০৬:২২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কুশলকর্মের মূল ভিত্তি দান-শীল-ভাবনা ও এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা

বৌদ্ধ ধর্ম মতে কুশলকর্মের মূল ভিত্তি তিন প্রকার, যথাঃ দান (পালি: অলোভ), শীল (পালি: অদোষ) ও ভাবনা (পালি: অমোহ) (Thera, 2013)। এই দান, শীল ও ভাবনা অনুশলীন কিভাবে মানুষকে সুখী করে তার বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমান উপস্থাপনের উদ্দেশ্যে এই নিবন্ধটির প্রয়াস।

প্রথমেই দেখা যাক দান, শীল ও ভাবনা কি?

দান, শীল ও ভাবনা’র নিম্নোক্ত বর্ণনা নারদ থের অনুদিত A Manual of Abhidhamma এবং Maung Tin অনুদিত The Expositor (Atthasālini) গ্রহ্নদ্বয় থেকে নেয়া হয়েছেঃ

দান (পালি: অলোভ)ঃ পদ্মপাতার মধ্যে জলের কণা পড়লে কণাটি যেমন পাতার মধ্যে লেগে না থেকে গড়িয়ে পড়ে যায়, তেমনি পরার্থপরতা বা দানশীলতা অনুশীলন করলে মনের মধ্যে তৃষ্ণা, লোভ বা লালসা রেখাপাত করবে না বা লেগে থাকবে না। সুতরাং ‘দান (অলোভ)’ এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তৃষ্ণা, লোভ বা লালসা মনের মধ্যে লেগে না থাকা এবং মানুষকে এসব খারাপ কাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা।

নিম্নে দানীয় চেতনা ও লোভের মধ্যে পার্থক্য উল্লেখ করা হলঃ

  • দানীয় চেতনা – অতিরিক্ত কোন কিছু অধিকারে নেওয়া থেকে বিরত রাখে। বিপরীতে, লোভনীয় চেতনা – প্রয়োজনের অতিরিক্ত অধিকারে নিতে প্রলুব্ধ করে।
  • দানীয় চেতনা – কেউ কোন ভূল করলে ভূলকে ভূল বিবেচনা করে এবং ভূলের স্বীকার করে। বিপরীতে, লোভনীয় চেতনা – ভূলকে গোপন করে।
  • দানীয় চেতনা – প্রিয়জনের বিচ্ছেদ হলে সহজে দুঃখ কাটিয়ে উঠা সম্ভব। বিপরীতে, মায়া-মমতা লোভনীয় চেতনার স্বভাবজাত ধর্ম, সেজন্য প্রিয়জনের বিচ্ছেদ হলে সহজে দুঃখ কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয় না।
  • দানীয় চেতনা  হল তৃষ্ণা, লোভ বা লালসার বিপরীত। সুতরাং দানীয় চেতনার কারনে পুনর্জম্ম নিরোধ হয় এবং দুঃখ মুক্তি হয়। বিপরীতে, তৃষ্ণা, লোভ বা লালসা লোভনীয় চেতনার স্বভাবজাত ধর্ম, সেজন্য পুনর্জম্মের কারণে মনের মধ্যে আবার দুঃখের উৎপত্তি হয়।
  • দানীয় চেতনার কারণে মানুষজন মিলেমিশে বসবাস করা পছন্দ করে।
  • দানীয় চেতনা কাম-লালসার প্রতি আকর্ষণকে হ্রাস করে।
  • দানীয় চেতনা স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী।
  • দানীয় চেতনার মাধ্যমে অর্জিত উদারতা প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ অর্জন করা থেকে বিরত থাকে।
  • দানীয় চেতনার গুন অর্জিত হলে তাদের অন্তর্দৃষ্টি সবকিছুকে অনিত্য হিসাবে দেখে, কিন্তু লোভী ব্যাক্তি তৃষ্ণার কারনে তার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে যে জিনিষ অনিত্য সেটা অনিত্য হিসাবে দেখতে পায় না।

শীল (পালি: অদোষ)ঃ  মনের মধ্যে সর্বদা দয়া বা মঙ্গল চিন্তা করলে ঘৃণা বা দোষ অপসৃত হবে। পালি adosa শব্দের একার্থ শব্দ হচ্ছে mettā বা মৈত্রী। সুতরাং সর্বদা মৈত্রী কামনা করা এই মানসিক গুনাবলীর প্রধান বৈশিষ্ট্য। মনের মধ্যে মৈত্রীভাব এর উন্নয়ন ঘটানোর জন্য ‘করণীয় মৈত্রী সূত্রে (Buddha’s Words on Loving-Kindness)’ উল্লেখিত নির্দেশনাবলী অনুশলীন করা যায়।  

  • শীল হচ্ছে পরম বন্ধুর মতো চঞ্চলহীন বা সন্তুষ্টিময়, এবং বিরক্তিভাবকে দমন। এ গুনের উদ্ভাস পূর্ণিমার মতো প্রেমময়।
  • শীল হল দুঃশীল বা অপবিত্রতা বা অশৌচ এর বিপরীত।
  • শীলবানরা পুণ্য কাজকে সম্মান করে কিন্তু দুঃশীলরা পূণ্য কাজকে অসম্মান করে।
  • শীলে অধিষ্টিত হলে অপ্রিয় বা অবিশ্বস্ত কেউ আশ্রয়ে আসলে কষ্ট বা দুঃখ অনুভূত হয় না, যেটা দুঃশীলদের হয়। কারন দুঃশীলদের স্বভাবজাত ধর্ম হচ্ছে অপ্রীতি এবং সাথে সাথে অপ্রিয় ব্যাক্তি বা জিনিষের সংশ্রব বহন করার অক্ষমতা।
  • শীলবানদের মনে বয়োঃবৃদ্ধির কারনে হতাশার জম্ম নেয় না কিন্তু দুঃশীলদের মনে জম্ম নেয়।
  • শীলবানদের কাম-লালসার প্রতি আকর্ষণের স্বেচ্ছায় অবসান ঘটে।
  • শীলবানদের মৈত্রীভাবের কারনে বন্ধুত্ব স্থাপন করা সহজ এবং বন্ধুত্বের এই বন্ধন স্থায়ী হয়, সহজে হারিয়ে যায় না। 
  • শীলবানরা যৌথকাজের অংশগ্রহনে খুশি হয় কারন তারা কারো প্রতি বৈরীভাব পোষন করে না।
  • শীলবানরা তাদের মৈত্রীভাবের কারনে অন্যের দুঃখভোগ অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখে, উদ্বিগ্ন হয়। বিষয়গুলিকে দুঃখজনক হিসাবে দেখে।

ভাবনা (Meditation, Pali: Amoha)ঃ অভিধর্মে প্রজ্ঞাকে অন্যভাবেও সম্বোধন করা হয়, যথাঃ জ্ঞান, পালি শব্দ ’অমোহ’ যার অপর অর্থ ‘ভাবনা’ বা ’প্রজ্ঞা’। প্রজ্ঞা অর্থ হল ‘যেটা জানা সেটা সঠিকভাবে জানা, অর্থাৎ অন্তর্ভেদী জ্ঞান’। অমোহ এর বিপরীত অর্থ হল নৈতিকতার অধঃপতন বা অনুন্নয়ন।

  • ভাবনা অনুশীলনকারীরা – যা পরিশুদ্ধ তা গ্রহন করে কিন্তু যারা ভাবনা অনুশীলন করে না তারা যা অপরিশুদ্ধ বা বিকৃত তা গ্রহন করে।
  • ভাবনা অনুশীলনকারীরা – যা সত্য তা স্বীকার করে কিন্তু যারা ভাবনা অনুশীলন করে না তারা সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য হিসাবে বিবেচনা করে।
  • ভাবনা অনুশীলনকারীরা – যা কিছু চায় যদি তা না পায় তাতে তারা দুঃখ পায় না কিন্তু কামনা-বাসনা যেহেতু যারা ভাবনা অনুশীলন করে না তাদের অন্তর্নিহিত স্বভাব তারা সবসময় কামনা-বাসনা পুরন করার চিন্তায় মগ্ন থাকে।
  • ভাবনা অনুশীলনকারীদের – মৃত্যু চিন্তার কারনে মনে দুঃখ সৃষ্টি হয় না কিন্তু যারা ভাবনা অনুশীলন করে না তাদের জন্য মৃত্যু চিন্তা একটি বিভীষিকাময়।
  • ভাবনা বা প্রজ্ঞা হল অজ্ঞতার বিপরীত।
  • ভাবনা অনুশীলনকারীরা – সবসময় মধ্যমপহ্না অনুশীলন করে।
  • ভাবনা অনুশীলনকারীরা – দীর্ঘায়ু প্রাপ্ত হয়।
  • ভাবনা অনুশীলন – ব্যাক্তিগত অর্জনের পক্ষে সহায়ক কিন্তু যারা ভাবনা অনুশীলন করে না তারা নিজের স্বার্থসিদ্ধি বা নিজের লাভের জন্য সবসময় চিন্তায় মগ্ন থাকে।
  • ভাবনা অনুশীলনকারীরা নিরপক্ষ দৃষ্টিকোন থেকে সবকিছু বিচার করে এবং যারা নিরপেক্ষ তাদেরকে পছন্দ করে কিন্তু যারা ভাবনা অনুশীলন করে না তারা পারে না।
  • ভাবনা অনুশীলনকারীদের অন্তর্দৃষ্টি প্রখর বিধায় তারা আত্মার অনুপস্থিতি বুঝতে পারে কিন্তু যারা ভাবনা অনুশীলন করে না তারা পারে না।

বৌদ্ধ ধর্মের আলোকে পশ্চিমা বিশ্বে বর্তমানে প্রচলিত বিভিন্ন ভাবনা করার পদ্ধতিসমূহ (Jared et el., 2017) ঃ

  • সমতা বা mindfulness meditation
  • বিদর্শন বা vipassana meditation
  • বিশ্লেষণধর্মী বা analytical meditation
  • শ্বাস-প্রশ্বাস গণনা বা breath counting: Zazen
  • শুধুমাত্র উপবেশন অবস্থায় বা just sitting: Zazen
  • ধাঁধাঁ বা প্রশ্ন-উত্তর ধরনের, জেন অনুসারীরা এই Koan পদ্ধতী অনুশীলন করে
  • মৈত্রী ভাবনা এবং করুণা বা loving kindness meditation and compassion meditation
  • Tonglen, তিব্বতীয়রা এই পদ্ধতী অনুশীলন করে। এটা অনেকটা দান, শীল, ধৈ্র্য বা সহনশীলতা, মনের উৎফুল্লতা, মনের একাগ্রতা ও প্রজ্ঞার অনুশীলনের মতো।
  • মহামুদ্রা বা nature of mind practice
  • বজ্রযানা পদ্ধতি বা vajrayana preliminary practices: ngondro
  •  কল্পনামূলক চিন্তার মাধ্যমে অনুশীলন বা visualization practices
  • মন্ত্র উচ্চারন বা শ্লোক জপের মাধ্যমে বা mantra recitation

 

বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা (Davidson, 2016)ঃ বিশিষ্ট আমেরিকান নিউরোসাইন্টিষ্ট এবং সেন্টার ফর হেলদি মাইন্ডস এট দি ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন, মেডিসন এর প্রতিষ্ঠাতা রিচার্ড জে ডেভিডসন ও তার দল গবেষনা করে পেয়েছেন যে, কেউ যদি মঙ্গল চিন্তা করার দক্ষতা অনুশীলন করে, তার জীবন উন্নত হয় এবং সুখী হয়। তারা গবেষনা করে সুখী হওয়ার জন্য চার ধরনের বৈশিষ্ট্য বের করেছেন, যথাঃ

১) বিরূপ পরিস্থিতি থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় প্রত্যাবর্তন (Resilience)ঃ যাহা বৌদ্ধ ধর্ম মতে ভাবনা অনুশীলনের মাধ্যমে মঙ্গল চিন্তার দক্ষতা অর্জন।

২) সর্বদা অপরের প্রতি কল্যাণমূখী মনোভাব বা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি (Outlook)ঃ যাহা বৌদ্ধ ধর্ম মতে শীল পরিপালনের মাধ্যমে মঙ্গল চিন্তার দক্ষতা অর্জন।

৩) সবসময় বর্তমান মূহুর্তের প্রতি মনোযোগ (Attention)ঃ যাহা বৌদ্ধ ধর্ম মতে ভাবনা অনুশীলনের মাধ্যমে মঙ্গল চিন্তার দক্ষতা অর্জন।

৪) উদারতা বা দানশীলতা (Generosity)ঃ যাহা বৌদ্ধ ধর্ম মতে দানীয় চেতনা অনুশীলনের মাধ্যমে মঙ্গল চিন্তার দক্ষতা অর্জন।

গবেষকরা তাদের পরীক্ষাগারে উপরোক্ত চারটি বৈশিষ্ট্যের প্রত্যেকটির জন্য ব্রেইনের নিউরাল সার্কিট পরীক্ষা করে পেয়েছেন যে, তাদের ব্রেইন নিউরোপ্লাস্টিসিটি প্রদর্শন করে। নিউরোপ্লাস্টিসিটি হল ব্রেইনের নিউরাল নেটওয়ার্ক এর সক্ষমতা, যার ফলে নিউরন এবং তাদের নেট্ওয়ার্কের বিকাশ ও পুনর্গঠন হয়। এই পরিবর্তনের ফলে প্রত্যেকটি নিউরন একটি আরেকটির সাথে নুতন নুতন সংযোগ সৃষ্টি করে। যার ফলে নুতন নুতন শেখা বা জানার পরিধি সম্প্রসারিত হয়। অর্থাৎ ব্রেইনের নুতন সক্ষমতা বা সুযোগ সৃষ্টি হয়। সুতরাং উপরোক্ত চারটি মানবিক গুনাবলীর নিয়মিত অনুশীলন ব্রেইনের সক্ষমতাকে আরো জোড়দার বা মজবুত করে এবং এই পরিবর্তন দীর্ঘস্থায়ী হয় ও সুখানুভব চিরস্থায়ী হয়।

১) বিরূপ পরিস্থিতি থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় প্রত্যাবর্তন (Resilience)ঃ যাহা বৌদ্ধ ধর্ম মতে ভাবনা অনুশীলনের মাধ্যমে মঙ্গল চিন্তার দক্ষতা অর্জন।

যারা দীর্ঘকাল ধরে ধ্যান বিশেষ করে বিদর্শন ভাবনা অনুশীলনে রত উদাহরনস্বরূপ কয়েক হাজার ঘন্টা ইতিমধ্যে অনুশীলন করেছেন তারা যদি কোন বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়ে তারা তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। যারা ধ্যান বা ভাবনা অনুশীলন করে না এই ধরনের পরিস্থিতিতে তাদের অনেক সময় লাগে। 

গবেষনায় এই সমস্ত ধ্যানীদের যারা বিরূপ পরিস্থিতি থেকে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে তাদের নিউরাল সার্কিট পরীক্ষা করার পর নির্দিষ্ট কিছু নিউরাল সার্কিটে উচ্চতর মঙ্গল চিন্তার প্রভাব দেখতে পেয়েছেন। সুতরাং তারা জীবনের বিরূপ পরিস্থিতির কর্মফল ভোগ থেকে অনেকটা সুরক্ষিত। গবেষনায় বলে এই দক্ষতা অর্জন অল্প কিছুদিন ভাবনা অনুশীলন করলে হবে না দরকার হবে দীর্ঘদিন ভাবনা অনুশীলন।

২) সর্বদা অপরের প্রতি কল্যাণমূখী মনোভাব বা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি (Outlook)ঃ যাহা বৌদ্ধ ধর্ম মতে শীল পরিপালনের মাধ্যমে মঙ্গল চিন্তার দক্ষতা অর্জন।

গবেষনায় প্রাপ্ত সুখের চার ধরনের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এই দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটি অভিধর্মে উল্লেখিত ৫২টি মানসিক স্তরের অন্যতম একটি মানসিক স্তর যাকে বলা হয় মুদিতা (Symphathetic joy, Pali: Mudita)। এটা নিছক সহানুভূতি নয় বরং প্রশংসাসূচক অভিব্যাক্তি বা আনন্দ। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল অন্যের সমৃদ্ধিতে খুশি বা সূখানুভব হওয়া এবং সবসময় অন্যের মঙ্গল কামনা করা। এ গুনাবলীর কারনে মনের ’বিরাগ’ বা ’অপছন্দ-করা’ দুর হয় এবং অভিনন্দনমূলক মনোভাব স্থায়ী হয়। এ গুনাবলী অর্জনের জন্য বুদ্ধের ’মৈত্রী ভাবনা’ সুত্রটি অনুসরনযোগ্য।

গবেষনায় প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা গেছে যারা মৈত্রী ভাবনা (lovingkindness) এবং করুণা ভাবনা (compassion meditation) অনুশীলন করে তাদের ব্রেইনের নিউরাল সার্কিট দ্রুত পরিবর্তন হয় এমনকি পরিমিতভাবে নিয়মিত উপরোক্ত ভাবনা অনুশীলন করলেও এই পরিবর্তন দেখা দেয়। গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, এই দ্বিতীয় (outlook) মানদন্ডটি অনুশীলন করলে প্রথম মানদন্ডটির (resilience) চেয়ে দ্রুত কা্র্যকরী ফল পাওয়া যায়।

তারা ২০১৩ সালে এই গবেষনাটি করেছেন। দুইটি দলের মধ্যে প্রথম দলকে করুণা ভাবনা বা compassion training এবং দ্বিতীয় দলটিকে cognitive therapy training (আবেগ নিয়ন্ত্রন পদ্ধতি) প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে মোট দুই সপ্তাহ অর্থাৎ মোট সাত ঘন্টা অনুশীলন করান। দুই সপ্তাহ পর তাদের ব্রেইন স্ক্যান করে দেখতে পেয়েছেন যে, প্রথম দলটি যারা compassion training করেছেন তাদের ব্রেইনের নিউরাল সার্কিট দুই সপ্তাহের আগের চেয়ে অধিক শক্তিশালী হয়েছে এবং ব্রেইনের এই পরিবর্তনের কারনে তাদের স্বভাবের মধ্যে অপরের প্রতি কল্যানমূলক মনোভাবও আরো শক্তিশালী হয়েছে। 

নিম্নে খারাপ চিন্তা ও ভাল চিন্তা করলে ব্রেইনের মধ্যে কি পরিবর্তন ঘটে তা বর্ণনা করা হল (Whitaker, Lou)ঃ

খারাপ বা অকুশল চিন্তা ভাল বা কুশল চিন্তা
উদ্বেগ, মানসিক চাপ ও রাগান্বিত অবস্থায় ব্রেইন অধিক পরিমান মেটাবলিক এনার্জি  prefrontal cortex থেকে নিয়ে নেয়, ফলে ব্রেইন স্বাভাবিক কাজ করতে পারে না ভাল চিন্তা করলে prefrontal cortex এর কা্র্যকারীতা বাড়িয়ে দেয়, ফলে ব্রেইনের স্বাভাবিক কাজ করার ক্ষমতা অধিক শক্তিশালী হয়
ব্রেইনের নিউরনের মধ্যে সমন্বয়সাধন হ্রাস করে  Synapses (যে স্থানে নিউরন একটির সাথে আরেকটি সংযুক্ত হয়) এর পরিমান দ্রুত গতিতে বাড়ে
চিন্তাধারার প্রক্রিয়া জটিলতর হয় এবং ফলে সমাধানে আসা কঠিন হয় চিন্তাধারার প্রক্রিয়া বৃদ্ধি পায়
সৃষ্টিশীল চিন্তার ক্ষমতা বাধাপ্রাপ্ত হয় মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা শক্তিশালী হয়
Cerebellum (ব্রেইনের যে অংশের মাধ্যমে আপনার শরীরের নড়াচড়া, ভারসাম্য, অঙ্গভঙ্গি, এবং সমন্বয়সাধন নিয়ন্ত্রিত হয়। নতুন গবেষনায় দেখা গেছে Cerebellum আপনার চিন্তাভাবনা, নতুন নতুন চিন্তা এবং আবেগও নিয়ন্ত্রন করে) এর কা্র্যকারীতা কমে যায় চিন্তা করার এবং তথ্য বিশ্লেষনের ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেয়
বাম temporal lobe এ (ভয় সৃষ্টি) খারাপ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, মেজাজ, স্মৃতি এবং আবেগ নিয়ন্ত্রনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ত্বড়িৎ গতিতে সমস্যার সমাধান করার ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেয় এবং সৃষ্টিশীল চিন্তাধারার উন্নয়ন ঘটায়

৩) সবসময় বর্তমান মূহুর্তের প্রতি মনোযোগ (Attention)ঃ সর্বদা একান্তভাবে মনোযোগের অনুশীলন অথবা বর্তমান মূহুর্তের (present moment) প্রতি মনোযোগ অর্থাৎ যা এখন করি তার প্রতি পূর্ণ মনোযোগ। অর্থাৎ অনেকটা বিদর্শন ভাবনার ন্যায়।

বিগত কয়েক বছর আগে হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক মনস্তত্ববিদদের একটি দল মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তিনটি প্রশ্ন নিয়ে একটি জরিপ করেন। এই জরিপটি হয়েছিল আমেরিকার প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেই। প্রশ্ন তিনটি হলঃ (ক) আপনি এখন কি করছেন? (খ) আপনার মন এখন কোথায়? আপনি এখন যা করছেন তার প্রতি আপনার পূর্ণ মনোযোগ আছে অথবা আপনার মন বিক্ষিপ্ত? (গ) এই মুহূর্তে আপনি সুখী আথবা অসুখী? উত্তরে তারা বলেছেন ৪৭% সময় তারা যা করছেন তার প্রতি মনোযোগ নাই। গবেষকরা বলেন বিশ্বে যদি এমনকি মোট কর্মঘন্টার ৫% সময়ও যদি অপচয় হয় তাহলে কি পরিমান উৎপাদনশীলতা কমে যাবে! আরেকটি বিষয় খুবই প্রনিধানযোগ্য, যে সময় তারা অমনোযোগী সেই সময়গুলোতে তারা অসুখী হিসাবে প্রকাশ করেছেন।

৪) উদারতা বা দানশীলতা (Generosity)ঃ যাহা বৌদ্ধ ধর্ম মতে দানীয় চেতনা অনুশীলনের মাধ্যমে মঙ্গল চিন্তার দক্ষতা অর্জন।

গবেষনায় দেখা গেছে যাদের মনোভাব উদারতা সম্পন্ন এবং শর্তহীনভাবে দানীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ তাদের ব্রেইনের নিউরাল সার্কিটও (ব্রেইনের যে নির্দিষ্ট স্থানের নিউরনগুলির মধ্যে মঙ্গল চিন্তার প্রকাশ ঘটে) কা্র্যকর দেখা গেছে। এই উদার মনোভাব বা দানীয় চেতনা অনুশীলনের মাধ্যমে মঙ্গল চিন্তার যদি দক্ষতা অর্জন করা যায় তাহলে সুখও দীর্ঘস্থায়ী হবে।

উপসংহারঃ গবেষনায় দেখা গেছে মানুষের সহজাত বা জম্মগত মৌলিক গুন হল সাধুচরিত্রের (innate to goodness)। গবেষকরা ছয় মাস বয়সের শিশুদের উপর গবেষনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। পরিবেশ ও সমাজ ব্যবস্থায় নিহিত প্রচলিত বিরূপ নিয়মগুলির কারনে এই মৌলিক সাধুচরিত্রটি অতলে হারিয়ে যায়। সুতরাং দান, শীল ও ভাবনা অনুশীলনই এই সাধুচরিত্রটিকে আবার জাগিয়ে তোলা যায় এবং যার মাধ্যমে মনের মধ্যে সুখের নীড় রচিত হবে। এই গবেষক দল আরো যোগ করেছেন যে, তারা এই গবেষনা কর্মটির মাধ্যমে নুতন ‍কিছু সৃষ্টি করে নাই। শুধুমাত্র তারা আগে থেকে বিদ্যমান ভাল গুনাবলীগুলিকে (বৌদ্ধ ধর্ম মতে ইহাকে দান-শীল-ভাবনা’র গুনাবলীই বোঝায়) গবেষনার মাধ্যমে স্বীকার করছেন এবং এগুলিকে আরো জোরদার ও লালন-পালন বা অনুশীলন করার জন্য উৎসাহ যোগাচ্ছেন। যাতে এই পৃথিবীর সকলেই সুখী হয়।

তথ্যসূত্রঃ 

শেয়ার করুন
আরও সংবাদ দেখুন

সৈয়দবাড়ী ধর্ম প্রবর্তন বৌদ্ধ বিহার দ্বিতীয় ভবনের দ্বারোদ্‌ঘাটন , কর্মবীর করুণাশ্রী থের’র “মহাথের বরণ” ১৯ , ২০ ডিসেম্বর

You cannot copy content of this page

কুশলকর্মের মূল ভিত্তি দান-শীল-ভাবনা ও এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা

আপডেট সময় ০৪:৪৫:৫১ অপরাহ্ন, শনিবার, ৪ মার্চ ২০২৩

বৌদ্ধ ধর্ম মতে কুশলকর্মের মূল ভিত্তি তিন প্রকার, যথাঃ দান (পালি: অলোভ), শীল (পালি: অদোষ) ও ভাবনা (পালি: অমোহ) (Thera, 2013)। এই দান, শীল ও ভাবনা অনুশলীন কিভাবে মানুষকে সুখী করে তার বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমান উপস্থাপনের উদ্দেশ্যে এই নিবন্ধটির প্রয়াস।

প্রথমেই দেখা যাক দান, শীল ও ভাবনা কি?

দান, শীল ও ভাবনা’র নিম্নোক্ত বর্ণনা নারদ থের অনুদিত A Manual of Abhidhamma এবং Maung Tin অনুদিত The Expositor (Atthasālini) গ্রহ্নদ্বয় থেকে নেয়া হয়েছেঃ

দান (পালি: অলোভ)ঃ পদ্মপাতার মধ্যে জলের কণা পড়লে কণাটি যেমন পাতার মধ্যে লেগে না থেকে গড়িয়ে পড়ে যায়, তেমনি পরার্থপরতা বা দানশীলতা অনুশীলন করলে মনের মধ্যে তৃষ্ণা, লোভ বা লালসা রেখাপাত করবে না বা লেগে থাকবে না। সুতরাং ‘দান (অলোভ)’ এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তৃষ্ণা, লোভ বা লালসা মনের মধ্যে লেগে না থাকা এবং মানুষকে এসব খারাপ কাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা।

নিম্নে দানীয় চেতনা ও লোভের মধ্যে পার্থক্য উল্লেখ করা হলঃ

  • দানীয় চেতনা – অতিরিক্ত কোন কিছু অধিকারে নেওয়া থেকে বিরত রাখে। বিপরীতে, লোভনীয় চেতনা – প্রয়োজনের অতিরিক্ত অধিকারে নিতে প্রলুব্ধ করে।
  • দানীয় চেতনা – কেউ কোন ভূল করলে ভূলকে ভূল বিবেচনা করে এবং ভূলের স্বীকার করে। বিপরীতে, লোভনীয় চেতনা – ভূলকে গোপন করে।
  • দানীয় চেতনা – প্রিয়জনের বিচ্ছেদ হলে সহজে দুঃখ কাটিয়ে উঠা সম্ভব। বিপরীতে, মায়া-মমতা লোভনীয় চেতনার স্বভাবজাত ধর্ম, সেজন্য প্রিয়জনের বিচ্ছেদ হলে সহজে দুঃখ কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয় না।
  • দানীয় চেতনা  হল তৃষ্ণা, লোভ বা লালসার বিপরীত। সুতরাং দানীয় চেতনার কারনে পুনর্জম্ম নিরোধ হয় এবং দুঃখ মুক্তি হয়। বিপরীতে, তৃষ্ণা, লোভ বা লালসা লোভনীয় চেতনার স্বভাবজাত ধর্ম, সেজন্য পুনর্জম্মের কারণে মনের মধ্যে আবার দুঃখের উৎপত্তি হয়।
  • দানীয় চেতনার কারণে মানুষজন মিলেমিশে বসবাস করা পছন্দ করে।
  • দানীয় চেতনা কাম-লালসার প্রতি আকর্ষণকে হ্রাস করে।
  • দানীয় চেতনা স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী।
  • দানীয় চেতনার মাধ্যমে অর্জিত উদারতা প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ অর্জন করা থেকে বিরত থাকে।
  • দানীয় চেতনার গুন অর্জিত হলে তাদের অন্তর্দৃষ্টি সবকিছুকে অনিত্য হিসাবে দেখে, কিন্তু লোভী ব্যাক্তি তৃষ্ণার কারনে তার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে যে জিনিষ অনিত্য সেটা অনিত্য হিসাবে দেখতে পায় না।

শীল (পালি: অদোষ)ঃ  মনের মধ্যে সর্বদা দয়া বা মঙ্গল চিন্তা করলে ঘৃণা বা দোষ অপসৃত হবে। পালি adosa শব্দের একার্থ শব্দ হচ্ছে mettā বা মৈত্রী। সুতরাং সর্বদা মৈত্রী কামনা করা এই মানসিক গুনাবলীর প্রধান বৈশিষ্ট্য। মনের মধ্যে মৈত্রীভাব এর উন্নয়ন ঘটানোর জন্য ‘করণীয় মৈত্রী সূত্রে (Buddha’s Words on Loving-Kindness)’ উল্লেখিত নির্দেশনাবলী অনুশলীন করা যায়।  

  • শীল হচ্ছে পরম বন্ধুর মতো চঞ্চলহীন বা সন্তুষ্টিময়, এবং বিরক্তিভাবকে দমন। এ গুনের উদ্ভাস পূর্ণিমার মতো প্রেমময়।
  • শীল হল দুঃশীল বা অপবিত্রতা বা অশৌচ এর বিপরীত।
  • শীলবানরা পুণ্য কাজকে সম্মান করে কিন্তু দুঃশীলরা পূণ্য কাজকে অসম্মান করে।
  • শীলে অধিষ্টিত হলে অপ্রিয় বা অবিশ্বস্ত কেউ আশ্রয়ে আসলে কষ্ট বা দুঃখ অনুভূত হয় না, যেটা দুঃশীলদের হয়। কারন দুঃশীলদের স্বভাবজাত ধর্ম হচ্ছে অপ্রীতি এবং সাথে সাথে অপ্রিয় ব্যাক্তি বা জিনিষের সংশ্রব বহন করার অক্ষমতা।
  • শীলবানদের মনে বয়োঃবৃদ্ধির কারনে হতাশার জম্ম নেয় না কিন্তু দুঃশীলদের মনে জম্ম নেয়।
  • শীলবানদের কাম-লালসার প্রতি আকর্ষণের স্বেচ্ছায় অবসান ঘটে।
  • শীলবানদের মৈত্রীভাবের কারনে বন্ধুত্ব স্থাপন করা সহজ এবং বন্ধুত্বের এই বন্ধন স্থায়ী হয়, সহজে হারিয়ে যায় না। 
  • শীলবানরা যৌথকাজের অংশগ্রহনে খুশি হয় কারন তারা কারো প্রতি বৈরীভাব পোষন করে না।
  • শীলবানরা তাদের মৈত্রীভাবের কারনে অন্যের দুঃখভোগ অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখে, উদ্বিগ্ন হয়। বিষয়গুলিকে দুঃখজনক হিসাবে দেখে।

ভাবনা (Meditation, Pali: Amoha)ঃ অভিধর্মে প্রজ্ঞাকে অন্যভাবেও সম্বোধন করা হয়, যথাঃ জ্ঞান, পালি শব্দ ’অমোহ’ যার অপর অর্থ ‘ভাবনা’ বা ’প্রজ্ঞা’। প্রজ্ঞা অর্থ হল ‘যেটা জানা সেটা সঠিকভাবে জানা, অর্থাৎ অন্তর্ভেদী জ্ঞান’। অমোহ এর বিপরীত অর্থ হল নৈতিকতার অধঃপতন বা অনুন্নয়ন।

  • ভাবনা অনুশীলনকারীরা – যা পরিশুদ্ধ তা গ্রহন করে কিন্তু যারা ভাবনা অনুশীলন করে না তারা যা অপরিশুদ্ধ বা বিকৃত তা গ্রহন করে।
  • ভাবনা অনুশীলনকারীরা – যা সত্য তা স্বীকার করে কিন্তু যারা ভাবনা অনুশীলন করে না তারা সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য হিসাবে বিবেচনা করে।
  • ভাবনা অনুশীলনকারীরা – যা কিছু চায় যদি তা না পায় তাতে তারা দুঃখ পায় না কিন্তু কামনা-বাসনা যেহেতু যারা ভাবনা অনুশীলন করে না তাদের অন্তর্নিহিত স্বভাব তারা সবসময় কামনা-বাসনা পুরন করার চিন্তায় মগ্ন থাকে।
  • ভাবনা অনুশীলনকারীদের – মৃত্যু চিন্তার কারনে মনে দুঃখ সৃষ্টি হয় না কিন্তু যারা ভাবনা অনুশীলন করে না তাদের জন্য মৃত্যু চিন্তা একটি বিভীষিকাময়।
  • ভাবনা বা প্রজ্ঞা হল অজ্ঞতার বিপরীত।
  • ভাবনা অনুশীলনকারীরা – সবসময় মধ্যমপহ্না অনুশীলন করে।
  • ভাবনা অনুশীলনকারীরা – দীর্ঘায়ু প্রাপ্ত হয়।
  • ভাবনা অনুশীলন – ব্যাক্তিগত অর্জনের পক্ষে সহায়ক কিন্তু যারা ভাবনা অনুশীলন করে না তারা নিজের স্বার্থসিদ্ধি বা নিজের লাভের জন্য সবসময় চিন্তায় মগ্ন থাকে।
  • ভাবনা অনুশীলনকারীরা নিরপক্ষ দৃষ্টিকোন থেকে সবকিছু বিচার করে এবং যারা নিরপেক্ষ তাদেরকে পছন্দ করে কিন্তু যারা ভাবনা অনুশীলন করে না তারা পারে না।
  • ভাবনা অনুশীলনকারীদের অন্তর্দৃষ্টি প্রখর বিধায় তারা আত্মার অনুপস্থিতি বুঝতে পারে কিন্তু যারা ভাবনা অনুশীলন করে না তারা পারে না।

বৌদ্ধ ধর্মের আলোকে পশ্চিমা বিশ্বে বর্তমানে প্রচলিত বিভিন্ন ভাবনা করার পদ্ধতিসমূহ (Jared et el., 2017) ঃ

  • সমতা বা mindfulness meditation
  • বিদর্শন বা vipassana meditation
  • বিশ্লেষণধর্মী বা analytical meditation
  • শ্বাস-প্রশ্বাস গণনা বা breath counting: Zazen
  • শুধুমাত্র উপবেশন অবস্থায় বা just sitting: Zazen
  • ধাঁধাঁ বা প্রশ্ন-উত্তর ধরনের, জেন অনুসারীরা এই Koan পদ্ধতী অনুশীলন করে
  • মৈত্রী ভাবনা এবং করুণা বা loving kindness meditation and compassion meditation
  • Tonglen, তিব্বতীয়রা এই পদ্ধতী অনুশীলন করে। এটা অনেকটা দান, শীল, ধৈ্র্য বা সহনশীলতা, মনের উৎফুল্লতা, মনের একাগ্রতা ও প্রজ্ঞার অনুশীলনের মতো।
  • মহামুদ্রা বা nature of mind practice
  • বজ্রযানা পদ্ধতি বা vajrayana preliminary practices: ngondro
  •  কল্পনামূলক চিন্তার মাধ্যমে অনুশীলন বা visualization practices
  • মন্ত্র উচ্চারন বা শ্লোক জপের মাধ্যমে বা mantra recitation

 

বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা (Davidson, 2016)ঃ বিশিষ্ট আমেরিকান নিউরোসাইন্টিষ্ট এবং সেন্টার ফর হেলদি মাইন্ডস এট দি ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন, মেডিসন এর প্রতিষ্ঠাতা রিচার্ড জে ডেভিডসন ও তার দল গবেষনা করে পেয়েছেন যে, কেউ যদি মঙ্গল চিন্তা করার দক্ষতা অনুশীলন করে, তার জীবন উন্নত হয় এবং সুখী হয়। তারা গবেষনা করে সুখী হওয়ার জন্য চার ধরনের বৈশিষ্ট্য বের করেছেন, যথাঃ

১) বিরূপ পরিস্থিতি থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় প্রত্যাবর্তন (Resilience)ঃ যাহা বৌদ্ধ ধর্ম মতে ভাবনা অনুশীলনের মাধ্যমে মঙ্গল চিন্তার দক্ষতা অর্জন।

২) সর্বদা অপরের প্রতি কল্যাণমূখী মনোভাব বা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি (Outlook)ঃ যাহা বৌদ্ধ ধর্ম মতে শীল পরিপালনের মাধ্যমে মঙ্গল চিন্তার দক্ষতা অর্জন।

৩) সবসময় বর্তমান মূহুর্তের প্রতি মনোযোগ (Attention)ঃ যাহা বৌদ্ধ ধর্ম মতে ভাবনা অনুশীলনের মাধ্যমে মঙ্গল চিন্তার দক্ষতা অর্জন।

৪) উদারতা বা দানশীলতা (Generosity)ঃ যাহা বৌদ্ধ ধর্ম মতে দানীয় চেতনা অনুশীলনের মাধ্যমে মঙ্গল চিন্তার দক্ষতা অর্জন।

গবেষকরা তাদের পরীক্ষাগারে উপরোক্ত চারটি বৈশিষ্ট্যের প্রত্যেকটির জন্য ব্রেইনের নিউরাল সার্কিট পরীক্ষা করে পেয়েছেন যে, তাদের ব্রেইন নিউরোপ্লাস্টিসিটি প্রদর্শন করে। নিউরোপ্লাস্টিসিটি হল ব্রেইনের নিউরাল নেটওয়ার্ক এর সক্ষমতা, যার ফলে নিউরন এবং তাদের নেট্ওয়ার্কের বিকাশ ও পুনর্গঠন হয়। এই পরিবর্তনের ফলে প্রত্যেকটি নিউরন একটি আরেকটির সাথে নুতন নুতন সংযোগ সৃষ্টি করে। যার ফলে নুতন নুতন শেখা বা জানার পরিধি সম্প্রসারিত হয়। অর্থাৎ ব্রেইনের নুতন সক্ষমতা বা সুযোগ সৃষ্টি হয়। সুতরাং উপরোক্ত চারটি মানবিক গুনাবলীর নিয়মিত অনুশীলন ব্রেইনের সক্ষমতাকে আরো জোড়দার বা মজবুত করে এবং এই পরিবর্তন দীর্ঘস্থায়ী হয় ও সুখানুভব চিরস্থায়ী হয়।

১) বিরূপ পরিস্থিতি থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় প্রত্যাবর্তন (Resilience)ঃ যাহা বৌদ্ধ ধর্ম মতে ভাবনা অনুশীলনের মাধ্যমে মঙ্গল চিন্তার দক্ষতা অর্জন।

যারা দীর্ঘকাল ধরে ধ্যান বিশেষ করে বিদর্শন ভাবনা অনুশীলনে রত উদাহরনস্বরূপ কয়েক হাজার ঘন্টা ইতিমধ্যে অনুশীলন করেছেন তারা যদি কোন বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়ে তারা তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। যারা ধ্যান বা ভাবনা অনুশীলন করে না এই ধরনের পরিস্থিতিতে তাদের অনেক সময় লাগে। 

গবেষনায় এই সমস্ত ধ্যানীদের যারা বিরূপ পরিস্থিতি থেকে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে তাদের নিউরাল সার্কিট পরীক্ষা করার পর নির্দিষ্ট কিছু নিউরাল সার্কিটে উচ্চতর মঙ্গল চিন্তার প্রভাব দেখতে পেয়েছেন। সুতরাং তারা জীবনের বিরূপ পরিস্থিতির কর্মফল ভোগ থেকে অনেকটা সুরক্ষিত। গবেষনায় বলে এই দক্ষতা অর্জন অল্প কিছুদিন ভাবনা অনুশীলন করলে হবে না দরকার হবে দীর্ঘদিন ভাবনা অনুশীলন।

২) সর্বদা অপরের প্রতি কল্যাণমূখী মনোভাব বা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি (Outlook)ঃ যাহা বৌদ্ধ ধর্ম মতে শীল পরিপালনের মাধ্যমে মঙ্গল চিন্তার দক্ষতা অর্জন।

গবেষনায় প্রাপ্ত সুখের চার ধরনের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এই দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটি অভিধর্মে উল্লেখিত ৫২টি মানসিক স্তরের অন্যতম একটি মানসিক স্তর যাকে বলা হয় মুদিতা (Symphathetic joy, Pali: Mudita)। এটা নিছক সহানুভূতি নয় বরং প্রশংসাসূচক অভিব্যাক্তি বা আনন্দ। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল অন্যের সমৃদ্ধিতে খুশি বা সূখানুভব হওয়া এবং সবসময় অন্যের মঙ্গল কামনা করা। এ গুনাবলীর কারনে মনের ’বিরাগ’ বা ’অপছন্দ-করা’ দুর হয় এবং অভিনন্দনমূলক মনোভাব স্থায়ী হয়। এ গুনাবলী অর্জনের জন্য বুদ্ধের ’মৈত্রী ভাবনা’ সুত্রটি অনুসরনযোগ্য।

গবেষনায় প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা গেছে যারা মৈত্রী ভাবনা (lovingkindness) এবং করুণা ভাবনা (compassion meditation) অনুশীলন করে তাদের ব্রেইনের নিউরাল সার্কিট দ্রুত পরিবর্তন হয় এমনকি পরিমিতভাবে নিয়মিত উপরোক্ত ভাবনা অনুশীলন করলেও এই পরিবর্তন দেখা দেয়। গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, এই দ্বিতীয় (outlook) মানদন্ডটি অনুশীলন করলে প্রথম মানদন্ডটির (resilience) চেয়ে দ্রুত কা্র্যকরী ফল পাওয়া যায়।

তারা ২০১৩ সালে এই গবেষনাটি করেছেন। দুইটি দলের মধ্যে প্রথম দলকে করুণা ভাবনা বা compassion training এবং দ্বিতীয় দলটিকে cognitive therapy training (আবেগ নিয়ন্ত্রন পদ্ধতি) প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে মোট দুই সপ্তাহ অর্থাৎ মোট সাত ঘন্টা অনুশীলন করান। দুই সপ্তাহ পর তাদের ব্রেইন স্ক্যান করে দেখতে পেয়েছেন যে, প্রথম দলটি যারা compassion training করেছেন তাদের ব্রেইনের নিউরাল সার্কিট দুই সপ্তাহের আগের চেয়ে অধিক শক্তিশালী হয়েছে এবং ব্রেইনের এই পরিবর্তনের কারনে তাদের স্বভাবের মধ্যে অপরের প্রতি কল্যানমূলক মনোভাবও আরো শক্তিশালী হয়েছে। 

নিম্নে খারাপ চিন্তা ও ভাল চিন্তা করলে ব্রেইনের মধ্যে কি পরিবর্তন ঘটে তা বর্ণনা করা হল (Whitaker, Lou)ঃ

খারাপ বা অকুশল চিন্তা ভাল বা কুশল চিন্তা
উদ্বেগ, মানসিক চাপ ও রাগান্বিত অবস্থায় ব্রেইন অধিক পরিমান মেটাবলিক এনার্জি  prefrontal cortex থেকে নিয়ে নেয়, ফলে ব্রেইন স্বাভাবিক কাজ করতে পারে না ভাল চিন্তা করলে prefrontal cortex এর কা্র্যকারীতা বাড়িয়ে দেয়, ফলে ব্রেইনের স্বাভাবিক কাজ করার ক্ষমতা অধিক শক্তিশালী হয়
ব্রেইনের নিউরনের মধ্যে সমন্বয়সাধন হ্রাস করে  Synapses (যে স্থানে নিউরন একটির সাথে আরেকটি সংযুক্ত হয়) এর পরিমান দ্রুত গতিতে বাড়ে
চিন্তাধারার প্রক্রিয়া জটিলতর হয় এবং ফলে সমাধানে আসা কঠিন হয় চিন্তাধারার প্রক্রিয়া বৃদ্ধি পায়
সৃষ্টিশীল চিন্তার ক্ষমতা বাধাপ্রাপ্ত হয় মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা শক্তিশালী হয়
Cerebellum (ব্রেইনের যে অংশের মাধ্যমে আপনার শরীরের নড়াচড়া, ভারসাম্য, অঙ্গভঙ্গি, এবং সমন্বয়সাধন নিয়ন্ত্রিত হয়। নতুন গবেষনায় দেখা গেছে Cerebellum আপনার চিন্তাভাবনা, নতুন নতুন চিন্তা এবং আবেগও নিয়ন্ত্রন করে) এর কা্র্যকারীতা কমে যায় চিন্তা করার এবং তথ্য বিশ্লেষনের ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেয়
বাম temporal lobe এ (ভয় সৃষ্টি) খারাপ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, মেজাজ, স্মৃতি এবং আবেগ নিয়ন্ত্রনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ত্বড়িৎ গতিতে সমস্যার সমাধান করার ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেয় এবং সৃষ্টিশীল চিন্তাধারার উন্নয়ন ঘটায়

৩) সবসময় বর্তমান মূহুর্তের প্রতি মনোযোগ (Attention)ঃ সর্বদা একান্তভাবে মনোযোগের অনুশীলন অথবা বর্তমান মূহুর্তের (present moment) প্রতি মনোযোগ অর্থাৎ যা এখন করি তার প্রতি পূর্ণ মনোযোগ। অর্থাৎ অনেকটা বিদর্শন ভাবনার ন্যায়।

বিগত কয়েক বছর আগে হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক মনস্তত্ববিদদের একটি দল মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তিনটি প্রশ্ন নিয়ে একটি জরিপ করেন। এই জরিপটি হয়েছিল আমেরিকার প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেই। প্রশ্ন তিনটি হলঃ (ক) আপনি এখন কি করছেন? (খ) আপনার মন এখন কোথায়? আপনি এখন যা করছেন তার প্রতি আপনার পূর্ণ মনোযোগ আছে অথবা আপনার মন বিক্ষিপ্ত? (গ) এই মুহূর্তে আপনি সুখী আথবা অসুখী? উত্তরে তারা বলেছেন ৪৭% সময় তারা যা করছেন তার প্রতি মনোযোগ নাই। গবেষকরা বলেন বিশ্বে যদি এমনকি মোট কর্মঘন্টার ৫% সময়ও যদি অপচয় হয় তাহলে কি পরিমান উৎপাদনশীলতা কমে যাবে! আরেকটি বিষয় খুবই প্রনিধানযোগ্য, যে সময় তারা অমনোযোগী সেই সময়গুলোতে তারা অসুখী হিসাবে প্রকাশ করেছেন।

৪) উদারতা বা দানশীলতা (Generosity)ঃ যাহা বৌদ্ধ ধর্ম মতে দানীয় চেতনা অনুশীলনের মাধ্যমে মঙ্গল চিন্তার দক্ষতা অর্জন।

গবেষনায় দেখা গেছে যাদের মনোভাব উদারতা সম্পন্ন এবং শর্তহীনভাবে দানীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ তাদের ব্রেইনের নিউরাল সার্কিটও (ব্রেইনের যে নির্দিষ্ট স্থানের নিউরনগুলির মধ্যে মঙ্গল চিন্তার প্রকাশ ঘটে) কা্র্যকর দেখা গেছে। এই উদার মনোভাব বা দানীয় চেতনা অনুশীলনের মাধ্যমে মঙ্গল চিন্তার যদি দক্ষতা অর্জন করা যায় তাহলে সুখও দীর্ঘস্থায়ী হবে।

উপসংহারঃ গবেষনায় দেখা গেছে মানুষের সহজাত বা জম্মগত মৌলিক গুন হল সাধুচরিত্রের (innate to goodness)। গবেষকরা ছয় মাস বয়সের শিশুদের উপর গবেষনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। পরিবেশ ও সমাজ ব্যবস্থায় নিহিত প্রচলিত বিরূপ নিয়মগুলির কারনে এই মৌলিক সাধুচরিত্রটি অতলে হারিয়ে যায়। সুতরাং দান, শীল ও ভাবনা অনুশীলনই এই সাধুচরিত্রটিকে আবার জাগিয়ে তোলা যায় এবং যার মাধ্যমে মনের মধ্যে সুখের নীড় রচিত হবে। এই গবেষক দল আরো যোগ করেছেন যে, তারা এই গবেষনা কর্মটির মাধ্যমে নুতন ‍কিছু সৃষ্টি করে নাই। শুধুমাত্র তারা আগে থেকে বিদ্যমান ভাল গুনাবলীগুলিকে (বৌদ্ধ ধর্ম মতে ইহাকে দান-শীল-ভাবনা’র গুনাবলীই বোঝায়) গবেষনার মাধ্যমে স্বীকার করছেন এবং এগুলিকে আরো জোরদার ও লালন-পালন বা অনুশীলন করার জন্য উৎসাহ যোগাচ্ছেন। যাতে এই পৃথিবীর সকলেই সুখী হয়।

তথ্যসূত্রঃ