির ক্ষেত্রে। পশ্চিমের মানুষ জানত না যে সাহিত্যক্ষেত্রেও তিনি সর্বাগ্রে মানবপ্রেমিক। আরও বিশদে বলা যায় যে তাঁর সমস্ত প্রেম ছিল জীবন ও মাটির পৃথিবীটার জন্য। স্বর্গের চাইতে মর্ত্যকে, পরলোকের চাইতে ইহলোককে এবং দেবতার চাইতে মানুষকেই বেশি মূল্য দিয়েছেন তিনি। এরপর বুঝতে অসুবিধা হয় না, সবাই যাঁকে ‘ভগবান’ বুদ্ধ বলেছেন, কবি কেন তাঁকে প্রণাম নিবেদন করতে গিয়ে অন্তরের সমস্ত শ্রদ্ধা ঢেলে ‘শ্রেষ্ঠ মানব’ বলে উল্লেখ করেছেন
১৩৪২ সালে বৈশাখী পূর্ণিমায় কলকাতা মহাবোধি সোসাইটি হলে কবি আমন্ত্রিত ছিলেন। বুদ্ধ-জন্মোৎসব উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেদিন যে দীর্ঘ ভাষণটি দেন সেটি বিশ্বসাহিত্যের একটি অমূল্য সম্পদ। তাঁর সেই স্মরণীয় ভাষণ শুরু হয়েছিল এইভাবে—‘আমি যাঁকে অন্তরের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলে উপলব্ধি করি আজ এই বৈশাখী পূর্ণিমায় তাঁর জন্মোৎসবে আমার প্রণাম নিবেদন করতে এসেছি। এ কোনও অনুষ্ঠানের উপকরণগত অলংকার নয়, একান্তে নিভৃতে যা তাঁকে বার বার সমর্পণ করেছি সেই অর্ঘ্যই আজ এখানে উৎসর্গ করি।’
কবি কৃতজ্ঞচিত্তে বারবার উচ্চারণ করেছেন, অমেয় প্রেমের মন্ত্র ‘বুদ্ধের শরণ লইলাম’। আমাদের কৌতূহল হয়, রবীন্দ্রনাথের উপর বুদ্ধের এই অপরিমেয় প্রভাব কেন? খোঁজ নিলে দেখা যায় যে, বুদ্ধের জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথই প্রথম পরিচিত হননি, তাঁর পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ-সহ তাঁর পরিবারের পরিচয় বরং আরও আগে। বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির বিশিষ্ট স্থান ছিল সিংহল (আজকের শ্রীলঙ্কা)। ১৮৫৯ সালে দেবেন্দ্রনাথ স্বয়ং সিংহল ভ্রমণে যান। সঙ্গী ছিলেন পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ এবং ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম নেতা কেশবচন্দ্র সেন। বঙ্গদেশে মাঝে ক্ষীণ হয়ে আসা বুদ্ধচেতনা নিয়ে তাঁরা ফিরে আসেন। ঠাকুর পরিবারে তা চর্চারও বিষয় হয়ে ওঠে। সত্যেন্দ্রনাথ ‘বৌদ্ধধর্ম’ নামে একটি বই লেখেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ লেখেন ‘আর্যধর্ম্ম এবং বৌদ্ধধর্ম্মের পরস্পর ঘাত-প্রতিঘাত ও সঙ্ঘাত’। সত্যেন্দ্রনাথ বিলেতে গিয়ে প্রখ্যাত ভারতত্ত্ববিদ ম্যাক্সমুলারের সংস্পর্শে পৌঁছে এই বিষয়ে আরও সম্পৃক্ত হয়ে ওঠেন। রবীন্দ্রনাথের উপর তাঁর পিতা ও বহু কৌণিক প্রতিভাধর দাদাদের বিরাট প্রভাবের কথা আমাদের অজানা নয়। অতএব রবীন্দ্রনাথের সমগ্রসত্তা বুদ্ধের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কারণটি সহজেই অনুমেয়। বুদ্ধের প্রতি রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধামিশ্রিত কৌতূহল জাগিয়েছিলেন আর একজন—ইংরেজ কবি এডুইন আর্নল্ড। আর্নল্ডের ‘লাইট অব এশিয়া’ কাব্যগ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ ও আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাধনায় এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছিল। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় যে বুদ্ধগয়াতেও আর্নল্ডের বইটি নিয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
কবি একবার নয়, অন্তত দু’বার বুদ্ধগয়ায় গিয়েছিলেন—১৯০৪ এবং ১৯১৪ সালে। প্রথমবার তাঁর সঙ্গী ছিলেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র, ভগিনী নিবেদিতা, ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার-সহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি। তাঁরা একত্রে বসে আর্নল্ডের ‘লাইট অব এশিয়া’ এবং হার্ভার্ডের প্রাচ্যবিশারদ হেনরি ক্লার্ক ওয়ারেনের ‘বুদ্ধিজম’ বই থেকে অংশবিশেষ পড়ে আলোচনা করতেন। শান্তিনিকেতনের শিক্ষক গোঁসাইজিকে উদ্ধৃত করে অধ্যাপক সুধাংশুবিমল বড়ুয়া লিখেছেন, ‘এবার (১৯০৪) বুদ্ধগয়া থেকে আসার পর রবীন্দ্রনাথ মস্তক মুণ্ডন করেছিলেন। তখন কবির মনে নাকি বৈরাগ্যের সঞ্চার হয়েছিল।’ কবি দ্বিতীয়বার বুদ্ধগয়ায় গিয়ে তিনদিনে দশটি গান লিখেছিলেন—যেগুলিতে ভগবান বুদ্ধের প্রতি অনুরাগ প্রচ্ছন্ন। জাপানযাত্রী কবি ১৯১৬-তে ব্রহ্মদেশের (আজকের মায়ানমার) তৎকালীন রাজধানী রেঙ্গুনে (আজকের ইয়াঙ্গন) পা রাখেন। পরদিন ছিল ২৫ বৈশাখ। জন্মদিনের সকালে কবি সেখানকার বিখ্যাত শোয়েডেগান বৌদ্ধমন্দির দর্শন করে অভিভূত হন। ওই মন্দিরের ভিতরেই তিনি বিরাট ব্রহ্মদেশের নিজস্বতার প্রকাশ আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, কোনও এককালে ভারতীয় সাধনার আলোকে ব্রহ্মদেশের হৃদপদ্ম বিকশিত হয়েছিল। ওই মন্দিরের ভিতরে কবি উপলব্ধি করেছিলেন তারই প্রকাশ। সেদিন তাঁর মনে এমন ভাবের উদয় হয়েছিল যে, শুধুমাত্র ব্রহ্মদেশের অচেনা কোনও এক গাঁয়ের বৌদ্ধমঠে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে পারলে বেশ আরাম পাবেন ভেবেছিলেন। কবি চীনে যাওয়ার পথে ১৯২৪-এও ফের রেঙ্গুনে অবস্থান করেন। নাগরিক সংবর্ধনার উত্তরে রবীন্দ্রনাথ ‘মৈত্রীর আদর্শ’কেই ভারতের শ্রেষ্ঠ দান বলে উল্লেখ করেন। এর ভিতরে তিনি যে বুদ্ধের নীতিকেই ইঙ্গিত করেছিলেন তা বুঝতে বাকি থাকে না। বৌদ্ধ সংস্কৃতির টানে কবি তিনবার সিংহলে এবং দ্বীপময় ভারতে (থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জাভা, সুমাত্রা, বালি প্রভৃতি) গিয়েছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিংসার নীতি কবিকে ভীষণ ব্যথিত করে। আক্রান্ত চীনের জন্য কবির মন কেঁদে উঠেছিল। দুই সুপ্রাচীন সভ্য দেশের ধর্ম ও সংস্কৃতির নিবিড় আত্মীয়তাকে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। চীনবাসীদের জন্য প্রাণভরা ভালোবাসা শুভেচ্ছা নিয়ে কবি চীনে পাড়ি দেন ১৯২৪-এ। কবি সেদিন নানাভাবে চীনের জয় কামনা করেছিলেন। তিনি আশা ব্যক্ত করেছিলেন, অতীতের সাধনা যেমন ভারত ও চীনকে মৈত্রীর বাঁধনে বেঁধেছিল অদূর ভবিষ্যতেও সেই শক্তি দুই প্রতিবেশীকে প্রীতির বাঁধনে বাঁধবে। গত কয়েক দশকে ভারত-চীন সম্পর্কের তিক্ততা দেখে, আজ হলে, কবি কতটা ব্যথা পেতেন অনুমান করা শক্ত নয়। ভারত ও চীন দুই রাষ্ট্রের বিষয়টি নতুন করে ভাবা উচিত। হাংচৌ, সাংহাই, পিকিং, নানকিং প্রভৃতি শহরে কবির জন্য অনেকগুলি সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়। পিকিঙে অবস্থানকালে নির্বাসিত মাঞ্চু সম্রাট কবিকে তাঁর প্রাসাদে সাদর অভ্যর্থনা জানান। কবির হাতে উপহার হিসেবে সম্রাট তুলে দেন অমূল্য এক বুদ্ধমূর্তি—চীনের ইতিহাসে এক বিরল সম্মান প্রদর্শন। কবির চীন সফরকালে পড়ল ২৫ বৈশাখ, কবির জন্মদিন। ক্রিসেন্ট মুন সোসাইটি বিশেষ চৈনিক রীতিতে সেদিন তাঁর সম্মানে এক উৎসবের আয়োজন করে। বিশিষ্টজনেরা তাঁকে ভারত-চীন ঐক্যের প্রতীক হিসেবে উল্লেখসহ ‘চু-চেন-তান’ উপাধি প্রদান করেন।
বৌদ্ধ কালচারের প্রতি কবির অনুরাগ এতটাই গভীর ছিল যে, পৃথিবীর নানা প্রান্তের বৌদ্ধ পণ্ডিতদের শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতীতে শামিল করেছিলেন। যেমন ফ্রান্সের সিলভ্যাঁ লেভি, চীনের লিন ও-চিয়াং এবং রোমের জোসেপ তুচ্চি। লেভিই বিশ্বভারতীর প্রথম অতিথি অধ্যাপক। আচার্য লেভিরই আন্তরিকতায় বিশ্বভারতীতে চীনভবন প্রতিষ্ঠা-সহ বৌদ্ধশাস্ত্র গবেষণার ব্যবস্থা হয়। বলা বাহুল্য, ভারতীয় বৌদ্ধ পণ্ডিতও ছিলেন একাধিক।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করার মতো একটি তথ্য এই যে, কলকাতায় মহাবোধি সোসাইটি প্রতিষ্ঠার দু’বছর বাদে ১৮৯৩-তে শিকাগো বিশ্ব ধর্মমহাসভায় বৌদ্ধধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেন সিংহলের তরুণ অনাগারিক ধর্মপাল। সেখানেই স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের এই দুই তরুণ নেতার প্রীতির সম্পর্কের বিষয়টি কবিরও দৃষ্টি এড়ায়নি। ধর্মপাল কলকাতায় ফিরে বুদ্ধচেতনায় ভারতবাসীকে জাগাতে চেষ্টা করেন। বৈশাখী পূর্ণিমায় বুদ্ধ-জয়ন্তী পালনেরও উদ্যোগ নেন তিনি। বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ লেখেন তাঁর বিখ্যাত দু’টি গান—‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী’ এবং ‘সকল কলুষ-তামস হর’।
শুধু ধর্ম নয় রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তার ভিতরেও বুদ্ধের আদর্শের কোমল স্পর্শ ছিল। ভগবান বুদ্ধকে উদ্ধৃত করে কবি আমাদের সাবধান করে গিয়েছেন, বাহুবলের সাহায্যে ক্রোধ-প্রতিহিংসাকে জয়ী করে শান্তি মিলবে না। শান্তির উপায় হচ্ছে ক্ষমা। রাষ্ট্র ও সমাজনীতিতে এই জিনিস মানুষ যতদিন না স্বীকার করবে ততদিন অপরাধ বেড়ে চলবে। রাষ্ট্রগত বিরোধের আগুন নিভবে না। পৃথিবীর মর্মান্তিক পীড়া উত্তরোত্তর দুঃসহ হতে থাকবে। কোথাও এর শেষ পাওয়া যাবে না।
যুদ্ধক্লান্ত তৎকালীন ইউরোপ রবীন্দ্রনাথকে মানবপ্রেমিক আবিষ্কার করেছিল। কিন্তু সে ছিল রাজনীতির ক্ষেত্রে। পশ্চিমের মানুষ জানত না যে সাহিত্যক্ষেত্রেও তিনি সর্বাগ্রে মানবপ্রেমিক। আরও বিশদে বলা যায় যে তাঁর সমস্ত প্রেম ছিল জীবন ও মাটির পৃথিবীটার জন্য। স্বর্গের চাইতে মর্ত্যকে, পরলোকের চাইতে ইহলোককে এবং দেবতার চাইতে মানুষকেই বেশি মূল্য দিয়েছেন তিনি। এরপর বুঝতে অসুবিধা হয় না, সবাই যাঁকে ‘ভগবান’ বুদ্ধ বলেছেন, কবি কেন তাঁকে প্রণাম নিবেদন করতে গিয়ে অন্তরের সমস্ত শ্রদ্ধা ঢেলে ‘শ্রেষ্ঠ মানব’ বলে উল্লেখ করেছেন