০৩:৩৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২৫, ২৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মুক্তিযুদ্ধে বৌদ্ধদের অবদান

  • ড. জগন্নাথ বডুয়া
  • আপডেট সময় ০৪:০৪:০৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪
  • ৬৪৮ বার পড়া হয়েছে

বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতিসত্তা হিসেবে বৌদ্ধরা অতি প্রাচীন। ভারত-বাংলা উপমহাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিনির্মাণে বৌদ্ধদের অসামান্য অবদান রয়েছে। এদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামসহ প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামে বৌদ্ধদের গৌরবময় ইতিহাস লক্ষ্য করা যায়। এদেশের বৌদ্ধ স¤প্রদায় বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় সাহসী কর্মনির্মিতি ছিল অনন্য অসাধারণ। বাংলার ভূমিজ সন্তান হিসেবে বৌদ্ধরা দেশমাতৃকার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বৌদ্ধ সম্প্রদায় বলতে বাঙালি বডুয়া বৌদ্ধ, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর চাকমা, মারমা, রাখাইন,ম্রো, চাক, তনচঙ্গ্যা প্রভৃতি জনগোষ্ঠীকে বুঝায়। বৌদ্ধরা জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সকলেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং বীরত্বপূর্ণ ও সাহসী ভূমিকা পালন করেন। তাদের অনেকেই জীবন দিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষের উপর পাকবাহিনীর অতর্কিত বর্বরোচিত আক্রমণে এদশের মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকলেই অত্যাচার, নির্যাতিত, নিপীড়িত, ধর্ষণ ও নৃশংসভাবে নিহত হয়েছেন। ‘মুক্তিযুদ্ধে বৌদ্ধদের অবদান : চট্টগ্রামের অঞ্চল’ আলোচ্য প্রবন্ধে স্বাধীনতাকালীন বাঙালি বডুয়া বৌদ্ধদের অবদান, মুক্তিযুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ, শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম, বীরাঙ্গনাদের নাম এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সক্রিয় ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

স্বাধীনতা আন্দোলনে বৌদ্ধদের অংশগ্রহণ ও অবদান
বাংলাদেশের বৌদ্ধদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অত্যন্ত গৌরবময়। সাধারণভাবে ব্রিটিশ আমল থেকে বৌদ্ধরা বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনে যোগদান করে আসছে। অতীতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বৌদ্ধদের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। এতে উদীয়মান তরুণ ভূপেন্দ্রনাথ বডুয়া ও অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ বডুয়া প্রমুখ নেতৃবৃন্দ নির্যাতন ও কারাদন্ড ভোগ করেছেন। বিপ্লবী আন্দোলনে বৌদ্ধ যুবক স¤প্রদায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বিপ্লবী মহেশ বডুয়া, বিহারী বডুয়া, প্রকৃতি বডুয়া প্রমুখ অনেকে ব্রিটিশের কারাগারে তিলে তিলে আত্মদান করেছেন। তেজস্বী রোহিনী বডুয়া ফাঁসির কাষ্টে জীবনের জয়গান গেয়ে যান।
বৌদ্ধদের ইতিহাস বহু বলিষ্ট। বিশেষত বিপ্লব বিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ ও বিপ্লবে বৌদ্ধরা অংশ নিয়েছিল। সামরিক বাহিনীতে বৌদ্ধরা বিশেষ দক্ষতা দেখিয়েছিল। ইংরেজ রাজত্বের প্রারম্ভে বৌদ্ধরা দলে দলে সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। মগ প্লটনের সদস্যরা সমর কর্মকাÐে প্রশংসা কুঁড়িয়ে ছিল। প্রথমে বৌদ্ধরা ইংরেজদের সাথে অসহযোগিতার মনোভাব দেখালেও পরে, তারা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। হিন্দুদের সাথে সাথে বৌদ্ধরাও ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে ইংরেজদের নজরে আসে। ইংরেজরা বৌদ্ধদের শৌর্যবীর্যের কথা অবহিত হয়ে তাদেরকে সেনাবাহিনীতে চাকরি দেয়। বৌদ্ধ সৈনিকদের সমন্বয়ে ‘মগ পল্টন’ নামে পৃথক একটি সেনা দল সৃষ্টি করেন। মগ পল্টনের কয়েকজন বডুয়া সৈনিকের নাম ও পরিচয় হল: নারায়ণ সিং সুবেদার, পাহাড়তলী, মোহন সিং সুবেদার, পাহাড়তলী, কালাচান সুবেদার, পাহাড়তলী, দীপচান সুবেদার, জ্যৈষ্টপুরা, জয় সিং সুবেদার, আধাঁরমানিক, উদয়চান জমাদার বাহাদুর, বাঘখালি। ১৯৩০ সালে ভারতে সে সত্যাগ্রহ আন্দোলন হয় তাতে বৌদ্ধ যুবক ও ছাত্ররা অংশগ্রহণ করেছিলেন। ড. প্রণব কুমার বডুয়ার বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি বৌদ্ধ সম্প্রদায় গ্রন্থের প্রথম অনুচ্ছেদে লিখেছেন, সে সময় বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত ৫৫ জন বৌদ্ধ যুবক ও ছাত্রদের ঠিকানাসহ একটি তালিকা প্রদান করেছেন।
অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়ে অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ বডুয়া বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। চট্টগ্রামের পটিয়ার ছতরপুটিয়া গ্রামের এই ব্যক্তিত্ব কংগ্রেসের প্রথমসারীর নেতা ছিলেন। এছাড়া চট্টগ্রাম পটিয়ার মৈতলা গ্রামের মহেন্দ্র লাল (চন্দ্র) বডুয়া, ধীরেন্দ্র লাল বডুয়া, তরনী বডুয়া, চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার ভুপেন্দ্রনাথ মুৎসুদ্দী (ভুপেন গান্ধী), আবুরখীলের পুলিন বিহারী বডুয়া, এডভোকেট সারদা প্রসাদ বডুয়া, বাঁশখালীর রাস বিহারী বডুয়া, রাউজান গহিরার নগেন্দ্র লাল বডুয়া, রাউজানের নোয়াপাড়া গ্রামের প্রবীণ বডুয়া ও রাঙ্গুনিয়ার নীরদবরণ তালুকদার প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ অসহযোগ আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন।
নীরদ বরণ তালুকদার ও ভুপেন্দ্র নাথ বডুয়া তিন মাস কারাবরণ করেন। নীরদ বরণ তালুকদার পÐিচেরীতে ঋষি অরবিন্দের আশ্রমে যোগ দিয়ে শেষ জীবন মানবতার সেবায় উৎসর্গ করেন। বিপ্লবী কর্মধারায় প্রথম অংশ নেন আবুখীলের মতান্তরে নোয়াপাড়ার প্রবীন বডুয়া তিনি কয়েকবার কারাবরণ করেন, শেষে বার্মায় গমন করেন। জানা যায় নেতাজীর সাথেও তার যোগাযোগ ছিল। পটিয়া থানার মৈতলা গ্রামের সন্তান মহেন্দ্র লাল বডুয়া ছিলেন অন্যতম সাহসী বিপ্লবী সন্তান। অন্যান্য বিপ্লবীদের মধ্যে রোহিনী বডুয়া, জ্যেষ্ঠপুরার ধীরেন্দ্র লাল বডুয়া, সাতবাড়িয়ার মহেশ বডুয়া, পান্থশালার নীরেন্দ্র বডুয়া, বৈদ্যপাড়ার জীবক বডুয়া, মিস নিরুপমা বডুয়া, ফটিকছড়ির বডুয়া, নিরঞ্জন বডুয়া ফাঁসি মঞ্চে আত্মহুতি দেন। মহেশ বডুয়া ধীরেন্দ্র লাল বডুয়া কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। মাদ্রাজে নৌ বিদ্রোহ অংশগ্রহণকারীর বিপ্লবী নিরঞ্জন বডুয়া ফাঁসি হয়। মহেশ বডুয়া ও নীরেন্দ্র চৌধুরীর দীপান্তর হয়। উল্লেখ্য যে, মহামুনির তালতলা পাহাড়, আবুরখীলের জেতবন বিহার, শাকপুরার ধর্মানন্দ বিহার ছিল বিপ্লবীদের গোপন মিলন কেন্দ্র। অনেক বিপ্লবী আবুরখীলের আশ্রয় নিয়েছিল। সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অনেকে যোগদান করেন। তন্মোধ্যে বৈদ্যপাড়ার প্রেম প্রসাদ বডুয়া, কর্তালার প্রেমানন্দ চৌধুরী (গ্রামের পরিচয় জানা যায়নি) ছয়মাস কারাদÐ হয়। অন্যান্যদের মধ্যে হাশিমপুরের অধ্যাপক প্রকৃতি রঞ্জন বডুয়া, পূর্ণেন্দু তালুকদার, আবুরখীলের ড. বিনয় বডুয়া, রাউজানের ভূপেন্দ্র লাল বডুয়া, রাঙ্গুনিয়ার ড. অরুণ চন্দ্র বডুয়া। অধিকন্তু নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন আবুরখীলের খগেন্দ্র লাল বডুয়া, অজিত বডুয়া (শ্রদ্ধানন্দ ভিক্ষু)। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে অনেকেই বিপ্লবী কর্মধারার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন তন্মোধ্যে সংঘনায়ক শ্রীমৎ আনন্দ মিত্র মহাথের, মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের এবং শ্রীমৎ বঙ্গীশ ভিক্ষুর নাম উল্লেখযোগ্য। বৌদ্ধদের মধ্যে স্বদেশে সংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের এবং বিদেশে পন্ডিত জ্যোতিঃপাল মহাথের প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ রাষ্ট্র জাপান, থাইল্যান্ড, কোরিয়া, শ্রীলংকা, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশসমূহ সফরপূর্বক মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করেন।
বাংলাদেশের বিভাগের ফলে বৌদ্ধদের বিরাট অংশ পূর্ববঙ্গে রয়ে গেল। তাঁরা মাতৃভূমির সর্ববিধ উন্নতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করলেন। দেশের প্রশাসনিক ব্যাপারেও তাঁদের যোগ্য স্থান ছিল। কেউ কেউ রাজ্যসভা ও বিধানসভা সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন এবং মন্ত্রীপদে অধিষ্ঠিত হয়ে যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। দেশের সুখ দুঃখ সম্পদে বিপদে বৌদ্ধরা সমান অংশগ্রহণ করে যান। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষা আন্দোলনে বহু কৃতি ছাত্র ছাত্রী ও বুদ্ধিজীবি সহযোগিতা ও নেতৃত্ব দিয়ে ইহাকে সাফল্যমন্ডিত করেছেন।
১৯৭০ সালে নির্বাচনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ ছয় দফা দাবীর ভিত্তিতে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে এই দাবীগুলিতে অন্ধ সা¤প্রদায়িকতা ছিল না। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার স্বীকৃত হয়েছিল। সেই কারণে দেশের প্রগতিশীল বিরাট অংশ আওয়াগী লীগকে সমর্থন করেন। বাংলার বৌদ্ধেরাও এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। চট্টগ্রামের রাউজান থানা বৌদ্ধ প্রধান অঞ্চল। এখানে মুসলিম লীগের কিছু ব্যক্তিও আছেন তাঁরা মুসলীম লীগ সমর্থনের জন্য বৌদ্ধদেরকে নানাভাবে পরোচিত ও ভয় প্রদর্শন করতে থাকে। বৌদ্ধেরা দৃঢ়তার সাথে ইহার প্রতিবাদ করেন এবং প্রতি আওয়ামীলীগ সমর্থন করেন। ফলে নির্বাচনের প্রাক্কালে গুজরা নয়াপাড়ার কয়েকখানি বৌদ্ধ গ্রাম আক্রান্ত হয়। এই সংঘর্ষের ফলে দুইজন বৌদ্ধ নিহত ও কয়েকজন আহত হন। অপর পক্ষেও কিছু হতাহত হয়েছে। শেখ মুজিবর রহমানের কাছে এই সংবাদ পৌঁছলে তিনি সহসা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন এবং নয়াপাড়া উচ্চ ইংরেজি স্কুল মাঠে বিরাট জনসভায় ঘোষণা করেন যে, বাংলাদেশ শুধু মুসলমানের নয়, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানেরও নয়; বাংলাদেশ জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালির। নির্বাচনে বিপুল ভোটাধিক্যে আওয়ামী লীগপন্থীরা সর্বত্র জয় লাভ করেছেন। আর মুসলীম লীগপন্থীদের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। ইহাতে মুসলীম লীগপন্থীদের অমুসলিম বিদ্বেষ আরো বৃদ্ধি পায়।
২৫শে মার্চ ১৯৭১ সন হতে বাঙালিদের উপর যে জঙ্গীশাহী আক্রমণ হয়েছে, তাতে প্রথম জাতি ধর্ম নির্বিশেষে নিধন কার্য চালায়। পরে সুপরিকল্পিতভাবে হিন্দু বৌদ্ধ ও আওয়ামীলীগ সমর্থকদের ধ্বংস করা হয়েছে। অপ্রস্তুত অবস্থায় বহু সংখ্যক বাঙালি এই আক্রমণে হতাহত হয়েছে। মা বোন মাতৃজাতিরা ধর্ষিত ও লুন্ঠিত হয়েছেন। ইতিমধ্যে বাঙালিরা আত্মরক্ষার্থে মুক্তিবাহিনী গঠন করে পাক সৈন্যদের অগ্রগতি রোধ করেন। এই বাহিনীতে বৌদ্ধ তরুণ-তরুণীরা প্রচুর পরিমাণে যোগদান করেন। মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণের ফলে বাংলাদেশের বৃহত্তর অংশ এখন শত্রুর কবল মুক্ত হয়েছে।
মুক্তিবাহিনীকে প্রতিহত করার নিমিত্ত জঙ্গী নেতারা নির্বাচনে পরাজিত মুসলিম লীগের সহায়তায় সমাজ বিরোধী লোকদেরকে নিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠন করেছেন। তাদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া হয়েছে। এই রূপে বাঙালিদের মধ্যে পরস্পর বিভেদ সৃষ্টি করেছে জঙ্গীশাহীরা শাসন ও শোষণ অক্ষুন্ন রাখার পরিকল্পনা করেছেন। ফলে সাত মাসে প্রায় দেড় কোটি বাঙালি হতাহত ও শরণার্থীরূপে ভারতে আশ্রিত হয়েছেন। তথাকার সংখ্যালঘু স¤প্রদায়সমূহ একেবারে নিশ্চিহ্ন হবার উপক্রম হয়েছে। বহু গ্রামে ও মন্দিরের বিপন্ন হিন্দু মুসলমানদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে এবং সুযোগ মত নিরাপদ স্থানে প্রেরিত হয়েছে সেজন্য রাজাকার ও পাক সৈন্যের সম্মিলিত আক্রমণে বহু বৌদ্ধ গ্রাম ধ্বংস হয়েছে। চট্টগ্রাম পটিয়া থানার সাতবাড়িয়া গ্রাম ও শান্তি বিহার আক্রান্ত ও লুন্ঠিত হয়েছে। জোয়ারা, সুচিয়া প্রভৃতি গ্রামও লুণ্ঠিত হয়েছে। এই রূপে ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, রাঙ্গুনিয়া, পটিয়া, সাতকানিয়া, সীতাকুন্ড ও মিরেরশ্বরাই থানার বৌদ্ধ বিহার ও গ্রাম বিধ্বস্ত ও লুন্ঠিত হয়েছে। কক্সবাজার, রামু, উখিয়া, চকরিয়া হারবাং, মহেশখালির বিহারও আক্রাস্ত ও লুণ্ঠিত হয়েছে। বুদ্ধমূর্তি ভগ্ন করা হয়েছে। অষ্টধাতুর বড় বড় বুদ্ধমূর্তি চুর্ণ-বিচুর্ণ করে লুন্ঠিত হয়েছে। বহুধর্মগুরু ও নর-নারী হতাহত হয়েছেন। এই সংগ্রামে অন্তত পঁচিশ সহস্র বৌদ্ধ নিহত ও লক্ষাধিক প্রতিবেশি রাষ্ট্রে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন। যতই সময় যাচ্ছে সংখ্যালঘু বৌদ্ধরা প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে। তথাপি বৌদ্ধ তরুণগণ দলে দলে মুক্তি বাহিনীতে যোগদান করে মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার নিমিত্ত আত্মনিয়োগ করছেন। শরণার্থী রূপে ভারতে গিয়ে বহু বৌদ্ধ তরুণ পুন মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেছেন। বহু তরুণের সম্মুখ সংগ্রামে শত্রæ নিধন করে শহীদের গৌরব অর্জনের করেছেন। তথাপি বহু যোদ্ধা সংগ্রাম চালিয়েছেন অসীম সাহসে। অনেক স্বেচ্ছাসেবী তরুণ বীর সৈনিক রূপে মুক্তি সংগ্রামে প্রবেশ করেছেন।
ধর্মাধার মহাস্থবির উল্লেখ করেছেন, ‘চট্টগ্রামের সাতবাড়িয়া গ্রামের শান্তি বিহার পাক সৈন্যরা গত আগস্ট মাসে লুঠ করে বিহারের মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে যায় এবং বৌদ্ধদের ধর্মগুরু সংঘনায়ক শ্রদ্ধেয় অভয়তিষ্য মহাস্থবিরের উপর অকথ্য নির্যাতন চালায়। এই রকম ঘটনা বাংলাদেশে পাক জঙ্গীশাহীর আমলে শত শত ঘটিয়াছে।’ মুক্তিযুদ্ধ কালীন পÐিত ধর্মাধার মহাস্থবির লিখেছেন, বাংলাদেশের বিজয়ে বাঙালি হিসাবে আজ আমরাও গর্বিত এবং সেই দেশের আনন্দযজ্ঞে আমরাও অংশীদার কারণ এই যুদ্ধ শুধু যুদ্ধ জয় কিংবা রাজনৈতিক জয় না, ইহা জয় নয়; মানবিকতার জয়, গণতন্ত্রের জয়, স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রের জয়। তাই আমরা আনন্দিত। দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে পূর্ববঙ্গে অসহায় নিরীহ জনসাধারণের উপর পশ্চিম পাকিস্তানীদের ঘৃণ্য শোষণ আমাদের বার বার ব্যথিত করেছে। অসহায়ের মতো আমরা লক্ষ্য করেছি কেমন করে একটি প্রাণবন্ত জাতিকে নির্দয়ভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। তাই ২৫শে মার্চ পাঁচ জঙ্গী শাসনের নৃশংস অত্যাচারের পর বৌদ্ধরা সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছিল।
বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তি সংগ্রামীদের সঙ্গে। কলকাতায় বৌদ্ধদের মুখপত্র নালন্দার মাধ্যমে পাক শাসকদের বিরুদ্ধে ক্রোধ ও ঘৃণা এবং পূর্ববঙ্গের অসহায় নরনারীদের প্রতি সহানুভূতি জানিয়েছেন। নালন্দা পত্রিকার পঞ্চম বর্ষপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠানে এক প্রস্তাবে পূর্ববঙ্গের ইয়াহিয়া সরকার যে ধ্বংসলীলা চালায়া তার তীব্র নিন্দা করে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব উ থান্টকে ঐ নরমেধ যজ্ঞের অবসান ঘটাতে অনুরোধ করা হয় এবং বিভিন্ন বৌদ্ধ ও মিত্র রাষ্ট্রের প্রধানদের পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টির জন্য অনুরোধ করা হয়। তাছাড়া আগস্ট মাসে নয়াদিল­ীতে বাংলাদেশের সমস্যাসমূহ আলোচনা করার জন্য নিখিল ভারত বৌদ্ধ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য হতে প্রায় ৩০০জন প্রতিনিধি এই সম্মেলনে যোগদান করে বাংলাদেশের মুক্তিকামী সংগ্রামরত জনসাধারণের সমর্থনে এবং ইয়াহিয়া সরকারের জঘন্য বর্বরতার নিন্দা জ্ঞাপক পাঁচটি প্রস্তাব সভা সর্বস্মতিক্রমে গৃহীত হয়। বস্তুত বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম এপারের অগণিত বৌদ্ধদের প্রচন্ডভাবে উদ্দীপিত করেছে। তাই ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের সংবাদে এখানকার বৌদ্ধরা আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠেন। যুদ্ধের অব্যবহিত পরে থাইল্যাÐের ব্যাংকক শহরে আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ যুব সংঘের সমগ্র এশিয়ার বৌদ্ধদের উপর অত্যাচার এবং বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের বিরুদ্ধে একটি নিন্দাসূচক প্রস্তাব গৃহীত হয়। ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর নিরাপদ প্রত্যাবর্তন ও বাঙালি বৌদ্ধদের পক্ষ হতে তাঁকে অভিনন্দন জানানো হয়।
বাংলার মুক্তি সংগ্রামে হিন্দু মুসলমানের ন্যায়স্থানীয় বৌদ্ধদের ভূমিকা খুবই গৌরবজনক। গোড়ার দিকে প্রাক ফৌজ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে গণহত্যা চালিয়ে যায়। বৌদ্ধদেশ চীন পাকিস্তানের বন্ধু। চীন ও অপর বৌদ্ধদেশগুলো সৌহার্দ্য লাভের মানসে মাঝখানে পাক সৈন্যেরা বৌদ্ধদের ‘চাইনিস বুদ্ধিস্ট’ আখ্যা দিয়ে অত্যাচার হতে রেহাই দিতে চাইলে বৌদ্ধরা তার পুন সুযোগ গ্রহণ করলেন। প্রতিটি বৌদ্ধ গ্রাম বিপন্ন হিন্দু মুসলমানের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠল। এই সকল আশ্রয়স্থান হতে শরণার্থীদের সন্তর্পণে ভারতের দিকে প্রেরণ করা হয়। তাদের যাত্রাপথে মানিকছড়ির মানরাজ বাহাদুর সহস্র সহস্র শরণার্থী ও মুক্তিবাহনীর সেবার নিমিত্ত তার রাজকোষ উন্মুক্ত করে দেন। শরণার্থীরা নিরাপদে ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। বৌদ্ধ গ্রামগুলি মুক্তিবাহিনীর দুর্গে পরিণত হয়। এসব গ্রামে আত্মগোপন করে মুক্তিবাহিনী তাদের সংগ্রাম চালাতে থাকেন। দলে দলে বৌদ্ধ যুবক যুবতী মুক্তি বাহিনীতে যোগদান করে সংগ্রাম করেন। দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়ার পর্বতবেষ্টিত অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বৌদ্ধধর্মীয় নেতারা প্রত্যেক বৌদ্ধকে পরিচয় পত্র দেবার নির্দেশ দিলে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে লোককে সম্ভাব্য মৃত্যু হতে রক্ষার নিমিত্ত পরিচয়পত্র দিতে থাকেন। এই সুযোগে অনেক বৌদ্ধ পাক ফৌজের কোপ দৃষ্টি এড়িয়ে ভারতে চলে আসেন। দেশ দ্রোহীদের মাধ্যমে এই সংবাদ পাক সৈন্যদের নিকট পৌঁছলে আবার বৌদ্ধ গ্রামের উপর নিষ্ঠুর অত্যাচার চলতে থাকে। বহু ঘরবাড়ী ভস্মীভূত হয়, বৌদ্ধ বিহার লুণ্ঠিত ও ধ্বংস করা হয়। বহু বৌদ্ধ ও ধর্মগুরু হতাহত ও নিখোঁজ হন। কিন্তু এই অত্যাচার বেশিদিন চলতে পারেনি ততদিনে পূর্ব পাকিস্তানে পতন ঘটেছে।
শরণার্থী ও ভারতীয় বৌদ্ধদের পক্ষ হতে স্বাধীন বাংলার স্বীকৃতি ও সাহায্যের নিমিত্ত ব্যাপক আন্দোলন চালায়। ভারতে অবস্থিত বৌদ্ধদেশগুলির কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের মাধ্যমে বিশ্বের বৌদ্ধদেশগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। জাতিসংঘে দাবী করা হয়েছে। শরণার্থী বৌদ্ধ নেতা জ্যোতিঃপাল মহাথের প্রমুখ নেতৃবৃন্দ সিংহল, থাইল্যাণ্ড, জাপান, হংকং প্রভৃতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধদেশগুলোতে প্রচার কার্য চালিয়েছেন। এই প্রচারের ফলে সেই সকল দেশবাসীর মানবীয় বিবেক জাগ্রত হয়েছে। বাংলাদেশে নৃশংস হত্যাকান্ডের নিমিত্ত পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে জনগণ সোচ্চার হয়েছে এবং স্বাধীন বাংলার প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন। মুক্তি সংগ্রামের সকল বিভাগে বৌদ্ধরা সক্রিয় ছিলেন। দীপ্তশ পথ নেন জন্মভূমি শত্রু মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত এই সংগ্রাম করবেন। সকলের সমবেত প্রচেষ্টায় স্বাধীন বাংলা অচিরেই শত্রুমুক্ত হয়।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের বাঙালি বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অনন্য অসাধারণ ভূমিকা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল পাকসেনাদের দ্বারা অধিক আক্রান্ত। বিশেষ করে চট্টগ্রামের কালুরঘাট, কর্ণফুলি, চট্টগ্রাম সদর, হাটহাজারী, রাউজান, কাপ্তাই, পটিয়া, আজিজনগর, চকরিয়া, রামু, কক্সবাজার, টেকনাফ প্রভৃতি স্থানে পাকসেনারা বোমা নিক্ষেপ করে। বিভিন্ন জেলায় পাক বাহিনীর অতর্কিত নৃশংস আক্রমণে বৌদ্ধরা ব্যাপক নির্যাতিত, নিপীড়িত ও নিহত হয়েছেন। কোন কোন জেলায় সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের লোকেরা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ে ছিল। বৌদ্ধরাও পূর্ববঙ্গের বাংলাদেশের একটি সংখ্যালঘু স¤প্রদায়। তাঁরা প্রধানত বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, কুমিল্লা প্রভৃতি জেলায় বসবাস করেন।
পÐিত জ্যোতিঃপাল মহাথের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি ও ভয়াবহতা বিষয়ে ভারতের আগরতলায় ১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল সকাল ১০ টায় একটি জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলন করেন। সংবাদ সম্মেলনে বৌদ্ধ নেতৃবৃন্দ, ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা- শ্রী গোপাল ভূষণ চাকমাসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। এ সময় আকাশবাণী, আনন্দবাজার, যুগান্তর এবং অন্যান্য আঞ্চলিক গণমাধ্যমের সাংবাদিকগণ উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, “পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক বাঙালি বৌদ্ধদের উপর নৃশংস অত্যাচার, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যা পরিচালিত হয়। … পরবর্তীতে তিনি ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শ্রী শচীন্দ্র লাল সিংহ, অর্থমন্ত্রী শ্রী কৃষ্ণ দাস ভট্টাচার্য এবং মুখ্যসচিব ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে স্বাক্ষাৎকারে মক্তিযুদ্ধের দুঃখজনক ইতিহাস তুলে ধরেন। … এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে তিনি জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট, বিশ্ব বৌদ্ধ সৌভ্রতুত্ব সংস্থা-ব্যাংককের সভাপতি রাজপুত্র পুন-পিসমাই-দিসকুল এবং মহাসচিব মি. ইয়েম সংঘবাসী, শ্রীলংকার রাষ্ট্রপতি শ্রীমাভো বন্দর নায়েক, বিশ্ব বৌদ্ধ সৌভ্রাতৃত সংস্থার সকল আঞ্চলিক কেন্দ্র এবং বৌদ্ধ পরিষদে বাংলাদেশে নৃশংস গণহত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের রিপোর্ট প্রেরণ করেন।”
পণ্ডিত জ্যোতিঃপাল মহাথের উল্লেখ করেন যে, `Moveover, the last day I and Mr. K M Shahabuddin went to Parliament house to meet with Ministers and Members of the Parliament presented the exact scene about the success in freedom of occupied Bangladesh and made an application to stop the landing of Pakistani flight in Sinhala Airport. As a result, Srilankan Prime Minister Mrs. Bander Nayek to stop the landing of Pakistani flight in Colombo Airport. All directions such as north south, east west, and water-land-air were closed for Pak occupied force.`
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, পাক সৈন্যের আক্রমণে বৌদ্ধদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। চট্টগ্রাম ও ঢাকা শহরে জীবিকার নিমিত্তে অনেক বৌদ্ধ বাস করতেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ উচ্চ সরকারি-বেসরকারি চাকুরিজীবী, শিক্ষক, অধ্যাপক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, ব্যবসায়ি প্রভৃতি ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই পাক সেনার প্রথম আক্রমণে নিহত, আহত ও নিখোঁজ হয়েছেন। চট্টগ্রাম ও ঢাকার বৌদ্ধ বিহার লুন্ঠিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৌদ্ধদের অনেকের বাড়ি-ঘর ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ছিল। অনেকে পুরুষানুক্রমে শহরবাসী। তাঁদের বাড়ি-ঘর, দোকান-কারখানা লুন্ঠিত ও ভস্মীভূত হয়েছে। চট্টগ্রামের অনাথবাজার বৌদ্ধ বিহার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, একজন প্রসিদ্ধ ধর্মগুরু বোমার আঘাতে আহত হয়েছেন। চট্টগ্রাম শহরের নিকটবর্তী চাঁনগাঁও গ্রাম সুপ্রাচীন বৌদ্ধগ্রাম। এতে অনেক বৌদ্ধদের বাড়ি দুইটি বৌদ্ধ বিহার লুণ্ঠিত ও ভস্মীভূত হয়েছে, অনেকে নিহত হয়েছেন। ঐ গ্রাম জনশূন্য শ্মশানে পরিণত হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধকালীন  পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির লিখেছেন, হাটহাজারী থানার জোবরা গ্রাম পাক সেনাদের আক্রমণে বিপন্ন হয়েছে, বাড়ী ঘর লুণ্ঠিত ও এখানকার বিহারটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। গোলার আঘাতে কয়েকজন নিহত হয়েছেন। অবশিষ্টেরা পলাতক। এর দুই মাইল দূর মিরেরখীল গ্রামেও একই অবস্থা। মির্জাপুর এক বর্ধিষ্ণু বৌদ্ধগ্রাম। একদিন অবাঙালি একদল লোক তথাকার হিন্দুদের বাড়ী ঘর লুট করে বৌদ্ধদের বাড়ীঘর লুট করতে থাকে। তারা পুরাতন শান্তিধাম বিহারের শ্বেত পাথরের বুদ্ধমূর্তি ভেঙ্গে ফেলে। তরুণগণ প্রবল বাধা দিলে দুবৃত্তরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। কয়েক ঘণ্টা পরে তারা হাটহাজারী হতে পাক সেনাদের সঙ্গে নিয়ে পুনরায় আক্রমণ করে। সৈন্যরা বিহারের একটি ঘর জ্বালিয়ে দেয়। এই সময় একজন প্রৌঢ় তথায় এসে তাদেরকে অনুরোধ করেন যে, তাঁরা পাকিস্তানের অনুগত প্রজা, তাঁদের উপর এই অত্যাচার কেন? বার্মার প্রধানমন্ত্রী উ. নূর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের এক বাঁধানো ছবি প্রদর্শন করেন। ইহাতে সৈন্যরা সন্তুষ্ট হন এবং বৌদ্ধদের উপর অত্যাচার না করার জন্য অবাঙালিদের নির্দেশ দেন। তখন হতে বৌদ্ধদের নিরাতঙ্কে থাকার আশ্বাস দিয়ে যান কিন্তু তার চার দিন পরে একদিন হঠাৎ সৈন্যসহ তারা গ্রামে লুঠতরাজ রাউজান থানার গহিরা গ্রামের লুম্বিনী কানন বিহার পাক বোমায় ধ্বংস হয়েছে। রাঙ্গামাটি রোডের দুই পার্শ্বে বৌদ্ধদের বহু বাড়ি-ঘর ভস্মীভূত হয়েছে। কয়েকজন লোক মেশিন গানের গোলায় আহত ও নিহত হয়েছেন। পার্শ্ববর্তী বরজ্ঞান বিহার আক্রান্ত হয়েছে। বুদ্ধমূর্তিভগ্ন ও ভিক্ষুর উপর আঘাত করেছে, ভিক্ষু ও গৃহীগণ গ্রাম ত্যাগ করেছেন। এই সুযোগে মুসলিমলীগপন্থীরা বৌদ্ধদের গৃহপালিত পশুপাক্ষী ধান চাউল তৈজস পত্র লুঠ করেছেন, অনেক গৃহ জ্বালিয়ে দিয়েছেন। বিনাজুরী বিশিষ্ট বৌদ্ধ গ্রাম। নিঃস্ব হিন্দুদেরকে আশ্রয় দেওয়ায় তারা মুসলিমলীগপন্থীদের বিদ্বেষভাজন হন। তথাকার বিহার ও গৃহ আক্রান্ত হয়। রাউজানের আবুরখীলেরও একই অবস্থা।
হোয়ারাপাড়া সুদর্শন বিহার লুণ্ঠিত বুদ্ধমূর্তি ভেঙ্গে ফেলা হয়। বুদ্ধের পুতাস্থি অপহৃত হয়েছে। মহামুনি পাহাড়তলী গ্রামের পার্শ্বে কলেজে পাক সেনারা ঘাটি করেছে। গ্রামবাসী নির্যাতিত সতত সন্ত্রস্ত। একজন শিক্ষিত তরুণ ভিক্ষু পাক বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়। অনেক শিক্ষিত তরুণ ও বুদ্ধিজীবী দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়। পার্শ্ববর্তী রাঙ্গুনিয়ার সৈয়দবাড়ি, ইছামতি ও নজরের টিলার অনেক ঘর লুন্ঠিত ও ভস্মীভূত হয়েছে। লোকজন পাহাড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে। বোয়ালখালি থানার শাকপুরা গ্রামে দুইজন শিক্ষিত বৌদ্ধকে বিহারের বুদ্ধমূর্তির সম্মুখে হত্যা করা হয়। লোকের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়। পটিয়া, সাতকানিয়া থানার বহু শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত লোক হতাহত ও নিরুদ্দিষ্ট হয়েছেন। দক্ষিণ চট্টগ্রামের কক্সবাজার, রামু ও উখিয়া পালং অঞ্চলের অনেক বৌদ্ধ নিহত, গ্রাম লুণ্ঠিত ও ভস্মীভূত হয়েছে। প্রায় বিশ হাজার বাঙালি বৌদ্ধ আরাকানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তথায় মানবোচিত সৌজন্য অভাবে কিছু সংখ্যক ফিরে আসতে বাধ্য হন, কিন্তু স্থানীয় মুসলিম লীগের অত্যাচারে আবার তারা বাস্তুচ্যুত হন।
পন্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির লিখেছেন, ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডের পার্শ্বে সীতাকুন্ড, বারবকুন্ড কাঠগড় ও পান্থশালা গ্রাম আক্রান্ত ও ভস্মীভূত হয়। গ্রাম ছেড়ে লোকজন পালিয়ে যান। মিরেরশ্বরাই থানার জোরারগঞ্জ ধ্বংস হয়। এখানে নারী নির্যাতনে অসম্মত বালুচ সৈন্যের সাথে পাঞ্জাবিদের সংঘর্ষ হয়। উভয় পক্ষে গুলি বিনিময় হয়। নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলার ১৮/২০ টি গ্রাম বিহারসহ আক্রান্ত হয়েছে। বহুলোক হতাহত, ভিক্ষুরা নির্যাতিত। অবশিষ্ট সহস্র লোক কোন প্রকারে প্রাণ নিয়ে ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। ঐ দুই জেলা একেবারে বৌদ্ধশূন্য হয়েছে। বরিশালে আদিবাসী রাখাইন বৌদ্ধদের উপর ভীষণ অত্যাচার-নির্যাতন করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা বৌদ্ধ প্রধান অঞ্চল। এর শতকরা ৯৭ ভাগ বৌদ্ধ ছিল। ইহার তিন পার্বত্য জেলায় তিনজন বৌদ্ধ রাজা রাজত্ব করেন। উত্তরে রামগড়ের মানরাজা পাকসেনার আক্রমণে ৬/৭ সহস্র উপজাতীয় প্রজাসহ ত্রিপুরায় শরণার্থী হয়েছেন। তাঁর রাজধানী মানিকছড়ি পাক সৈন্য অধিকার করেছেন। কিন্তু সামরিক কর্তৃপক্ষ চাকমা রাজাকে প্রলোভনে ভুলিয়ে প্রাক সামরিক তৎপরতা সমর্থন করান। দক্ষিণে বান্দরবানের বোমাং রাজা-প্রজা প্রায় পঞ্চাশ সহস্রের মত আরাকানে ও ভারেতে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন। পাক সৈন্যদের অমানুষিক অত্যাচারে পূর্ববঙ্গের প্রায় লক্ষাধিক বৌদ্ধ হত, আহত নিরুদ্দিষ্ট ও পলাতক হয়েছেন। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের ওপর এই আক্রমণ চললেও সংখ্যালঘু বৌদ্ধ সমাজের অস্তিত্ব ভীষণভাবে বিপন্ন হয়েছে। কক্সবাজার জেলার বৌদ্ধরা মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন ভাবে আক্রমণের স্বীকার হয়েছেন। অনেক বৌদ্ধ বাড়ি ও বিহারে পাকসেনারা আক্রমণ করেছে; বৌদ্ধ নারী-পুরুষ নির্যাতিত হন। এ সময় চকরিয়া, রামু, উখিয়া, মহেশখালী অঞ্চলের বহু বডুয়া ও রাখাইন বৌদ্ধ সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ করেন আবার অনেকে নির্যাতনের ফলে ছেলে-মেয়ে-স্ত্রীসহ প্রাণভয়ে ব্রহ্ম দেশে আশ্রয় গ্রহণ করে।
সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা মূলত দুইটি দলে বিভক্ত ছিল। একটা হল এফ এফ (ফ্রীডম ফাইটার) মুক্তিবাহিনী, যারা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রাধীন এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানীর অনুগত বাহিনী আর অন্যটি হল বিএলএফ (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স) মুজিববাহিনী নামে পরিচিত। ড. প্রণব কুমার বডুয়ার মতে, মুক্তিযোদ্ধা চার প্রকারের-(ক) যারা ট্রেনিং নিয়ে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিল, (খ) যারা দেশের অভ্যন্তরে থেকে ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছিল, (গ) যারা অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল, (ঘ) যারা ভারতে আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপক্ষে মতামত সংগ্রহ এবং কাজ করেছিল। সে হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা অনেক। তবে বিশিষ্ট কয়েকজনের কথা এখানে উল্লেখ করা হলো- বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে রাউজান থানার লাঠিছড়ির নৃপেন্দ্র লাল বডুয়া (সম্মুখ যুদ্ধের অপারেশন এলাকা নোয়াখালী ও মিরেরসরাই), ডাবুয়ার অনিল বডুয়া (সম্মুখ যোদ্ধা), বাগেয়ানের জিনু বডুয়া, আবুরখীলের বোধিপাল বডুয়া (ফেনী বর্ডারের কাজ করতেন) ও নীতিশ বডুয়া (ইস্টার্ণ সেক্টরে মুজিব বাহিনীর প্রধান আব্দুর রবের নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছেন), মিরেরসরাইয়ের বীর সিন্ধু বডুয়া (লে: রফিকের অধীনে যুদ্ধ করেন) ও সুকুমার বডুয়া (১নং সেক্টরের প্লাটুন কমাÐার শরফুউদ্দীনের সাথে যুদ্ধ করেন) সুরঙ্গ গ্রামের ফণীন্দ্র লাল বডুয়া, সুনীল বডুয়া, বিপতী বডুয়া, হিঙ্গলার স্বপন বডুয়া, প্রদীপ বডুয়া, রাউজানের সন্তোষ বডুয়া সকলেই সম্মুখ যোদ্ধা ছিল এবং মেজর ছোবাহানের অধীনে যুদ্ধ করেন আনন্দ বডুয়া, ক্যাপ্টেন সুজিত আলী, সুযুর সিং গুলিয়া, লে: কর্ণেল কে কুমারের অধীনে সিলেটে যুদ্ধ করে। এছাড়া জোবরার মতিলাল বডুয়া, গহিরার সুমঙ্গল বডুয়া, খৈয়াখালীর বীরেন্দ্র লাল বডুয়া, আব্দুল্লাহপুরের সম্বোধি প্রসাদ বডুয়া, বিপুল বডুয়া, কোঠেরপাড়ের ভারত বডুয়া, পদুয়ার অমিয় বডুয়া ও কল্যাণমিত্র বডুয়া, রাউজান থানায় এফ এফ  গ্রুপ কমান্ডার আহসান উল্লাহ চৌধুরী এর অধীনে আলোজ্যোতি বডুয়া; এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার মোহাম্মদ হাশেম এর অধীনে সুনীল বডুয়া; এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার প্রভাকর বডুয়া। বোয়ালখালী থানার এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার মো. মাহাবুবুল আলম, সদস্য শ্রীপুরের প্রশান্ত বডুয়া, জ্যেষ্ঠপুরার খোকা বডুয়া; বি এল এফ গ্রুপ কমান্ডার রাজেন্দ্র প্রসাদ চৌধুরী, সদস্য গোমরদন্ডীর শরৎ বডুয়া; ক্যাপ্টেন করিম এর নেতৃত্বাধীন গ্রুপ কমান্ডার ডা. অমল বডুয়া, বৈদ্যপাড়ার সুকুমার বডুয়া চৌধুরী বাবুল, সারোয়াতলীর বিন্দু বডুয়া, রাউজান পাহাড়তলীর জগদানন্দ বডুয়া ও জীবনানন্দ বডুয়া, সুবর্ণ ভদ্র মুৎসুদ্দি, রনজিত বডুয়া। রাঙ্গুনিয়া থানায় বি এল এফ গ্রæপ কমাÐার সালেহ আহমদ এর অধীনে সদস্য সুজন বডুয়া; এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার খোদাবক্স- প্লাটুন কমান্ডার পদুয়ার অমিয় বডুয়া, সদস্য মরিয়ম নগরের রাজু বডুয়া ও সুধন বডুয়া, পারুয়ার কেপু বডুয়া, পদুয়ার স্বপন বডুয়া এবং সুদত্ত বডুয়া।
পটিয়া থানার ১৯৭০ সালে এমপি ও সংগঠক সুলতান আহমদ কুসুমপুরীর উদ্যোগে গঠিত বাহিনীতে ছিলেন ‘এ’ কোম্পানী, প্লাটুন  কমান্ডার হাবিলদার আবুল হোসেন সদস্য সাতকানিয়ার সাধন বডুয়া; ‘বি’ কোম্পানী, প্লাটুন  কমান্ডার হাবিলদার সুজায়েত হোসেন সদস্য পরেশ বডুয়া, এফ এফ গ্রুপ লিডার আবদুল লতিফ হাবিলদার, সদস্য অমিয় বডুয়া, অনিল বডুয়া, মিলন বডুয়া, দুলাল বডুয়া, রাজমোহন বডুয়া; এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার শাহ আলম, সদস্য সুজিত বডুয়া, সুরক্ষিত বডুয়া, প্রিয়তোষ বডুয়া; এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার আবু ছৈয়দ, সদস্য সুনক্ত বডুয়া; এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার সিরু বাঙ্গালী, সদস্য হুলাইন এর মানবেন্দ্র বডুয়া মানু, ঠেগরপুনির তাপস রঞ্জন বডুয়া। সাতকানিয়া থানার এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার আবু তাহের খান খসরু সদস্য সাতকানিয়ার জামিজুরির অনিল বডুয়া ও সাধন বডুয়া, মানিক বডুয়া, মৃণাল বডুয়া; এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার আ ক ম শাসুজ্জামান সদস্য সাতকানিয়ার মুক্তিমান বডুয়া, মনোজ বডুয়া, রতন কুমার বডুয়া প্রমুখ।
ফটিকছড়ির এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার মো. নুরুল গণির অধীনে সদস্য চাঁন্দু বডুয়া; এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার শেখ আবু আহমদ এর অধীনে সদস্য নানুপরের বাবুল বডুয়া, পাইন্দং এর সুনীল বডুয়া; গ্রুপ কমান্ডার তপন দত্ত এর অধীনে নেপাল বডুয়া, নাথুরাম বডুয়া, নরেশ বডুয়া, প্রকাশ বডুয়া, এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার ভারত বডুয়া প্রমুখ। সিতাকুন্ড পান্থশালার মানিক লাল বডুয়া, কুমিল্লা নোয়াখালির সোনাইমুড়ির ডিআইজি এস কে চৌধুরী, কক্সবাজারের উখিয়ার সুরক্ষিত বডুয়া, অমিয় কুমার বডুয়া, রামুর মাস্টার জ্ঞানেন্দ্র বডুয়া, দীপক কুমার বডুয়া, পরেশ বডুয়া, চকরিয়ার পরিমল বডুয়া, লোকনাথ বডুয়া, সাংবাদিক প্রিয়দর্শী বডুয়া প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম অগ্রগণ্য। বলা প্রয়োজন তাছাড়া আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছে যারা ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। গ্রাম ও অঞ্চলভিত্তিক মুক্তিযোদ্ধাদের নাম সংগ্রহ করে প্রকাশ করা এবং তাঁদের অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বহু বৌদ্ধ চাকুরিজীবী নিখোঁজ বৌদ্ধদের একটি তালিকা মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের তদানিন্তন সামরিক কর্মকর্তাদের কাছে পেশ করেছিলেন এবং তাদের উদ্ধারের জন্য আবেদন জানিয়ে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তাদের সংখ্যা ৪০ এর কাছাকাছি হবে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রাউজানের সুপতি রঞ্জন বডুয়া এম.এ (অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পাকিস্তান রেলওয়ে), চিত্তরঞ্জন বডুয়া (স্টোনো রেলওয়ে জামুয়াইন), ননী গোপাল বডুয়া এম.এ (আয়কর উকিল, লাখেরা), প্রকৌশলী প্রভাষ কুসুম বডুয়া এম.এ (লাখেরা), ইছামতি রাঙ্গুনিয়ার চিত্তরঞ্জন বডুয়া (সুপার টি এÐ টি, জোয়ারা) সে সময় টি এণ্ড টিতে যে সমস্ত বৌদ্ধ চাকুরি করতেন তারা অনেকেই নিখোঁজ হয় তাছাড়া বন্দরেরও অনেক বৌদ্ধ চাকুরিজীবী নিখোঁজ হয়।
মুক্তিযুদ্ধে বৌদ্ধ সমাজের প্রতিরোধ আন্দোলন ও ক্ষয়ক্ষতি সাধন
মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতি সাহস ও ঐক্যের মাধ্যমে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান জাতিবর্ণ নির্বিশেষে সবাই মিলেমিশে সেদিন পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, জীবন দিয়েছে স্বাধীনতার জন্য।
বাংলাদেশে জনসংখ্যার ক্ষেত্রে বৌদ্ধরা খুবই স্বল্প। তা সত্তে¡ও স্বাধিকার আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বৃহত্তর জনগোষ্ঠির সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বৌদ্ধ জনগণও নিঃস্বার্থভাবে দেশ ও জাতির স্বার্থে কাজ করেছে। সাম্যবাদী ও জাতীয়াতাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে বৌদ্ধরা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৌদ্ধরা পালন করেছে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা। ধর্মীয় বিষয়ানুভূতিতে নয়; মাতৃভূমিকে ভালবেসে বাঙালি বৌদ্ধসমাজ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো। কেউ অস্ত্র হাতে রণাঙ্গণে যুদ্ধ করেছে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে, কেউ সংগঠক হিসেবে কাজ করেছে, কেউ প্রবাসী সরকারের কর্মকর্তা হিসাবে কাজ করেছেন, কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের ও শরণার্থীদের আশ্রয়, সাহায্য দিয়েছে কিংবা সক্রিয় যুুদ্ধে অংশ নিয়েছে। বৌদ্ধরাও জীবন দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে, ইজ্জত দিয়েছে, ধন-সম্পদ হারিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তাদের মঠ, মন্দির, বিহার, চৈত্য। সে হিসেবে বৌদ্ধদের ত্যাগ তিতীক্ষা ও অবদান কম নয়।
পণ্ডিত জ্যোতিঃপাল মহাথেরকে বাংলাদেশের তথ্য মন্ত্রণালয় মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক বৌদ্ধদের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার বিবরণ প্রস্তুত করার জন্য আহŸান জানান। তিনি উল্লেখ করেন যে, ‘তদন্তের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বৌদ্ধ গ্রাম সীতাকুন্ড ও মিরেরসরাই থানা পরিদর্শন এবং তথ্য সংগ্রহ করেন। দ্বিতীয় পদক্ষেপ হিসেবে কুমিল্লা, নোয়াখালী, সোনাইমুড়ি ও অন্যান্য গ্রামের মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের নাম ও ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ি-ঘর, বৌদ্ধ বিহার, বুদ্ধমূর্তির ছবি সংগ্রহ করেন। এই ক্ষয়ক্ষতি ও আর্থিক মূল্যের পূর্ণ বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। তৃতীয় পদক্ষেপে তথ্যচিত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তথ্য মন্ত্রণালয়ের দু’জন ক্যামেরাম্যানসহ মিরেরসরাই, সীতাকুÐ, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, সাতকানিয়া, চকরিয়া, রামু, উখিয়া, কক্সবাজার, মহেশখালী, নীলাদ্বীপ এবং বার্মা বর্ডার, টেকনাফ, রামগড়সহ বিভিন্ন এলাকায় পনের দিন ধরে পরিদর্শন করে তথ্য ও আলোকচিত্র সংগ্রহ করেন। এসব তথ্য তিনি তথ্য মন্ত্রণালয়ে জমা প্রদান করেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন যে, `The amount of losses of Buddhist Community in currency at least 5 crore takas. At least 20 Buddhist temples were burbed to ashes. Thousands of women were raped. Thousands of houses were burned to ashes.’
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে মৃত্যুবরণ করেছে ৫ হাজার বাঙালি বৌদ্ধ, (পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি বৌদ্ধ ও কক্সবাজার, বরগুণা ও পটুয়াখালীর রাখাইন বৌদ্ধ নিহত হয় প্রায় ২-৩ হাজার, আহত হয় ২ হাজার), আহত হয়েছে ৪ হাজারের বেশি, ধর্ষিতা হয়েছে ১ হাজারেরও বেশি বৌদ্ধ নারী, বিনষ্ট হয়েছে তাঁদের ৫ কোটি টাকার ধনসম্পত্তি, ক্ষতিগ্রস্থ হয় ২০-২৫টির অধিক বৌদ্ধ বিহার, ভস্মীভূত হয় ১০টি বৌদ্ধ বিহার, বিধ্বস্ত হয় ১০০টির অধিক বুদ্ধমূর্তি, লুুন্ঠিত হয় শত শত বিহার, চুরি হয় বহু স্বর্ণ, রৌপ্য ও কষ্টিপাথরের মূর্তি ইত্যাদি ইত্যাদি। জানা যায় যে, একমাত্র কক্সবাজার জেলাতেই হানাদার বাহিনী একশত বুদ্ধমূর্তি বিধ্বস্ত করে, ৪টি বুদ্ধমূর্তি চুরি করে। ১৯৭১ সালের জুন মাসে মহেশখালীর রামার পাড় বিহার পুড়িয়ে দেয় এবং এতে ৪টি বুদ্ধমূর্তি বিধ্বস্ত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে শতকরা ৫০ ভাগ পল্লী পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও দেশীয় দোসররা জ্বালিয়ে দেয়। খাগড়াছড়ি মারিশ্যাতে তিন শত উপজাতীয় পুরুষকে হত্যা করা হয়। রাঙ্গামাটিতে ৪ শতের অধিক তরুণকে গুলি করে মারা হয়। উখিয়া থানার প্রায় বৌদ্ধ গ্রামের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে ৩০ জনের অধিক তরুণকে হত্যা করা হয়। উখিয়ার মহাজন বাড়িসহ বহু বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়, রামুতে ৪ জন বৌদ্ধ নেতার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু সংঘরাজ অভয়তিষ্য মহাথেরো এবং বহু শিষ্যদের উপর নির্যাতন চালানো হয়। কক্সবাজার, চকরিয়া হারবাং ও মহেশখালীর বহু বডুয়া ও রাখাইনের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং রাখাইন নারী পুরুষকে নানাভাবে নির্যাতন করা হয়। প্রায় শতাধিক তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়। অত্যাচার নির্যাতনে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীরা ভারতের ত্রিপুরা, আসাম, অরুণাচল ও অন্যান্য এলাকায় চলে যায়। অনেক রাখাইন চলে যায় বার্মায়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর বাঙালি বৌদ্ধরা বেশ কিছু স্থানে প্রতিরোধ গড়ে তোলে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে। চট্টগ্রামের রাউজান থানার আবুরখীল গ্রাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আবুরখীলে হিন্দু মুসলিমদের আশ্রয় দেয়। যার জন্য আবুরখীল গ্রামটি পাকিস্তানীদের শ্যেনদৃষ্টিতে পড়ে। এই এলাকা থেকে বৌদ্ধরা মদুনাঘাটে, ষোলশহর, কালুরঘাটে ই.পি.আর বাহিনী ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের খাদ্যদ্রব্য সরবরাহে বিভিন্নভাবে সাহায্যে সহযোগিতা করেছে। গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা সহায়ক সমিতি গঠন করে বৌদ্ধরা। সেখানে স্থাপিত হয় মিনি হাসপাতাল ডা. রেণুকনা বডুয়া বেশ কয়েকজন ডাক্তার নিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। গ্রামের বৌদ্ধ যুবকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে করেছে। আবুরখীল ছাড়াও পদুয়ার গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়ক ঘাটি গড়ে তোলা হয়। পদুয়ার জঙ্গলে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এক শক্তিশালী ঘাটি গড়ে তোলে সেখানকার বৌদ্ধ সমাজের লোকজনেরা। পাহাড়তলীর তালতলি পাহাড় ছিল অন্যতম নিয়োগদানের ও প্রশিক্ষণের কেন্দ্র। সংগীতাচার্য জগদানন্দ বডুয়া কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তাঁদের সাথে আর ছিল পাহাড়তলীর অনেক বৌদ্ধ যুবক। রাঙ্গুনিয়া থানার বেতাগী গ্রামের বৌদ্ধরাও একটি আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন করে। এখান থেকেই ক্যাপ্টেন করিম ও ক্যাপ্টেন আলম তাদের সেনাদের সুসংগঠিত করেন। উক্ত গ্রামের ডা. কিরণ চন্দ্র বডুয়া আহত মুক্তিসেনাদের চিকিৎসা করেন। কালুরঘাটের পূর্ব পাড়ে হাজারীচর ও কদুরখীলে গ্রামের বৌদ্ধরা অত্যন্ত সাহসী ও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মেজর জিয়া প্রথম কদুরখীলে অবস্থান করেন। এসময় তাঁকে সাহায্যে করেন শ্রীমৎ বোধিপাল মহাথের, ডা. বীরেন্দ্র লাল বডুয়া, বিমলেন্দু বডুয়া, ইন্দুভূষণ বডুয়া ও চিত্ত বডুয়া। এই কদুরখীল গ্রাম থেকেই মেজর রফিক তাঁর বাহিনীকে সংগঠিত করেন। এ সময় তাঁর সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন ডা. চারু চন্দ্র বডুয়া, ডা. রমেশ চন্দ্র বডুয়া, ডা. অরুণ কুমার বডুয়া চৌধুরী। জীবনের ঝুকি নিয়ে তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাজ করেন। এছাড়াও রাউজান থানার হোয়ারাপাড়া, বিনাজুরি, আধাঁরমানিক, ফতেনগর, পটিয়া থানার পিংগলা, কর্তালা, বেলখাইন এবং রাঙ্গুনিয়া থানার বেশ কয়েকটি গ্রামের বৌদ্ধ সমাজের লোকজনরা দুঃসাহসী ভূমিকা নিয়েছেন। তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন, আশ্রয় দিয়ে ও খাদ্য দিয়ে সাহায্যে করেছেন।
চট্টগ্রামের বাহিরেও কুমিল্লা, নোয়াখালী, ঢাকার বেশ কয়েকটি বৌদ্ধ এলাকার গ্রামগুলিতে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধাদের এবং শরণার্থীদের আশ্রয় কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলা হয়। এ প্রসঙ্গে অবশ্যই রাজধানী ঢাকা শহরের বৌদ্ধ বিহারের কথা উল্লেখ করতে হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতে ঢাকায় পাকিস্তানিদের হামলার পর ঢাকার বৌদ্ধ বিহারে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার নারী পুরুষ এসে আশ্রয় নেয়। এখানে প্রায় ৫ হাজার মানুষকে আশ্রয় দিয়ে তাঁদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করেন বৌদ্ধ নেতৃবৃন্দ। এই বৌদ্ধ বিহারের একটি গাড়ীতে চড়ে মুক্তিযোদ্ধারা যাতায়াত করতো। এসব কারণে হানাদারদের দ্বারা একদিন রাতে আক্রান্ত হয় এই বৌদ্ধ বিহার। দুষ্কৃতিকারীরা পÐিত বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরোর কক্ষে ঢুকে তাঁকে শাসায় এবং বেঁধে ফেলে। তারপর দু®কৃতিকারীরা চালায় লুটপাট। তারা বৌদ্ধ বিহার থেকে স্বর্ণের বুদ্ধমূর্তি, সোনার ফ্রেমের চশমা, টাইপরাইটারসহ আশ্রয়ার্থীদের জমা রাখা সোনাদানা ও অর্থ সম্পদ নিয়ে যায়। ২৫ মার্চ পাকিস্তানী আক্রমণের পর বাঙালিরা পাল্টা আক্রমণ এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধ শুরু হলে দেশের বৌদ্ধ এলাকার যুবকরাও যুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে ভারতে যান সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য। প্রশিক্ষণ শেষে ১১টি সেক্টরের বিভিন্ন রণাঙ্গণে তাঁরা যুদ্ধে লিপ্ত হয় পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে কতজন বাঙালি বৌদ্ধ অংশ নিয়েছিলেন তার কোন সুনির্দিষ্ট সংখ্যা দিতে না পারলেও এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বাংলাদেশের প্রতিটি এলাকা থেকে কমবেশি দু’চার থেকে দশজন বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। উল্লেখ্যযোগ্য অনেক নেতৃস্থানীয় বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধার নাম দেয়া যায় যারা জীবন বাজী রেখে দেশের মুক্তির জন্য বিভিন্ন রণাঙ্গণে লড়াই করেছেন। এ সমস্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আছেন আনন্দ বিকাশ বডুয়া, নৃপেন্দ্র লাল বডুয়া, নিরঞ্জন বডুয়া, বোধিপাল বডুয়া, সুকুমার বডুয়া, বীর সিন্দু বডুয়া, অনিল কুমার বডুয়া, সুনীল বডুয়া, প্রশান্ত বডুয়া, অজিত বডুয়া, মদন বডুয়া, অমিয় বডুয়া, বিপুল বডুয়া, অনুজ বডুয়া, সম্বোধি প্রসাদ বডুয়া, সাধন বডুয়া, সুরক্ষিত বডুয়া, পরেশ বডুয়া, প্রভাকর বডুয়া, বিজেন্দ্র লাল বডুয়া, ভারত বডুয়া প্রমুখ। সরাসরি সশ্রস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ ছাড়াও বেশ কিছু বাঙালি বৌদ্ধ নেতৃবৃন্দের মুুজিবনগর সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করেন। এ সমস্ত নেতৃবৃন্দের মধ্যে আছেন শ্রীমৎ জ্যোতিঃপাল মহাথের, অধ্যাপক ধর্মরক্ষিত মহাথের, শ্রীমৎ শান্তপদ মহাথের, ড. শাসন রক্ষিত ভিক্ষু, ডি পি বডুয়া, বীরউত্তম ধর্মদর্শী বডুয়া, প্রিয়তোষ বডুয়া, শীলব্রত চৌধুরী, পি আর বডুয়া, ড. বিকিরণ প্রসাদ বডুয়া, ড. প্রণব কুমার বডুয়া, ডা. অরবিন্দ বডুয়া, হেমেন্দ্র লাল মুৎসুদ্দি, অমিত প্রসাদ মুৎসুদ্দি, সুধাংশু বিমল বডুয়া, মিলন প্রভাস বডুয়া, সলিল বিহার বডুয়া, অরুন কুমার বডুয়া, ডা. বিকিরণ বডুয়া, ডা. রণজিত কুমার বডুয়া, মৃণাল কান্তি বডুয়া, অধ্যাপক জয়সেন বডুয়া, অধ্যক্ষ সুকোমল বডুয়া, নীলরতন বডুয়া, প্রণোদিত বডুয়া, সাংবাদিক ড. সঞ্জয় বডুয়া, সাংবাদিক শীলব্রত বডুয়া, সাংবাদিক বিপ্লব বডুয়া, উদয়ন বডুয়া, নলিনী রঞ্জন বডুয়া, স্বপন মুৎসুদ্দি, প্রকৌশল সরোজ কুমার বডুয়া প্রমুখ।
মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বিভিন্নভাবে ভারতে আশ্রয় নিয়ে যারা কাজ করেছেন তন্মধ্যে উল্লেখ্য হলে কথাসাহিত্যিক বিপ্রদাশ বডুয়া, সাহিত্যিক সুব্রত বডুয়া, প্রণোদিত বডুয়া, সাংবাদিক পার্থ প্রতিম বডুয়া, শীলব্রত বডুয়া, অনিল বড়য়া, বিপ্লব বডুয়া, ড. প্রণব কুমার বডুয়া এবং সুধাংশু বিমল বডুয়া কলকাতায় সাংবাদিক সম্মেলন করেন এবং আকাশবাণী কোলকাতা কেন্দ্রের মাধ্যমে একটি বিবৃতি প্রচার করেন। অন্যান্যদের মধ্যে সলিল বিহারী বডুয়া, প্রকৌশলী সরোজ কুমার বডুয়া, ডি আই জি শৈলেন্দ্র কিশোর চৌধুরী, বিমল প্রতাপ বডুয়া, জেলাজজ শীলব্রত বডুয়া, সাংবাদিক ড. সঞ্জয় বডুয়া, ডা. রনজিৎ কুমার বডুয়া, অধ্যাপক সরোজ কুমার বডুয়া, ডা: সামন্তভদ্র মুৎসুদ্দি, অধ্যাপক ধর্মরক্ষিত মহাথের, ড. শাসন রক্ষিত মহাথের এবং প্রয়াত শান্তপদ মহাথের প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ ভারতে আশ্রয় নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় কাজ করেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য তৎপর ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে বৌদ্ধদের গৌরবময় ভূমিকা পর্যালোচনা
১৯৭১ সালে ২৫ শে মার্চ এবং তৎপরবর্তীকালে পাকসেনা ও তাদের দোসরদের সশস্ত্র আক্রমণ থেকে বৌদ্ধরা রেহাই পায়নি। অনেক বৌদ্ধ বিহার ও বৌদ্ধ গ্রাম লুণ্ঠিত হয়েছে। কোন কোন স্থানে মেয়েদের সম্ভবরহানী ও লুন্ঠিত হয়েছে। এ সময় কেউ কেউ প্রাণভয়ে মিয়ানমার ও ভারতে আশ্রয় নেয়। কিন্তু এর মাঝেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে বাঙালি বৌদ্ধরা কোনো কোনো গ্রামে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তন্মধ্যে রাউজান থানার আবুরখীল গ্রামের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আবুরখীল গ্রামের বহু হিন্দু নরনারী আশ্রয় নেয়। এ গ্রাম থেকে মদুনাঘাট, ষোলশহর ও কালুঘাটে ইপি আর বাহিনীর ও মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য সরবরাহ করা হয়। গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং মিনি হাসপাতাল স্থাপন করে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতেন। এয়ার মার্শাল সুলতান মাহমুদের ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান এই গ্রামেই শহীদ হন এবং তাকে এখানেই করব দেয়া হয়। স্বাধীনতার পর এয়ার মার্শাল সুলতান মাহমুদ ছোট ভাইয়ের কবর জিয়ারতের জন্য আবুলখীল আগমন করেন। আবুরখীলে ক্যাপ্টেন সুলতান মাহমুদ তার দলবল নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। এ গ্রামে অবস্থান গ্রহণ করে মুক্তিযোদ্ধা রুমী, রশ্মি, কামাল, ইদ্রিস, মোজাম্মেল, চিত্ত ও কেদার বিভিন্ন দিকে যুদ্ধ পরিচালনা করে। সেপ্টেম্বর মাসে আবুরখীলের কেরানীহাটে রাজাকারদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘর্ষ হয়। এতে অনেক রাজাকার মারা যায়। এ যুদ্ধে বিকাশ বডুয়া শহীদ হন।
আবুরখিল ছাড়াও পাহাড়তলী ও পদুয়া গ্রামে প্রতিরোধ তৎপরতা দেখা যায়। পদুয়ার জঙ্গলে স্থাপিত হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম ঘাঁটি। পাহাড়তলী গ্রামের তালতলী পাহাড় ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম রিক্রুটিং ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সঙ্গীতাচার্য জগদানন্দ বডুয়া এ কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তাঁর সাথে পাহাড়তলী গ্রামের সাহসী যুবকেরা কাজ করেছিল। রাঙ্গুনিয়া থানার বেতাগী গ্রামের বৌদ্ধ পল্লীতে ক্যাপ্টেন করিম ও ক্যাপ্টেন আলম আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। এই গ্রামের ডা. কিরণচন্দ্র বডুয়া আহত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ট্রানজিট ক্যাম্প স্থাপন করে চিকিৎসা করেন। এভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বৌদ্ধরা প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং এদেশের বৌদ্ধ গ্রামগুলোতে মুক্তিবাহিনীর আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে উঠে। প্রতিটি বৌদ্ধ গ্রামের অপেক্ষাকৃত তরুণ বৌদ্ধ ছেলেরা মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করে এবং মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখে।
কক্সবাজার জেলার রামু, কক্সবাজার, পালং ও উখিয়ার বৌদ্ধ গ্রামগুলিতে পাকবাহিনী ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ১৯৭১ সনের এপ্রিল মে মাসে পাকবাহিনী রামুর একাধিক মহাজন বাড়ি, কক্সবাজার শহরের প্রখ্যাত হেডমাস্টার অমিয় কুমার বডুয়া, অমিতশ্রী বডুয়া ও সঞ্জয় বডুয়াদের বাড়ি এবং রতœা পালং এর অম্বিকা চরণ বডুয়া, সাবেক ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ধনঞ্জয় বডুয়ার বাড়ি, আনন্দ কুমার বডুয়ার বাড়ি এবং ভালুকিয়া পালং এর যোগেন্দ্র সিকদারের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেন। কক্সবাজার জেলার উখিয়া থানার দীপক বডুয়া প্রথমদিকে পাকসেনাদের গুলিতে নিহত হয়। তিনি একাত্তরের চট্টগ্রামে প্রথম শহীদ বলে জানা জানা যায়। উখিয়া থানার রূমখা পালং গ্রামের ভট্ট বডুয়াকে হাত পা বেঁধে পাকবাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। কক্সবাজার জেলার স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা মোজাম্মেল হক, মোস্তাক আহমেদ, এডভোকেট আহমেদ হোসেন, শমসের আলম চৌধুরীসহ অন্যান্য নেতৃবর্গ, সংসদ সদস্য ও দুবাইর সাবেক রাষ্ট্রদূত সরওয়ার ওসমান চৌধুরী, সাবেক ইপি আর সদস্য পুলিশ বাহিনীর সদস্য ও স্থানীয় যুবকদের সাথে বৌদ্ধরা পার্শ্ববর্তী মিয়ানমারে আশ্রয় গ্রহণ করে। এ সময় উখিয়ার জিতেন্দ্র লাল বডুয়া নোয়াখালী সরকারি কলেজে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আহবানে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদানের উদ্দেশ্যে তিনি অন্যান্য মুক্তি যোদ্ধাদের সাথে মিয়ানমারের মিলিত হয় এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। জিতেন্দ্রলাল বডুয়া তখন মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম সংগঠক ও সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করায় এবং সরকারি চাকুরিতে যোগদান না করায় পাক সরকার তাকে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করেন। কালুরঘাট যুদ্ধে আহত ক্যাপ্টেন হারুণকে আহত অবস্থায় মিয়ানমারে আনয়ন করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। মিয়ানমার সীমান্তের গভীর জঙ্গলে মিয়ানমারে আশ্রয় গ্রহণকারী ইপি আর পুলিশ ছাত্র যুবক মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে স্থানীয় বৌদ্ধ যুবকেরা মিলিত হয় ও সংগঠিত হয় এবং একের পর এক মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। উখিয়ার ড. সঞ্জয় বডুয়া ঢাকায় সাংবাদিকতা পেশায় জড়িত থেকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে লেখালেখি করেন। উখিয়া থানার ভালুকিয়া পালং এর জমিদার যোগেন্দ্র লাল সিকদার ৫০জন মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় এবং শতশত মুক্তিযোদ্ধার আহারের যোগান দিয়েছিলেন। সরকারি গেজেটের নামের তালিকা অনুসারে কক্সবাজার জেলার বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সুরক্ষিত বডুয়া, পরিমল বডুয়া, জয়সেন বডুয়া, সুনীল বডুয়া, ধীমান বডুয়া, অরবিন্দ বডুয়া, উদয়ন বডুয়া, মিলন বডুয়া, দিলীপ বডুয়া, রমেশ বডুয়া, আশীষ বডুয়া, কৃষ্ণপ্রসাদ বডুয়া ও খোকা বডুয়া’র নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কক্সবাজারের বাঙালি বৌদ্ধদের ভূমিকা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনেক বৌদ্ধ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে, অনেকে শহীদ হন, অনেকে আহত হয় এবং অসংখ্য নারী পুরুষ নির্যাতিত ও নিপীড়িত ও হত্যার স্বীকার হন। এ সময় কক্সবাজারসহ চট্টগ্রামের বৌদ্ধরা পার্শ্ববর্তী বৌদ্ধদেশ বার্মায় অনেকে আশ্রয় গ্রহণ করেন। পরে বার্মায় আশ্রিত বৌদ্ধরা সংগঠিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। কক্সবাজার জেলার বৌদ্ধদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন রামু মেরেংলোয়ার শশাংক বডুয়া ও কামিনী বডুয়া, উখিয়া পালং এর ভট্ট বডুয়া, পিতা কালীধন বডুয়া-উখিয়া ও মনীন্দ্র লাল বডুয়া উখিয়া, কক্সবাজারের শশী কুমার বডুয়া, পিতা মৃত সীননাথ বডুয়া, চকরিয়ার ক্ষীরোধ মোহন বডুয়া (মানিকপুর) প্রমুখ। কিন্তু জেলাভিত্তিক মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় মাত্র ১২ জনকে কক্সবাজার জেলার বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নামোল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও নাম না জানা অনেক মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে। কক্সবাজারের রাখাইন বৌদ্ধ সমাজের অনেক মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন।
ড. প্রণব কুমার বডুয়া তাঁর মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি বৌদ্ধ স¤প্রদায় গ্রন্থের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণকারী ৪৮ জন বৌদ্ধ শহীদের পরিচয় লিপিবদ্ধ করেছেন। এ অনুচ্ছেদে তিনি ৩৫জন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ও পরিচয় প্রকাশ করেন। তা ছাড়া এ গ্রন্থে তিনি জেলা ওয়ারী বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের যে তালিকা প্রদান করেন তাতে দেখা যায় চট্টগ্রাম জেলা ২৩২, কক্সবাজার জেলায় ১২, নোয়াখালী জেলা ৩২, কুমিল্লা জেলায় ০১, খাগড়াছড়ি জেলায় ০২, বান্দরবান জেলায় ০১ জনের নাম দেখা যায়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বৌদ্ধদের অনেকে অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়ে অফিস আদালত ও চাকুরিতে যোগদান থেকে বিরত ছিলেন। অনেকে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সাথে যোগাযোগ স্থাপন পূর্বক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছিলেন। তাঁরা ভারতের বিভিন্ন স্থানে সভায় ভাষণ দিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেছেন এবং পাক সেনাদের অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরেন। অনেকে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সাথে ও বুদ্ধিজীবিদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে জ্যোতিঃপাল মহাথের, বঙ্গিশ ভিক্ষু, বিশুদ্ধানন্দ মহাথের, এস ধর্মপাল মহাথের, জিনানন্দ মহাথের, কুমিল্লার ধর্মরক্ষিত মহাথের, সংঘরক্ষিত ভিক্ষু, পূর্ণানন্দ মহাথের ও চট্টগ্রামের শান্তপদ মহাথের জাতিসংঘের মহাসচিব থেকে শুরু করে বিশ্ব বৌদ্ধ ফেলোশিপ (ডঋই) এর মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সমর্থন কামনা করেন।
প্রণোদিত বডুয়া, বিপ্রদাশ বডুয়া, সুব্রত বডুয়া ও রনধীর বডুয়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। পার্থ প্রতিম বডুয়া ভারতের সাপ্তাহিক ‘অমর বাংলা’ প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেন। বিপ্লব বডুয়া নামে আরেকজন সাহিত্যিক বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত ছিলেন বলে জানা যায়। তাঁর প্রচারিত কথিকা মুক্তাঞ্চলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রচারিত হয় বলে স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের ৫ম খÐে বর্ণিত আছে। স্বদেশে বিশুদ্ধানন্দ মহাথের এবং বিদেশে বৌদ্ধ রাষ্ট্রে জ্যোতিঃপাল মহাথের স্বাধীনতার স্বপক্ষে জনমত গঠন ও স্বাধীনতা লাভে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাই স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের বৌদ্ধরা একটি গুরুত্বপূর্ণ স¤প্রদায় হিসেবে মর্যাদা লাভ করে। বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষে সরকারি ছুটি এবং আষাঢ়ী পূর্ণিমা, আশ্বিনী পূর্ণিমা ও মাঘী পূর্ণিমা উপলক্ষে বৌদ্ধদের জন্য ঐচ্ছিক ছুটি নির্দিষ্ট করা হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ টিভি ও বেতারের সপ্তাহে স্বীকৃতিও যথাযথ আচরণের নির্দশন বলে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদানের স্বীকৃতি বৌদ্ধরা পায়নি। এখনো যথাযথভাবে তাদের অপরিসীম ভূমিকার মূল্যায়ন হয়নি। সেজন্য বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা এবং কমাÐারদের এ ব্যাপারে তৎপর হতে হবে। সরকারের সাথে সমন্বয় সাধন করে একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন করা।
স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের পরিচয়
দীর্ঘ প্রায় শত বছর সংগ্রামের পর ১৯৪৭ সালে পাক ভারত স্বাধীনতা লাভ করে সৃষ্টি হয় দুটি পৃথক রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান। ভারতের পশ্চিম মুসলিম অধ্যুষিত অংশ পশ্চিম পাকিস্তান এবং এর প্রায় দেড় হাজার মাইল পূর্বে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট অঞ্চল পূর্ববঙ্গকে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান এ দু’ প্রদেশকে নিয়ে গড়ে তোলা হয় পাকিস্তান নামক দেশ। দেশ বিভাগের পর থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব মুহুর্তে অর্থাৎ ১৯৭১ সালে পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান বরাবরই পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক শাসিত হয়ে আসছিল। শাসনের নামে তারা পূর্ব-পাকিস্তানীদের করেছে শোষণ নিপীড়ন এমনকি মুখের মাতৃভাষাকেও তারা স্তদ্ধ করে দিতে চেয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের জাতি ধর্ম নিবিশেষে ছাত্র জনতার প্রতিবাদের মুখে তাদের সেই হীন চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠি বাঙালিদের উপর সকল ক্ষেত্রে এমনভাবে নিপীড়ন শুরু করলো যে বাঙালিরা অনন্যেপায় হয়ে স্বাধিকার আন্দোলন করতে বাধ্য হলো। স্বাধিকার আন্দোলন অবশেষে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ লাভ করলো। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বীরদীপ্ত আহবান ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- এ অগ্নিমন্ত্রে উজ্জীবিত জাতি ধর্ম নারী পুরুষ আবাল বৃদ্ধ বণিতা ঐক্যবদ্ধ হলো ১৯৭১ সালে ২৫মার্চ নরঘাতক পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তৎকালীন সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে নিরীহ বাঙালি জাতির উপর ঝাপিয়ে পড়লো। আর পরদিন ২৬ মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলো। শত্রæকে প্রতিহত করার জন্য বঙ্গবন্ধুর পক্ষ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা কর হলো। শত্রæকে প্রতিহত করার জন্য বাঙালি ছাত্র জনতা সকল স্তরের মানুষ অস্ত্র হাত তুলে নিল। শুরু হলো স্বাধীনতা সংগ্রাম। সেই সংগ্রামে বাঙালি বৌদ্ধরাও নিজেদের সম্পৃক্ত করে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। লেখনী ও শব্দ সৈনিক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখেন বিপ্রদাস বডুয়া, সুব্রত বডুয়া প্রমুখ।
বাঙালি বৌদ্ধরা মূলত বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাংশে বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলায় বসবাসরত একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী অবস্থানগত ও সংখ্যাগত কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের বিচরণ ক্ষেত্র সীমিত পরিসরে সীমাবদ্ধ হলেও আনুপাতিক হারে তাদের অবদান কোনো অংশেই কম নয়। নেতৃত্বের অভাব থাকলেও তারা ব্রিটিশ শাসনামল থেকে প্রগতিশীল আন্দোলনেকে সমর্থন করেছে এবং সাধ্যমত ভূমিকা রেখেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় অনেক বাঙালি বৌদ্ধ যুবক অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধ করেছে অনেকে শহীদ হয়েছেন, অনেকে নিখোঁজ হয়েছেন, লুণ্ঠিত হয়েছে, বৌদ্ধদের ধন সম্পদ, অগ্নিদগ্ধ হয়েছে হাজার হাজার ঘর বাড়ি. নিগৃহীত লাঞ্চিত ও ধর্ষিত হয়েছে শত শত বৌদ্ধ তরুণী। এসব অত্যাচার নিপীড়ন থেকে গৈরিক বসনধারী বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও রেহাই পায়নি। অনেক বিহার লুুন্ঠিত হয়েছে, অপহৃত হয়েছে বহু মূল্যবান বুদ্ধমূর্তি। এসময়ে অনেক বৌদ্ধ জনসাধারণ আত্মরক্ষা করার জন্য আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হয়েছে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র বার্মা (মিয়ানমার) ও ভারতে।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের বাঙালি বৌদ্ধদের গৌরবময় আত্মত্যাগের ইতিহাস এখনো রচিত হয়নি। ১৯৯৮ সাল বাংলা একাডেমি থেকে ড. প্রণব কুমার বডুয়া (মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি বৌদ্ধ সম্প্রদায়), জ্যোতিঃপাল মহাথের (বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে) এবং বিশুদ্ধানন্দ মহাথের (রক্তঝরা দিনগুলি) ব্যতীত মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি বৌদ্ধ স¤প্রদায় অংশগ্রহণ ও অবদান সম্পর্কে আর কোন গ্রন্থ রচিত হয়নি। এছাড়া কয়েকটি গ্রন্থ ও সাময়িক পত্র এবং অন্যান্য জনের দু’একটি মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছাড়া তেমন উলে­খযোগ্য কোন তথ্যপূর্ণ ইতিহাস প্রকাশিত হয়নি। এ ব্যাপারে আরো গভীর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি বৌদ্ধদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা ও আত্মত্যাগের সঠিক ইতিহাস প্রকাশিত হলে বৌদ্ধ স¤প্রদায় এবং তাদের উত্তর প্রজন্ম নিঃসন্দেহে আত্মশ্লাঘা বোধ করবে।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ কিংবা পাকসেনা ও রাজাকার আলবদর কর্তৃক নির্যাতিত বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা
 দীপক বডুয়া  পিতা – মৃত বিজয়শ্রী বডুয়া, উখিয়া, কক্সবাজার (২৭ মার্চ প্রতিরোধ যুদ্ধে চট্টগ্রাম ডি সি হিলের পাদদেশে চেরাগী পাহাড়ের কাছে শহীদ হন। তিনি প্রথম একাত্তরের বৌদ্ধ শহীদ)।
 জিনানন্দ ভিক্ষু  গ্রাম – আধাঁরমানিক, রাউজান, চট্টগ্রাম। (তিনি পটিয়া থানার পাঁচরিয়া গন্ধকুটি বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ ছিলেন। স্বাধীনতার দুইদিন আগে রাজাকার কর্তৃক নিহত হন)।
সুধীর বডুয়া  পিতা – মৃত নীরেন্দ্র লাল বডুয়া গ্রাম – আবুরখীল রাউজান, চট্টগ্রাম (ইপিআর বাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং ময়মনসিংহ ৯ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধে শহীদ হন)।
 পংকজ বডুয়া  পিতা – সুরেন্দ্র লাল বডুয়া, গ্রাম হিংগলা, রাউজান, চট্টগ্রাম, (চট্টগ্রাম ১০ ডিসেম্বর থানার মোহাম্মদ আলীর হাটে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন)।
 বিকাশ বডুয়া  পিতা – মৃত দ্রোন কুমার বডুয়া, গ্রাম-খৈয়াখালী, রাউজান, চট্টগ্রাম। (সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন)।
 শুক্লধর বডুয়া  গ্রাম – দমদমা, মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম।
 মৃণাল কান্তি বডুয়া  গ্রাম – জোরালগঞ্জ, মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম।
 দুলাল কান্তি বডুয়া  গ্রাম – হিংগলা, রাউজান, চট্টগ্রাম।
 ঝন্টু বডুয়া  পিতা – অর্জুন বডুয়া গ্রাম আধাঁরমানিক, রাউজান, চট্টগ্রাম।
 আনন্দ প্রসাদ বডুয়া  গ্রাম – আবুরখীল, রাউজান, চট্টগ্রাম।
 বাগীশ্বর বডুয়া (প্রধান শিক্ষক) গ্রাম – আবুরখীল, রাউজান, চট্টগ্রাম।
 আনন্দ বডুয়া  গ্রাম – পারুয়া, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।
 মৃণাল কান্তি বডুয়া  পিতা – সতীশচন্দ্র বডুয়া, সোনাপাহাড়, মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম।
 শশাঙ্ক মোহন বডুয়া গ্রাম – মেরেংলোয়া, রামু, কক্সবাজার। (৯ মে হানাদার বাহিনী আওয়ামীলীগের কর্মী হওয়ার কারণে সুপারি গাছের সাথে বেঁধে গুলি করে হত্যা করে)।
 রমেশ বডুয়া (শিক্ষক) গ্রাম – গহিরা, রাউজান, চট্টগ্রাম।
 উমেশ চন্দ্র বডুয়া  গ্রাম – গহিরা, রাউজান, চট্টগ্রাম।
 বীরবাহু বডুয়া(প্রধান শিক্ষক)  গ্রাম – করলডাঙ্গা, পটিয়া, চট্টগ্রাম।
 সুমতি রঞ্জন বডুয়া (শিক্ষক) গ্রাম – শাকপুরা, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম (১০ ডিসেম্বর পাকসেনাদের গুলিতে নিহত হন)।
 ধূর্জ্জটি প্রসাদ বডুয়া  গ্রাম – শাকপুরা, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম (জেএসআই চট্টগ্রাম বন্দর, ২০ এপ্রিল পাকসেনা কর্তৃক শাকপুরাস্থ তপোবন বিহারে শহীদ হন)।
 রমেশ চন্দ্র বডুয়া  গ্রাম – শাকপুরা, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম (২০ এপ্রিল পাক সেনাদের গুলিতে নিহত হন)।
 সুনীল বডুয়া  গ্রাম – বৈদ্যপাড়া বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম।
 বিভূতি বডুয়া  গ্রাম – বেতাগী, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।
 কামিনী বডুয়া  গ্রাম – রামু মেরেংলোয়া, রামু কক্সবাজার।
 মনোরঞ্জন সিংহ  পিতা – বিপিন সিংহ, গ্রাম-আলীশ্বর, লাকসাম, কুমিল­া। (২১ নভেম্বর পাকবাহিনীর কনভয় আক্রমন করতে গিয়ে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন)।
 মিলন বডুয়া  গ্রাম – মোগলটুলি বডুয়া পাড়া, মোগলটুলি, চট্টগ্রাম।
 মনীন্দ্র লাল বডুয়া  গ্রাম – হলদিয়া পালং, উখিয়া, কক্সবাজার।
 শশী কুমার বডুয়া  পিতা – মৃত সীননাথ বডুয়া, কক্সবাজার, সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র।
 ক্ষীরোধ মোহন বডুয়া  গ্রাম – মানিকপুর, চকরিয়া, কক্সবাজার।
 সুনীল বডুয়া গ্রাম – সরোয়াতলী, চট্টগ্রাম।
 অনিল বডুয়া গ্রাম – ডাবুয়া, চট্টগ্রাম।
 সুশীল বডুয়া  গ্রাম – বৈদ্যপাড়া, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম।
 বিজয় রতন বডুয়া  গ্রাম – দমদমা, মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম।
 মনোহরি বডুয়া  গ্রাম – মায়ানী, মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম।
 রাসবিহারী বডুয়া  গ্রাম – মায়ানী, মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম।
 যোগেশ চন্দ্র বডুয়া  গ্রাম – মায়ানী, মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম।
 সুধাংশু বডুয়া  গ্রাম – মায়ানী, মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম।
 নাইদবাসী বডুয়া  গ্রাম – মায়ানী, মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম।
 বেনীমাধব বডুয়া গ্রাম – জোবরা, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
 দেবাশোক বডুয়া  গ্রাম – মোগলটুলী, চট্টগ্রাম।
 মিলন বডুয়া  গ্রাম – পাহাড়তলী মহামুনি, রাউজান, চট্টগ্রাম।
 নীরদ বরণ বডুয়া  গ্রাম – পাহাড়তলী মহামুনি, রাউজান, চট্টগ্রাম।
 রূপায়ন বডুয়া  গ্রাম – নোয়াপাড়া, রাউজান, চট্টগ্রাম।
 বাদল বডুয়া  গ্রাম – পাহাড়তলী, রাউজান, চট্টগ্রাম।
 ভট্ট বডুয়া  পিতা – কালীধন বডুয়া, উখিয়া, কক্সবাজার।
 দীপক বডুয়া  গ্রাম – আব্দুল্লাহপুর, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।
 জ্ঞানেন্দ্র বডুয়া (সদরঘাট) গ্রাম – রাউজান, চট্টগ্রাম।
 সুধাংশু বডুয়া  গ্রাম – হাইদচকিয়া, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।
 কামিনী বডুয়া  গ্রাম – রামু, কক্সবাজার।
 জীবন বডুয়া  গ্রাম – কৌশল্যার বাগ, কোমলগঞ্জ, নোয়াখালী।
 টুনু বডুয়া  গ্রাম – কৌশল্যার বাগ, কোমলগঞ্জ, নোয়াখালী।
 বীরেন্দ্র লাল বডুয়া  গ্রাম – কৌশল্যার বাগ, কোমলগঞ্জ, নোয়াখালী।
 চারুবালা বডুয়া  গ্রাম – আবুরখীল, রাউজান, চট্টগ্রাম।
 সারদা বডুয়া  গ্রাম – গহিরা, রাউজান, চট্টগ্রাম।
 ভবেশ চন্দ্র বডুয়া  পিতা – মৃত বিপিন চন্দ্র বডুয়া, গ্রাম-সাদেকনগর, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।
 বুদ্ধ কিঙ্কর বডুয়া  গ্রাম – দমদমা, মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম।
 সুকোমল বডুয়া (শিক্ষক) রাঙ্গামাটি সদর, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা।
 রূপায়ন বডুয়া গ্রাম – গুজরা নোয়াপাড়া, রাউজান, চট্টগ্রাম।
 সুধীর রঞ্জন বডুয়া  কর্ণফুলী পেপার মিল, চন্দ্রঘোনা। (২৯ এপ্রিল শহীদ হন)
 সুপতি রঞ্জন বডুয়া  গ্রাম-রাউজান, চট্টগ্রাম। চীফ ফাইনেন্সিয়াল এডভাইজার রেলওয়ে বোর্ড, ১৬ এপ্রিল গ্রেফতার হন পাক নৌবাহিনী কর্তৃক এবং ১৭ এপ্রিল তাঁকে সার্কিট হাউজে হত্যা করা হয়।
 সঞ্চয়ন বড়য়া  গ্রাম – রাউজান, উপজেলা- রাউজান, চট্টগ্রাম।
 প্রভাস কুসুম বডুয়া  পিতা- অসিতী রঞ্জন বডুয়া, গ্রাম – ইছামতি, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম বিশ্বাবদ্যালয়ের প্রকৌশলী। (২১ এপ্রিল পাকবাহিনী তাঁর সার্সন রোডস্থ বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করে)।
 চিত্তরঞ্জন বডুয়া  গ্রাম – জোয়ারা, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম। (টিএÐটি, ২৯ এপ্রিল শহীদ হন)।
 তড়িৎ কান্তি বডুয়া  গ্রাম – রাউজান, চট্টগ্রাম। (টিএÐ টি, ২৯ এপ্রিল শহীদ হন)।
 হীরেন্দ্র লাল বডুয়া  চন্দ্রঘোনা পেপার মিলে কর্মরত ছিলেন। (২৯ এপ্রিল শহীদ হন)।
 পরাগ বডুয়া  গ্রাম – সাতবাড়িয়া, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম। (২৯ এপ্রিল শহীদ হন)।
 ধর্মদর্শী বডুয়া  টি এন্ড টিতে চাকুরীত ছিলেন। (২৯ এপ্রিল শহীদ হন)।
 সুবিমল বডুয়া  টি এÐ টিতে চাকুরীরত ছিলেন। (২৯ এপ্রিল শহীদ হন)।
 সুনীল মুৎসুদ্দি  আওয়ামীলীগের রাঙ্গামাটি থানা কমিটির দপ্তর সম্পাদক ছিলেন।
 চিত্ত রঞ্জন বডুয়া  গ্রাম – রাউজান, উপজেলা- রাউজান,  চট্টগ্রাম।
 ভবেশ বডুয়া  গ্রাম – জানারখীল সাদেক নগর, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।
 নিপুন কান্তি বডুয়া  ইলিয়াস বিল্ডিং, চকবাজার, চট্টগ্রাম। (৩ মে তুলে নিয়ে পাকসেনারা হত্যা করে)
সত্যরঞ্জন বডুয়া  গ্রাম – রাউজান, উপজেলা- রাউজান,  চট্টগ্রাম।
 বিধুভূষণ  বডুয়া  গ্রাম – মাদার্শা, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
 রমেশ চন্দ্র বডুয়া  গ্রাম – মাদার্শা, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
 সুভাষ বডুয়া  গ্রাম – মাদার্শা, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
 বঙ্কিম বডুয়া  গ্রাম – মাদার্শা, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
 ননীগোপাল বডুয়া  গ্রাম – লাখেরা, পটিয়া, চট্টগ্রাম।
 নীলকমল বডুয়া  গ্রাম – কধুরখীল, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম।
 মিনা বডুয়া  গ্রাম – দমদমা, মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম।
 ভূপেন্দ্র লাল বডুয়া  গ্রাম – চান্দগাঁও, চট্টগ্রাম।
 সুরেন্দ্র লাল বডুয়া  গ্রাম – চান্দগাঁও, চট্টগ্রাম।
 তপন কুমার বডুয়া  গ্রাম – চান্দগাঁও, চট্টগ্রাম।
 মনীন্দ্র লাল বডুয়া  গ্রাম – চান্দগাঁও, চট্টগ্রাম।
 কামিনী বডুয়া গ্রাম – গহিরা, হাটহজার, চট্টগ্রাম।
সুকোমল বডুয়া গ্রাম – দমদমা, মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম।
বীরেন্দ্র লাল বডুয়া
মনোরঞ্জন সিংহ গ্রাম – বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী।
গ্রাম – দত্তপুর, কুমিল্লা।
বিমল বডুয়া পিতা – মৃত মনমোহন কড়–য়া, গ্রাম – নানুপুর, ফটিকছড়ি।
সমীরণ বডুয়া  গ্রাম – পান্থশালা মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম।
হিমাংশু বডুয়া  গ্রাম – বরমা, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম।
সঞ্চয় ভূষণ বডুয়া  বন্দরে চাকুরিরত ছিলেন।
হীরেন্দ্র লাল বডুয়া  বন্দরে চাকুরিরত ছিলেন।
এস. আর. বডুয়া  বন্দরে চাকুরিরত ছিলেন।
ভি. পি. বডুয়া  বন্দরে চাকুরিরত ছিলেন।
বি. এস. বডুয়া  বন্দরে চাকুরিরত ছিলেন।
কৃষ্ণ প্রসাদ বডুয়া রামু, কক্সবাজার।
সাধন বডুয়া গ্রাম – ঢেমশা, সাতকানিয়া।
মিলন বডুয়া বড় হাতিয়া, সাতকানিয়া।
রনজিত বডুয়া মিয়াপুর, নোয়াখালী।
সুশান্ত বডুয়া ইছামতি, রাঙ্গুনিয়া।
কাজল বডুয়া ইছামতি, রাঙ্গুনিয়া।
অনুজ কুমার বডুয়া হাইদচকিয়া, ফটিকছড়ি।
ধীমান বডুয়া রামু, কক্সবাজার।
অরবিন্দু বডুয়া রামু, কক্সবাজার।
নিপুল কান্তি বডুয়া গ্রাম – ঘাটচেক, রাঙ্গুনিয়া।
মহান মুক্তিযুদ্ধে মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের এবং দশম সংঘরাজ পÐিত জ্যোতিঃপাল মহাথের অনন্য অসাধারণ অবদান রাখেন। বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামে বাঙালি বৌদ্ধ নেতৃবৃন্দ প্রধানত দুই ভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। প্রথমত: দেশের অভ্যন্তরে বৌদ্ধদের জান মাল রক্ষায় প্রয়াত মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরর নেতৃত্বে অভ্যন্তরীণ মিশনারী কাজ, দ্বিতীয়ত: মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গঠন ও সমর্থন লাভে সংঘরাজ পÐিত জ্যোতিঃপাল মহাথের বহির্বিশ্বের বৌদ্ধদেশসমূহ পরিভ্রমণ। উল্লেখ্য যে এ দুইজন মহান সাংঘিক ব্যক্তিত্ব কৃতকর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ পÐিত জ্যোতিঃপাল মহাথের মহান একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক এবং সংঘনায়ক বিশদ্ধানন্দ মহাথের, ভাষাকন্যা প্রতিভা মুৎসুদ্দি, কবিয়াল ফণী ভূষণ বডুয়া এবং এবং কথাসাহিত্যিক বিপ্রদাশ বডুয়া মহান একুশে পদক লাভ করেছেন।
চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর আদিবাসী বীরাঙ্গনা
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৌদ্ধদের অবদান ছিল অপরিসীম। মানব ইতিহাসে সংঘটিত অজ¯্র গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের ঘটনার মধ্যে স্বল্পতম সময়ে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষ নিহত ও ধর্ষিত হয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিয্ুেদ্ধ পাকিস্তানী বাহিনী কর্তৃক। এদেশের বাঙালি জনগোষ্ঠী ছাড়াও হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে বাঙালি বডুয়া বৌদ্ধ, আদিবাসী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বহু নর-নারী। বাংলাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ স্বতস্ফূত ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। বাঙালি বডুয়া বৌদ্ধ, পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অনেক বৌদ্ধ নর-নারীরা মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আদিবাসী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অনেক নারী বীরঙ্গনা রয়েছে। তাঁরা নিরবে নিভৃতে তাদের গøানি মাথায় নিয়ে দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষে নিবেদিত ছিলেন।
ইতিহাসে দেখা যায়, বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর মধ্যে অনেকেই পাকসেনা এবং এদেশীয় দোসরদের দ্বারা আহত ও নিহত হয়েছেন; আবার অনেকে নির্যাতিত, নিপীড়িত ও ধর্ষিত হয়েছেন। সেই ভয়ানক দিনের কথা মনে করলে এখনো অনেকে শিহরিত হয়ে যান। বাঙালি বডুয়া বৌদ্ধ অনেকে নিহত ও ধর্ষিত হয়েছে। বিশেষ করে চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর আদিবাসী বৌদ্ধ নারীরা নির্যাতিত, নিপিড়িত ও ধর্ষিত হয়েছিল অধিক। অনেক নারী আত্মসম্মানবোধ আর সামাজিক লোক লজ্জার ভয়ে নির্যাতিত, নিপীড়িত কিংবা ধর্ষিত হয়েও প্রকাশ করেননি। এমন বৌদ্ধ নারীর সংখ্যাও নিহাত কম নয়। আদিবাসী বীরাঙ্গনা বৌদ্ধ নারীদের নিয়ে কাজ করেছেন সুরমা জাহিদ। তিনি ‘এই সংগ্রামে আমিও আদিবাসী বীরাঙ্গনা’শিরোনামে অন্বেষা প্রকাশন থেকে ২০১৪ সালে তাঁর গবেষণা কর্ম প্রকাশ করেছেন। তাঁর এ গবেষণা গ্রন্থে আদিবাসী বীরাঙ্গনা নারীদের কথা, অভিমত, নির্যাতনের চালচিত্র পর্যালোচনা করেছেন। আদিবাসী বীরাঙ্গনাদের সেই পাশবিক নির্যাতনের কথা এখনো মানুষকে পীড়িত করে।  নি¤েœ কয়েকজন আদিবাসী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বৌদ্ধ বীরাঙ্গনার নাম ও পরিচয় তুলে ধরা হলো।
কক্সবাজারের আদিবাসী বৌদ্ধ বীরঙ্গনা থোঁঞো তনচংঙ্গ্যা, চেনচেন্নু রাখাইন, এবং স্বর্ণ কুমারী ত্রিপুরা। পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটির জক্কুনী ত্রিপুরা, হেমাঙ্গিনী ত্রিপুরা, বিজলী সাঁওতাল, রাজবেলা সাওতাল। পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান এর হামে চিং মার্মা, কৃষ্ণপুটি তনচংঙ্গ্যা প্রমুখ। পার্বত্য চট্টগ্রাম খাগড়াছড়ি জেলায় ধর্ষিত আদিবাসী বীরাঙ্গনারা হলেন- আভা মার্মা, লামাচ মার্মা, চেন্দাউ মার্মা প্রমুখ। দীর্ঘ সময় পরে হলেও আদিবাসী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বৌদ্ধ বীরাঙ্গনাদের মূল্যায়ন ও সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করা প্রয়োজন।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠির স্বাধীনতা স্বজাত্যবোধের চিরায়ত ধর্মীয় ধারায় কালে কালে প্রগতিশীল আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদান ছিল অপরিসীম। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বৌদ্ধদের অংশগ্রহণ এবং স্বাধীনতা লাভের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। বৌদ্ধরা এদেশের ভূমিজ সন্তান। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বৌদ্ধ স¤প্রদায়ের অংশগ্রহণ, বহির্বিশ্বের বৌদ্ধ রাষ্ট্রসমূহ হতে সমর্থন আদায় ও অনন্য অবদান স্মরণীয়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন। সরকার বা রাষ্ট্রীয়ভাবে বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধার তালিকা, স্বীকৃতি প্রদান, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য সহায়তা প্রদান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার এত বছর পরও বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের নামের úূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন করা হয়নি।
বাঙালি বডুয়া বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর মুক্তিযোদ্ধাদের সামগ্রিক মূল্যায়ন, কর্মের সঈকৃতি, সম্মাননার জন্য জাতীয় উদ্যোগ প্রয়োজন। এখনো বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন ভাবে হতাশা ও অসহায় অবস্থায় রয়েছে। এ গবেষণাকর্মে চট্টগ্রামের বাঙালি বডুয়া বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধদের মধ্যে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, সহায়তা দান, নৈতিক সমর্থন ও কূটনীতিক সহযোগিতা দিয়েছে তাদের অবদান ও মুক্তিযোদ্ধদের একটি সংক্ষিপ্ত নামের তালিকা প্রণয়ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। সেই সাথে শহীদ বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বিবরণও প্রদান করা হয়েছে। তবে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের অংশগ্রহণ ও অবদান বিষয়ে ক্রোশপত্র প্রকাশ করা প্রয়োজন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও ভূমিকা পালন করা এবং সমাজকর্মে অবদান রাখার জন্যে রাষ্ট্রীয় মহান স্বাধীনতা পদক ও মহান একুশে পদক লাভ করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর পরেও বাঙালি বডুয়া বৌদ্ধ সম্প্রদায় মনে করেন তাদের এ অনন্য অসাধারণ অবদানের যোগ্য মূল্যায়ন হওয়া উচিত। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিসহ এ পর্যন্ত বৌদ্ধদের মধ্যে কেউ কেউ সম্মান লাভ করলেও আরো অধিকভাবে দেশ মাতৃকার জন্য উৎসর্গীত, স্বদেশপ্রেমী মানুষের মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন।
শেয়ার করুন
আরও সংবাদ দেখুন

জনপ্রিয়

সুহৃদ চৌধুরী শুধু মানুষ গড়ার কারিগর নয়, ছিলেন একজন সমাজহিতৈষী ও দক্ষ সংগঠক

You cannot copy content of this page

মুক্তিযুদ্ধে বৌদ্ধদের অবদান

আপডেট সময় ০৪:০৪:০৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতিসত্তা হিসেবে বৌদ্ধরা অতি প্রাচীন। ভারত-বাংলা উপমহাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিনির্মাণে বৌদ্ধদের অসামান্য অবদান রয়েছে। এদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামসহ প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামে বৌদ্ধদের গৌরবময় ইতিহাস লক্ষ্য করা যায়। এদেশের বৌদ্ধ স¤প্রদায় বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় সাহসী কর্মনির্মিতি ছিল অনন্য অসাধারণ। বাংলার ভূমিজ সন্তান হিসেবে বৌদ্ধরা দেশমাতৃকার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বৌদ্ধ সম্প্রদায় বলতে বাঙালি বডুয়া বৌদ্ধ, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর চাকমা, মারমা, রাখাইন,ম্রো, চাক, তনচঙ্গ্যা প্রভৃতি জনগোষ্ঠীকে বুঝায়। বৌদ্ধরা জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সকলেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং বীরত্বপূর্ণ ও সাহসী ভূমিকা পালন করেন। তাদের অনেকেই জীবন দিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষের উপর পাকবাহিনীর অতর্কিত বর্বরোচিত আক্রমণে এদশের মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকলেই অত্যাচার, নির্যাতিত, নিপীড়িত, ধর্ষণ ও নৃশংসভাবে নিহত হয়েছেন। ‘মুক্তিযুদ্ধে বৌদ্ধদের অবদান : চট্টগ্রামের অঞ্চল’ আলোচ্য প্রবন্ধে স্বাধীনতাকালীন বাঙালি বডুয়া বৌদ্ধদের অবদান, মুক্তিযুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ, শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম, বীরাঙ্গনাদের নাম এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সক্রিয় ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

স্বাধীনতা আন্দোলনে বৌদ্ধদের অংশগ্রহণ ও অবদান
বাংলাদেশের বৌদ্ধদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অত্যন্ত গৌরবময়। সাধারণভাবে ব্রিটিশ আমল থেকে বৌদ্ধরা বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনে যোগদান করে আসছে। অতীতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বৌদ্ধদের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। এতে উদীয়মান তরুণ ভূপেন্দ্রনাথ বডুয়া ও অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ বডুয়া প্রমুখ নেতৃবৃন্দ নির্যাতন ও কারাদন্ড ভোগ করেছেন। বিপ্লবী আন্দোলনে বৌদ্ধ যুবক স¤প্রদায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বিপ্লবী মহেশ বডুয়া, বিহারী বডুয়া, প্রকৃতি বডুয়া প্রমুখ অনেকে ব্রিটিশের কারাগারে তিলে তিলে আত্মদান করেছেন। তেজস্বী রোহিনী বডুয়া ফাঁসির কাষ্টে জীবনের জয়গান গেয়ে যান।
বৌদ্ধদের ইতিহাস বহু বলিষ্ট। বিশেষত বিপ্লব বিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ ও বিপ্লবে বৌদ্ধরা অংশ নিয়েছিল। সামরিক বাহিনীতে বৌদ্ধরা বিশেষ দক্ষতা দেখিয়েছিল। ইংরেজ রাজত্বের প্রারম্ভে বৌদ্ধরা দলে দলে সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। মগ প্লটনের সদস্যরা সমর কর্মকাÐে প্রশংসা কুঁড়িয়ে ছিল। প্রথমে বৌদ্ধরা ইংরেজদের সাথে অসহযোগিতার মনোভাব দেখালেও পরে, তারা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। হিন্দুদের সাথে সাথে বৌদ্ধরাও ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে ইংরেজদের নজরে আসে। ইংরেজরা বৌদ্ধদের শৌর্যবীর্যের কথা অবহিত হয়ে তাদেরকে সেনাবাহিনীতে চাকরি দেয়। বৌদ্ধ সৈনিকদের সমন্বয়ে ‘মগ পল্টন’ নামে পৃথক একটি সেনা দল সৃষ্টি করেন। মগ পল্টনের কয়েকজন বডুয়া সৈনিকের নাম ও পরিচয় হল: নারায়ণ সিং সুবেদার, পাহাড়তলী, মোহন সিং সুবেদার, পাহাড়তলী, কালাচান সুবেদার, পাহাড়তলী, দীপচান সুবেদার, জ্যৈষ্টপুরা, জয় সিং সুবেদার, আধাঁরমানিক, উদয়চান জমাদার বাহাদুর, বাঘখালি। ১৯৩০ সালে ভারতে সে সত্যাগ্রহ আন্দোলন হয় তাতে বৌদ্ধ যুবক ও ছাত্ররা অংশগ্রহণ করেছিলেন। ড. প্রণব কুমার বডুয়ার বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি বৌদ্ধ সম্প্রদায় গ্রন্থের প্রথম অনুচ্ছেদে লিখেছেন, সে সময় বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত ৫৫ জন বৌদ্ধ যুবক ও ছাত্রদের ঠিকানাসহ একটি তালিকা প্রদান করেছেন।
অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়ে অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ বডুয়া বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। চট্টগ্রামের পটিয়ার ছতরপুটিয়া গ্রামের এই ব্যক্তিত্ব কংগ্রেসের প্রথমসারীর নেতা ছিলেন। এছাড়া চট্টগ্রাম পটিয়ার মৈতলা গ্রামের মহেন্দ্র লাল (চন্দ্র) বডুয়া, ধীরেন্দ্র লাল বডুয়া, তরনী বডুয়া, চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার ভুপেন্দ্রনাথ মুৎসুদ্দী (ভুপেন গান্ধী), আবুরখীলের পুলিন বিহারী বডুয়া, এডভোকেট সারদা প্রসাদ বডুয়া, বাঁশখালীর রাস বিহারী বডুয়া, রাউজান গহিরার নগেন্দ্র লাল বডুয়া, রাউজানের নোয়াপাড়া গ্রামের প্রবীণ বডুয়া ও রাঙ্গুনিয়ার নীরদবরণ তালুকদার প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ অসহযোগ আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন।
নীরদ বরণ তালুকদার ও ভুপেন্দ্র নাথ বডুয়া তিন মাস কারাবরণ করেন। নীরদ বরণ তালুকদার পÐিচেরীতে ঋষি অরবিন্দের আশ্রমে যোগ দিয়ে শেষ জীবন মানবতার সেবায় উৎসর্গ করেন। বিপ্লবী কর্মধারায় প্রথম অংশ নেন আবুখীলের মতান্তরে নোয়াপাড়ার প্রবীন বডুয়া তিনি কয়েকবার কারাবরণ করেন, শেষে বার্মায় গমন করেন। জানা যায় নেতাজীর সাথেও তার যোগাযোগ ছিল। পটিয়া থানার মৈতলা গ্রামের সন্তান মহেন্দ্র লাল বডুয়া ছিলেন অন্যতম সাহসী বিপ্লবী সন্তান। অন্যান্য বিপ্লবীদের মধ্যে রোহিনী বডুয়া, জ্যেষ্ঠপুরার ধীরেন্দ্র লাল বডুয়া, সাতবাড়িয়ার মহেশ বডুয়া, পান্থশালার নীরেন্দ্র বডুয়া, বৈদ্যপাড়ার জীবক বডুয়া, মিস নিরুপমা বডুয়া, ফটিকছড়ির বডুয়া, নিরঞ্জন বডুয়া ফাঁসি মঞ্চে আত্মহুতি দেন। মহেশ বডুয়া ধীরেন্দ্র লাল বডুয়া কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। মাদ্রাজে নৌ বিদ্রোহ অংশগ্রহণকারীর বিপ্লবী নিরঞ্জন বডুয়া ফাঁসি হয়। মহেশ বডুয়া ও নীরেন্দ্র চৌধুরীর দীপান্তর হয়। উল্লেখ্য যে, মহামুনির তালতলা পাহাড়, আবুরখীলের জেতবন বিহার, শাকপুরার ধর্মানন্দ বিহার ছিল বিপ্লবীদের গোপন মিলন কেন্দ্র। অনেক বিপ্লবী আবুরখীলের আশ্রয় নিয়েছিল। সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অনেকে যোগদান করেন। তন্মোধ্যে বৈদ্যপাড়ার প্রেম প্রসাদ বডুয়া, কর্তালার প্রেমানন্দ চৌধুরী (গ্রামের পরিচয় জানা যায়নি) ছয়মাস কারাদÐ হয়। অন্যান্যদের মধ্যে হাশিমপুরের অধ্যাপক প্রকৃতি রঞ্জন বডুয়া, পূর্ণেন্দু তালুকদার, আবুরখীলের ড. বিনয় বডুয়া, রাউজানের ভূপেন্দ্র লাল বডুয়া, রাঙ্গুনিয়ার ড. অরুণ চন্দ্র বডুয়া। অধিকন্তু নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন আবুরখীলের খগেন্দ্র লাল বডুয়া, অজিত বডুয়া (শ্রদ্ধানন্দ ভিক্ষু)। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে অনেকেই বিপ্লবী কর্মধারার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন তন্মোধ্যে সংঘনায়ক শ্রীমৎ আনন্দ মিত্র মহাথের, মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের এবং শ্রীমৎ বঙ্গীশ ভিক্ষুর নাম উল্লেখযোগ্য। বৌদ্ধদের মধ্যে স্বদেশে সংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের এবং বিদেশে পন্ডিত জ্যোতিঃপাল মহাথের প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ রাষ্ট্র জাপান, থাইল্যান্ড, কোরিয়া, শ্রীলংকা, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশসমূহ সফরপূর্বক মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করেন।
বাংলাদেশের বিভাগের ফলে বৌদ্ধদের বিরাট অংশ পূর্ববঙ্গে রয়ে গেল। তাঁরা মাতৃভূমির সর্ববিধ উন্নতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করলেন। দেশের প্রশাসনিক ব্যাপারেও তাঁদের যোগ্য স্থান ছিল। কেউ কেউ রাজ্যসভা ও বিধানসভা সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন এবং মন্ত্রীপদে অধিষ্ঠিত হয়ে যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। দেশের সুখ দুঃখ সম্পদে বিপদে বৌদ্ধরা সমান অংশগ্রহণ করে যান। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষা আন্দোলনে বহু কৃতি ছাত্র ছাত্রী ও বুদ্ধিজীবি সহযোগিতা ও নেতৃত্ব দিয়ে ইহাকে সাফল্যমন্ডিত করেছেন।
১৯৭০ সালে নির্বাচনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ ছয় দফা দাবীর ভিত্তিতে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে এই দাবীগুলিতে অন্ধ সা¤প্রদায়িকতা ছিল না। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার স্বীকৃত হয়েছিল। সেই কারণে দেশের প্রগতিশীল বিরাট অংশ আওয়াগী লীগকে সমর্থন করেন। বাংলার বৌদ্ধেরাও এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। চট্টগ্রামের রাউজান থানা বৌদ্ধ প্রধান অঞ্চল। এখানে মুসলিম লীগের কিছু ব্যক্তিও আছেন তাঁরা মুসলীম লীগ সমর্থনের জন্য বৌদ্ধদেরকে নানাভাবে পরোচিত ও ভয় প্রদর্শন করতে থাকে। বৌদ্ধেরা দৃঢ়তার সাথে ইহার প্রতিবাদ করেন এবং প্রতি আওয়ামীলীগ সমর্থন করেন। ফলে নির্বাচনের প্রাক্কালে গুজরা নয়াপাড়ার কয়েকখানি বৌদ্ধ গ্রাম আক্রান্ত হয়। এই সংঘর্ষের ফলে দুইজন বৌদ্ধ নিহত ও কয়েকজন আহত হন। অপর পক্ষেও কিছু হতাহত হয়েছে। শেখ মুজিবর রহমানের কাছে এই সংবাদ পৌঁছলে তিনি সহসা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন এবং নয়াপাড়া উচ্চ ইংরেজি স্কুল মাঠে বিরাট জনসভায় ঘোষণা করেন যে, বাংলাদেশ শুধু মুসলমানের নয়, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানেরও নয়; বাংলাদেশ জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালির। নির্বাচনে বিপুল ভোটাধিক্যে আওয়ামী লীগপন্থীরা সর্বত্র জয় লাভ করেছেন। আর মুসলীম লীগপন্থীদের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। ইহাতে মুসলীম লীগপন্থীদের অমুসলিম বিদ্বেষ আরো বৃদ্ধি পায়।
২৫শে মার্চ ১৯৭১ সন হতে বাঙালিদের উপর যে জঙ্গীশাহী আক্রমণ হয়েছে, তাতে প্রথম জাতি ধর্ম নির্বিশেষে নিধন কার্য চালায়। পরে সুপরিকল্পিতভাবে হিন্দু বৌদ্ধ ও আওয়ামীলীগ সমর্থকদের ধ্বংস করা হয়েছে। অপ্রস্তুত অবস্থায় বহু সংখ্যক বাঙালি এই আক্রমণে হতাহত হয়েছে। মা বোন মাতৃজাতিরা ধর্ষিত ও লুন্ঠিত হয়েছেন। ইতিমধ্যে বাঙালিরা আত্মরক্ষার্থে মুক্তিবাহিনী গঠন করে পাক সৈন্যদের অগ্রগতি রোধ করেন। এই বাহিনীতে বৌদ্ধ তরুণ-তরুণীরা প্রচুর পরিমাণে যোগদান করেন। মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণের ফলে বাংলাদেশের বৃহত্তর অংশ এখন শত্রুর কবল মুক্ত হয়েছে।
মুক্তিবাহিনীকে প্রতিহত করার নিমিত্ত জঙ্গী নেতারা নির্বাচনে পরাজিত মুসলিম লীগের সহায়তায় সমাজ বিরোধী লোকদেরকে নিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠন করেছেন। তাদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া হয়েছে। এই রূপে বাঙালিদের মধ্যে পরস্পর বিভেদ সৃষ্টি করেছে জঙ্গীশাহীরা শাসন ও শোষণ অক্ষুন্ন রাখার পরিকল্পনা করেছেন। ফলে সাত মাসে প্রায় দেড় কোটি বাঙালি হতাহত ও শরণার্থীরূপে ভারতে আশ্রিত হয়েছেন। তথাকার সংখ্যালঘু স¤প্রদায়সমূহ একেবারে নিশ্চিহ্ন হবার উপক্রম হয়েছে। বহু গ্রামে ও মন্দিরের বিপন্ন হিন্দু মুসলমানদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে এবং সুযোগ মত নিরাপদ স্থানে প্রেরিত হয়েছে সেজন্য রাজাকার ও পাক সৈন্যের সম্মিলিত আক্রমণে বহু বৌদ্ধ গ্রাম ধ্বংস হয়েছে। চট্টগ্রাম পটিয়া থানার সাতবাড়িয়া গ্রাম ও শান্তি বিহার আক্রান্ত ও লুন্ঠিত হয়েছে। জোয়ারা, সুচিয়া প্রভৃতি গ্রামও লুণ্ঠিত হয়েছে। এই রূপে ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, রাঙ্গুনিয়া, পটিয়া, সাতকানিয়া, সীতাকুন্ড ও মিরেরশ্বরাই থানার বৌদ্ধ বিহার ও গ্রাম বিধ্বস্ত ও লুন্ঠিত হয়েছে। কক্সবাজার, রামু, উখিয়া, চকরিয়া হারবাং, মহেশখালির বিহারও আক্রাস্ত ও লুণ্ঠিত হয়েছে। বুদ্ধমূর্তি ভগ্ন করা হয়েছে। অষ্টধাতুর বড় বড় বুদ্ধমূর্তি চুর্ণ-বিচুর্ণ করে লুন্ঠিত হয়েছে। বহুধর্মগুরু ও নর-নারী হতাহত হয়েছেন। এই সংগ্রামে অন্তত পঁচিশ সহস্র বৌদ্ধ নিহত ও লক্ষাধিক প্রতিবেশি রাষ্ট্রে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন। যতই সময় যাচ্ছে সংখ্যালঘু বৌদ্ধরা প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে। তথাপি বৌদ্ধ তরুণগণ দলে দলে মুক্তি বাহিনীতে যোগদান করে মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার নিমিত্ত আত্মনিয়োগ করছেন। শরণার্থী রূপে ভারতে গিয়ে বহু বৌদ্ধ তরুণ পুন মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেছেন। বহু তরুণের সম্মুখ সংগ্রামে শত্রæ নিধন করে শহীদের গৌরব অর্জনের করেছেন। তথাপি বহু যোদ্ধা সংগ্রাম চালিয়েছেন অসীম সাহসে। অনেক স্বেচ্ছাসেবী তরুণ বীর সৈনিক রূপে মুক্তি সংগ্রামে প্রবেশ করেছেন।
ধর্মাধার মহাস্থবির উল্লেখ করেছেন, ‘চট্টগ্রামের সাতবাড়িয়া গ্রামের শান্তি বিহার পাক সৈন্যরা গত আগস্ট মাসে লুঠ করে বিহারের মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে যায় এবং বৌদ্ধদের ধর্মগুরু সংঘনায়ক শ্রদ্ধেয় অভয়তিষ্য মহাস্থবিরের উপর অকথ্য নির্যাতন চালায়। এই রকম ঘটনা বাংলাদেশে পাক জঙ্গীশাহীর আমলে শত শত ঘটিয়াছে।’ মুক্তিযুদ্ধ কালীন পÐিত ধর্মাধার মহাস্থবির লিখেছেন, বাংলাদেশের বিজয়ে বাঙালি হিসাবে আজ আমরাও গর্বিত এবং সেই দেশের আনন্দযজ্ঞে আমরাও অংশীদার কারণ এই যুদ্ধ শুধু যুদ্ধ জয় কিংবা রাজনৈতিক জয় না, ইহা জয় নয়; মানবিকতার জয়, গণতন্ত্রের জয়, স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রের জয়। তাই আমরা আনন্দিত। দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে পূর্ববঙ্গে অসহায় নিরীহ জনসাধারণের উপর পশ্চিম পাকিস্তানীদের ঘৃণ্য শোষণ আমাদের বার বার ব্যথিত করেছে। অসহায়ের মতো আমরা লক্ষ্য করেছি কেমন করে একটি প্রাণবন্ত জাতিকে নির্দয়ভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। তাই ২৫শে মার্চ পাঁচ জঙ্গী শাসনের নৃশংস অত্যাচারের পর বৌদ্ধরা সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছিল।
বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তি সংগ্রামীদের সঙ্গে। কলকাতায় বৌদ্ধদের মুখপত্র নালন্দার মাধ্যমে পাক শাসকদের বিরুদ্ধে ক্রোধ ও ঘৃণা এবং পূর্ববঙ্গের অসহায় নরনারীদের প্রতি সহানুভূতি জানিয়েছেন। নালন্দা পত্রিকার পঞ্চম বর্ষপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠানে এক প্রস্তাবে পূর্ববঙ্গের ইয়াহিয়া সরকার যে ধ্বংসলীলা চালায়া তার তীব্র নিন্দা করে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব উ থান্টকে ঐ নরমেধ যজ্ঞের অবসান ঘটাতে অনুরোধ করা হয় এবং বিভিন্ন বৌদ্ধ ও মিত্র রাষ্ট্রের প্রধানদের পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টির জন্য অনুরোধ করা হয়। তাছাড়া আগস্ট মাসে নয়াদিল­ীতে বাংলাদেশের সমস্যাসমূহ আলোচনা করার জন্য নিখিল ভারত বৌদ্ধ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য হতে প্রায় ৩০০জন প্রতিনিধি এই সম্মেলনে যোগদান করে বাংলাদেশের মুক্তিকামী সংগ্রামরত জনসাধারণের সমর্থনে এবং ইয়াহিয়া সরকারের জঘন্য বর্বরতার নিন্দা জ্ঞাপক পাঁচটি প্রস্তাব সভা সর্বস্মতিক্রমে গৃহীত হয়। বস্তুত বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম এপারের অগণিত বৌদ্ধদের প্রচন্ডভাবে উদ্দীপিত করেছে। তাই ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের সংবাদে এখানকার বৌদ্ধরা আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠেন। যুদ্ধের অব্যবহিত পরে থাইল্যাÐের ব্যাংকক শহরে আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ যুব সংঘের সমগ্র এশিয়ার বৌদ্ধদের উপর অত্যাচার এবং বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের বিরুদ্ধে একটি নিন্দাসূচক প্রস্তাব গৃহীত হয়। ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর নিরাপদ প্রত্যাবর্তন ও বাঙালি বৌদ্ধদের পক্ষ হতে তাঁকে অভিনন্দন জানানো হয়।
বাংলার মুক্তি সংগ্রামে হিন্দু মুসলমানের ন্যায়স্থানীয় বৌদ্ধদের ভূমিকা খুবই গৌরবজনক। গোড়ার দিকে প্রাক ফৌজ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে গণহত্যা চালিয়ে যায়। বৌদ্ধদেশ চীন পাকিস্তানের বন্ধু। চীন ও অপর বৌদ্ধদেশগুলো সৌহার্দ্য লাভের মানসে মাঝখানে পাক সৈন্যেরা বৌদ্ধদের ‘চাইনিস বুদ্ধিস্ট’ আখ্যা দিয়ে অত্যাচার হতে রেহাই দিতে চাইলে বৌদ্ধরা তার পুন সুযোগ গ্রহণ করলেন। প্রতিটি বৌদ্ধ গ্রাম বিপন্ন হিন্দু মুসলমানের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠল। এই সকল আশ্রয়স্থান হতে শরণার্থীদের সন্তর্পণে ভারতের দিকে প্রেরণ করা হয়। তাদের যাত্রাপথে মানিকছড়ির মানরাজ বাহাদুর সহস্র সহস্র শরণার্থী ও মুক্তিবাহনীর সেবার নিমিত্ত তার রাজকোষ উন্মুক্ত করে দেন। শরণার্থীরা নিরাপদে ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। বৌদ্ধ গ্রামগুলি মুক্তিবাহিনীর দুর্গে পরিণত হয়। এসব গ্রামে আত্মগোপন করে মুক্তিবাহিনী তাদের সংগ্রাম চালাতে থাকেন। দলে দলে বৌদ্ধ যুবক যুবতী মুক্তি বাহিনীতে যোগদান করে সংগ্রাম করেন। দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়ার পর্বতবেষ্টিত অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বৌদ্ধধর্মীয় নেতারা প্রত্যেক বৌদ্ধকে পরিচয় পত্র দেবার নির্দেশ দিলে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে লোককে সম্ভাব্য মৃত্যু হতে রক্ষার নিমিত্ত পরিচয়পত্র দিতে থাকেন। এই সুযোগে অনেক বৌদ্ধ পাক ফৌজের কোপ দৃষ্টি এড়িয়ে ভারতে চলে আসেন। দেশ দ্রোহীদের মাধ্যমে এই সংবাদ পাক সৈন্যদের নিকট পৌঁছলে আবার বৌদ্ধ গ্রামের উপর নিষ্ঠুর অত্যাচার চলতে থাকে। বহু ঘরবাড়ী ভস্মীভূত হয়, বৌদ্ধ বিহার লুণ্ঠিত ও ধ্বংস করা হয়। বহু বৌদ্ধ ও ধর্মগুরু হতাহত ও নিখোঁজ হন। কিন্তু এই অত্যাচার বেশিদিন চলতে পারেনি ততদিনে পূর্ব পাকিস্তানে পতন ঘটেছে।
শরণার্থী ও ভারতীয় বৌদ্ধদের পক্ষ হতে স্বাধীন বাংলার স্বীকৃতি ও সাহায্যের নিমিত্ত ব্যাপক আন্দোলন চালায়। ভারতে অবস্থিত বৌদ্ধদেশগুলির কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের মাধ্যমে বিশ্বের বৌদ্ধদেশগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। জাতিসংঘে দাবী করা হয়েছে। শরণার্থী বৌদ্ধ নেতা জ্যোতিঃপাল মহাথের প্রমুখ নেতৃবৃন্দ সিংহল, থাইল্যাণ্ড, জাপান, হংকং প্রভৃতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধদেশগুলোতে প্রচার কার্য চালিয়েছেন। এই প্রচারের ফলে সেই সকল দেশবাসীর মানবীয় বিবেক জাগ্রত হয়েছে। বাংলাদেশে নৃশংস হত্যাকান্ডের নিমিত্ত পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে জনগণ সোচ্চার হয়েছে এবং স্বাধীন বাংলার প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন। মুক্তি সংগ্রামের সকল বিভাগে বৌদ্ধরা সক্রিয় ছিলেন। দীপ্তশ পথ নেন জন্মভূমি শত্রু মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত এই সংগ্রাম করবেন। সকলের সমবেত প্রচেষ্টায় স্বাধীন বাংলা অচিরেই শত্রুমুক্ত হয়।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের বাঙালি বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অনন্য অসাধারণ ভূমিকা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল পাকসেনাদের দ্বারা অধিক আক্রান্ত। বিশেষ করে চট্টগ্রামের কালুরঘাট, কর্ণফুলি, চট্টগ্রাম সদর, হাটহাজারী, রাউজান, কাপ্তাই, পটিয়া, আজিজনগর, চকরিয়া, রামু, কক্সবাজার, টেকনাফ প্রভৃতি স্থানে পাকসেনারা বোমা নিক্ষেপ করে। বিভিন্ন জেলায় পাক বাহিনীর অতর্কিত নৃশংস আক্রমণে বৌদ্ধরা ব্যাপক নির্যাতিত, নিপীড়িত ও নিহত হয়েছেন। কোন কোন জেলায় সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের লোকেরা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ে ছিল। বৌদ্ধরাও পূর্ববঙ্গের বাংলাদেশের একটি সংখ্যালঘু স¤প্রদায়। তাঁরা প্রধানত বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, কুমিল্লা প্রভৃতি জেলায় বসবাস করেন।
পÐিত জ্যোতিঃপাল মহাথের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি ও ভয়াবহতা বিষয়ে ভারতের আগরতলায় ১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল সকাল ১০ টায় একটি জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলন করেন। সংবাদ সম্মেলনে বৌদ্ধ নেতৃবৃন্দ, ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা- শ্রী গোপাল ভূষণ চাকমাসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। এ সময় আকাশবাণী, আনন্দবাজার, যুগান্তর এবং অন্যান্য আঞ্চলিক গণমাধ্যমের সাংবাদিকগণ উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, “পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক বাঙালি বৌদ্ধদের উপর নৃশংস অত্যাচার, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যা পরিচালিত হয়। … পরবর্তীতে তিনি ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শ্রী শচীন্দ্র লাল সিংহ, অর্থমন্ত্রী শ্রী কৃষ্ণ দাস ভট্টাচার্য এবং মুখ্যসচিব ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে স্বাক্ষাৎকারে মক্তিযুদ্ধের দুঃখজনক ইতিহাস তুলে ধরেন। … এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে তিনি জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট, বিশ্ব বৌদ্ধ সৌভ্রতুত্ব সংস্থা-ব্যাংককের সভাপতি রাজপুত্র পুন-পিসমাই-দিসকুল এবং মহাসচিব মি. ইয়েম সংঘবাসী, শ্রীলংকার রাষ্ট্রপতি শ্রীমাভো বন্দর নায়েক, বিশ্ব বৌদ্ধ সৌভ্রাতৃত সংস্থার সকল আঞ্চলিক কেন্দ্র এবং বৌদ্ধ পরিষদে বাংলাদেশে নৃশংস গণহত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের রিপোর্ট প্রেরণ করেন।”
পণ্ডিত জ্যোতিঃপাল মহাথের উল্লেখ করেন যে, `Moveover, the last day I and Mr. K M Shahabuddin went to Parliament house to meet with Ministers and Members of the Parliament presented the exact scene about the success in freedom of occupied Bangladesh and made an application to stop the landing of Pakistani flight in Sinhala Airport. As a result, Srilankan Prime Minister Mrs. Bander Nayek to stop the landing of Pakistani flight in Colombo Airport. All directions such as north south, east west, and water-land-air were closed for Pak occupied force.`
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, পাক সৈন্যের আক্রমণে বৌদ্ধদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। চট্টগ্রাম ও ঢাকা শহরে জীবিকার নিমিত্তে অনেক বৌদ্ধ বাস করতেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ উচ্চ সরকারি-বেসরকারি চাকুরিজীবী, শিক্ষক, অধ্যাপক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, ব্যবসায়ি প্রভৃতি ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই পাক সেনার প্রথম আক্রমণে নিহত, আহত ও নিখোঁজ হয়েছেন। চট্টগ্রাম ও ঢাকার বৌদ্ধ বিহার লুন্ঠিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৌদ্ধদের অনেকের বাড়ি-ঘর ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ছিল। অনেকে পুরুষানুক্রমে শহরবাসী। তাঁদের বাড়ি-ঘর, দোকান-কারখানা লুন্ঠিত ও ভস্মীভূত হয়েছে। চট্টগ্রামের অনাথবাজার বৌদ্ধ বিহার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, একজন প্রসিদ্ধ ধর্মগুরু বোমার আঘাতে আহত হয়েছেন। চট্টগ্রাম শহরের নিকটবর্তী চাঁনগাঁও গ্রাম সুপ্রাচীন বৌদ্ধগ্রাম। এতে অনেক বৌদ্ধদের বাড়ি দুইটি বৌদ্ধ বিহার লুণ্ঠিত ও ভস্মীভূত হয়েছে, অনেকে নিহত হয়েছেন। ঐ গ্রাম জনশূন্য শ্মশানে পরিণত হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধকালীন  পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির লিখেছেন, হাটহাজারী থানার জোবরা গ্রাম পাক সেনাদের আক্রমণে বিপন্ন হয়েছে, বাড়ী ঘর লুণ্ঠিত ও এখানকার বিহারটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। গোলার আঘাতে কয়েকজন নিহত হয়েছেন। অবশিষ্টেরা পলাতক। এর দুই মাইল দূর মিরেরখীল গ্রামেও একই অবস্থা। মির্জাপুর এক বর্ধিষ্ণু বৌদ্ধগ্রাম। একদিন অবাঙালি একদল লোক তথাকার হিন্দুদের বাড়ী ঘর লুট করে বৌদ্ধদের বাড়ীঘর লুট করতে থাকে। তারা পুরাতন শান্তিধাম বিহারের শ্বেত পাথরের বুদ্ধমূর্তি ভেঙ্গে ফেলে। তরুণগণ প্রবল বাধা দিলে দুবৃত্তরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। কয়েক ঘণ্টা পরে তারা হাটহাজারী হতে পাক সেনাদের সঙ্গে নিয়ে পুনরায় আক্রমণ করে। সৈন্যরা বিহারের একটি ঘর জ্বালিয়ে দেয়। এই সময় একজন প্রৌঢ় তথায় এসে তাদেরকে অনুরোধ করেন যে, তাঁরা পাকিস্তানের অনুগত প্রজা, তাঁদের উপর এই অত্যাচার কেন? বার্মার প্রধানমন্ত্রী উ. নূর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের এক বাঁধানো ছবি প্রদর্শন করেন। ইহাতে সৈন্যরা সন্তুষ্ট হন এবং বৌদ্ধদের উপর অত্যাচার না করার জন্য অবাঙালিদের নির্দেশ দেন। তখন হতে বৌদ্ধদের নিরাতঙ্কে থাকার আশ্বাস দিয়ে যান কিন্তু তার চার দিন পরে একদিন হঠাৎ সৈন্যসহ তারা গ্রামে লুঠতরাজ রাউজান থানার গহিরা গ্রামের লুম্বিনী কানন বিহার পাক বোমায় ধ্বংস হয়েছে। রাঙ্গামাটি রোডের দুই পার্শ্বে বৌদ্ধদের বহু বাড়ি-ঘর ভস্মীভূত হয়েছে। কয়েকজন লোক মেশিন গানের গোলায় আহত ও নিহত হয়েছেন। পার্শ্ববর্তী বরজ্ঞান বিহার আক্রান্ত হয়েছে। বুদ্ধমূর্তিভগ্ন ও ভিক্ষুর উপর আঘাত করেছে, ভিক্ষু ও গৃহীগণ গ্রাম ত্যাগ করেছেন। এই সুযোগে মুসলিমলীগপন্থীরা বৌদ্ধদের গৃহপালিত পশুপাক্ষী ধান চাউল তৈজস পত্র লুঠ করেছেন, অনেক গৃহ জ্বালিয়ে দিয়েছেন। বিনাজুরী বিশিষ্ট বৌদ্ধ গ্রাম। নিঃস্ব হিন্দুদেরকে আশ্রয় দেওয়ায় তারা মুসলিমলীগপন্থীদের বিদ্বেষভাজন হন। তথাকার বিহার ও গৃহ আক্রান্ত হয়। রাউজানের আবুরখীলেরও একই অবস্থা।
হোয়ারাপাড়া সুদর্শন বিহার লুণ্ঠিত বুদ্ধমূর্তি ভেঙ্গে ফেলা হয়। বুদ্ধের পুতাস্থি অপহৃত হয়েছে। মহামুনি পাহাড়তলী গ্রামের পার্শ্বে কলেজে পাক সেনারা ঘাটি করেছে। গ্রামবাসী নির্যাতিত সতত সন্ত্রস্ত। একজন শিক্ষিত তরুণ ভিক্ষু পাক বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়। অনেক শিক্ষিত তরুণ ও বুদ্ধিজীবী দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়। পার্শ্ববর্তী রাঙ্গুনিয়ার সৈয়দবাড়ি, ইছামতি ও নজরের টিলার অনেক ঘর লুন্ঠিত ও ভস্মীভূত হয়েছে। লোকজন পাহাড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে। বোয়ালখালি থানার শাকপুরা গ্রামে দুইজন শিক্ষিত বৌদ্ধকে বিহারের বুদ্ধমূর্তির সম্মুখে হত্যা করা হয়। লোকের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়। পটিয়া, সাতকানিয়া থানার বহু শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত লোক হতাহত ও নিরুদ্দিষ্ট হয়েছেন। দক্ষিণ চট্টগ্রামের কক্সবাজার, রামু ও উখিয়া পালং অঞ্চলের অনেক বৌদ্ধ নিহত, গ্রাম লুণ্ঠিত ও ভস্মীভূত হয়েছে। প্রায় বিশ হাজার বাঙালি বৌদ্ধ আরাকানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তথায় মানবোচিত সৌজন্য অভাবে কিছু সংখ্যক ফিরে আসতে বাধ্য হন, কিন্তু স্থানীয় মুসলিম লীগের অত্যাচারে আবার তারা বাস্তুচ্যুত হন।
পন্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির লিখেছেন, ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডের পার্শ্বে সীতাকুন্ড, বারবকুন্ড কাঠগড় ও পান্থশালা গ্রাম আক্রান্ত ও ভস্মীভূত হয়। গ্রাম ছেড়ে লোকজন পালিয়ে যান। মিরেরশ্বরাই থানার জোরারগঞ্জ ধ্বংস হয়। এখানে নারী নির্যাতনে অসম্মত বালুচ সৈন্যের সাথে পাঞ্জাবিদের সংঘর্ষ হয়। উভয় পক্ষে গুলি বিনিময় হয়। নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলার ১৮/২০ টি গ্রাম বিহারসহ আক্রান্ত হয়েছে। বহুলোক হতাহত, ভিক্ষুরা নির্যাতিত। অবশিষ্ট সহস্র লোক কোন প্রকারে প্রাণ নিয়ে ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। ঐ দুই জেলা একেবারে বৌদ্ধশূন্য হয়েছে। বরিশালে আদিবাসী রাখাইন বৌদ্ধদের উপর ভীষণ অত্যাচার-নির্যাতন করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা বৌদ্ধ প্রধান অঞ্চল। এর শতকরা ৯৭ ভাগ বৌদ্ধ ছিল। ইহার তিন পার্বত্য জেলায় তিনজন বৌদ্ধ রাজা রাজত্ব করেন। উত্তরে রামগড়ের মানরাজা পাকসেনার আক্রমণে ৬/৭ সহস্র উপজাতীয় প্রজাসহ ত্রিপুরায় শরণার্থী হয়েছেন। তাঁর রাজধানী মানিকছড়ি পাক সৈন্য অধিকার করেছেন। কিন্তু সামরিক কর্তৃপক্ষ চাকমা রাজাকে প্রলোভনে ভুলিয়ে প্রাক সামরিক তৎপরতা সমর্থন করান। দক্ষিণে বান্দরবানের বোমাং রাজা-প্রজা প্রায় পঞ্চাশ সহস্রের মত আরাকানে ও ভারেতে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন। পাক সৈন্যদের অমানুষিক অত্যাচারে পূর্ববঙ্গের প্রায় লক্ষাধিক বৌদ্ধ হত, আহত নিরুদ্দিষ্ট ও পলাতক হয়েছেন। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের ওপর এই আক্রমণ চললেও সংখ্যালঘু বৌদ্ধ সমাজের অস্তিত্ব ভীষণভাবে বিপন্ন হয়েছে। কক্সবাজার জেলার বৌদ্ধরা মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন ভাবে আক্রমণের স্বীকার হয়েছেন। অনেক বৌদ্ধ বাড়ি ও বিহারে পাকসেনারা আক্রমণ করেছে; বৌদ্ধ নারী-পুরুষ নির্যাতিত হন। এ সময় চকরিয়া, রামু, উখিয়া, মহেশখালী অঞ্চলের বহু বডুয়া ও রাখাইন বৌদ্ধ সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ করেন আবার অনেকে নির্যাতনের ফলে ছেলে-মেয়ে-স্ত্রীসহ প্রাণভয়ে ব্রহ্ম দেশে আশ্রয় গ্রহণ করে।
সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা মূলত দুইটি দলে বিভক্ত ছিল। একটা হল এফ এফ (ফ্রীডম ফাইটার) মুক্তিবাহিনী, যারা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রাধীন এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানীর অনুগত বাহিনী আর অন্যটি হল বিএলএফ (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স) মুজিববাহিনী নামে পরিচিত। ড. প্রণব কুমার বডুয়ার মতে, মুক্তিযোদ্ধা চার প্রকারের-(ক) যারা ট্রেনিং নিয়ে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিল, (খ) যারা দেশের অভ্যন্তরে থেকে ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছিল, (গ) যারা অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল, (ঘ) যারা ভারতে আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপক্ষে মতামত সংগ্রহ এবং কাজ করেছিল। সে হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা অনেক। তবে বিশিষ্ট কয়েকজনের কথা এখানে উল্লেখ করা হলো- বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে রাউজান থানার লাঠিছড়ির নৃপেন্দ্র লাল বডুয়া (সম্মুখ যুদ্ধের অপারেশন এলাকা নোয়াখালী ও মিরেরসরাই), ডাবুয়ার অনিল বডুয়া (সম্মুখ যোদ্ধা), বাগেয়ানের জিনু বডুয়া, আবুরখীলের বোধিপাল বডুয়া (ফেনী বর্ডারের কাজ করতেন) ও নীতিশ বডুয়া (ইস্টার্ণ সেক্টরে মুজিব বাহিনীর প্রধান আব্দুর রবের নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছেন), মিরেরসরাইয়ের বীর সিন্ধু বডুয়া (লে: রফিকের অধীনে যুদ্ধ করেন) ও সুকুমার বডুয়া (১নং সেক্টরের প্লাটুন কমাÐার শরফুউদ্দীনের সাথে যুদ্ধ করেন) সুরঙ্গ গ্রামের ফণীন্দ্র লাল বডুয়া, সুনীল বডুয়া, বিপতী বডুয়া, হিঙ্গলার স্বপন বডুয়া, প্রদীপ বডুয়া, রাউজানের সন্তোষ বডুয়া সকলেই সম্মুখ যোদ্ধা ছিল এবং মেজর ছোবাহানের অধীনে যুদ্ধ করেন আনন্দ বডুয়া, ক্যাপ্টেন সুজিত আলী, সুযুর সিং গুলিয়া, লে: কর্ণেল কে কুমারের অধীনে সিলেটে যুদ্ধ করে। এছাড়া জোবরার মতিলাল বডুয়া, গহিরার সুমঙ্গল বডুয়া, খৈয়াখালীর বীরেন্দ্র লাল বডুয়া, আব্দুল্লাহপুরের সম্বোধি প্রসাদ বডুয়া, বিপুল বডুয়া, কোঠেরপাড়ের ভারত বডুয়া, পদুয়ার অমিয় বডুয়া ও কল্যাণমিত্র বডুয়া, রাউজান থানায় এফ এফ  গ্রুপ কমান্ডার আহসান উল্লাহ চৌধুরী এর অধীনে আলোজ্যোতি বডুয়া; এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার মোহাম্মদ হাশেম এর অধীনে সুনীল বডুয়া; এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার প্রভাকর বডুয়া। বোয়ালখালী থানার এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার মো. মাহাবুবুল আলম, সদস্য শ্রীপুরের প্রশান্ত বডুয়া, জ্যেষ্ঠপুরার খোকা বডুয়া; বি এল এফ গ্রুপ কমান্ডার রাজেন্দ্র প্রসাদ চৌধুরী, সদস্য গোমরদন্ডীর শরৎ বডুয়া; ক্যাপ্টেন করিম এর নেতৃত্বাধীন গ্রুপ কমান্ডার ডা. অমল বডুয়া, বৈদ্যপাড়ার সুকুমার বডুয়া চৌধুরী বাবুল, সারোয়াতলীর বিন্দু বডুয়া, রাউজান পাহাড়তলীর জগদানন্দ বডুয়া ও জীবনানন্দ বডুয়া, সুবর্ণ ভদ্র মুৎসুদ্দি, রনজিত বডুয়া। রাঙ্গুনিয়া থানায় বি এল এফ গ্রæপ কমাÐার সালেহ আহমদ এর অধীনে সদস্য সুজন বডুয়া; এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার খোদাবক্স- প্লাটুন কমান্ডার পদুয়ার অমিয় বডুয়া, সদস্য মরিয়ম নগরের রাজু বডুয়া ও সুধন বডুয়া, পারুয়ার কেপু বডুয়া, পদুয়ার স্বপন বডুয়া এবং সুদত্ত বডুয়া।
পটিয়া থানার ১৯৭০ সালে এমপি ও সংগঠক সুলতান আহমদ কুসুমপুরীর উদ্যোগে গঠিত বাহিনীতে ছিলেন ‘এ’ কোম্পানী, প্লাটুন  কমান্ডার হাবিলদার আবুল হোসেন সদস্য সাতকানিয়ার সাধন বডুয়া; ‘বি’ কোম্পানী, প্লাটুন  কমান্ডার হাবিলদার সুজায়েত হোসেন সদস্য পরেশ বডুয়া, এফ এফ গ্রুপ লিডার আবদুল লতিফ হাবিলদার, সদস্য অমিয় বডুয়া, অনিল বডুয়া, মিলন বডুয়া, দুলাল বডুয়া, রাজমোহন বডুয়া; এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার শাহ আলম, সদস্য সুজিত বডুয়া, সুরক্ষিত বডুয়া, প্রিয়তোষ বডুয়া; এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার আবু ছৈয়দ, সদস্য সুনক্ত বডুয়া; এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার সিরু বাঙ্গালী, সদস্য হুলাইন এর মানবেন্দ্র বডুয়া মানু, ঠেগরপুনির তাপস রঞ্জন বডুয়া। সাতকানিয়া থানার এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার আবু তাহের খান খসরু সদস্য সাতকানিয়ার জামিজুরির অনিল বডুয়া ও সাধন বডুয়া, মানিক বডুয়া, মৃণাল বডুয়া; এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার আ ক ম শাসুজ্জামান সদস্য সাতকানিয়ার মুক্তিমান বডুয়া, মনোজ বডুয়া, রতন কুমার বডুয়া প্রমুখ।
ফটিকছড়ির এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার মো. নুরুল গণির অধীনে সদস্য চাঁন্দু বডুয়া; এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার শেখ আবু আহমদ এর অধীনে সদস্য নানুপরের বাবুল বডুয়া, পাইন্দং এর সুনীল বডুয়া; গ্রুপ কমান্ডার তপন দত্ত এর অধীনে নেপাল বডুয়া, নাথুরাম বডুয়া, নরেশ বডুয়া, প্রকাশ বডুয়া, এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার ভারত বডুয়া প্রমুখ। সিতাকুন্ড পান্থশালার মানিক লাল বডুয়া, কুমিল্লা নোয়াখালির সোনাইমুড়ির ডিআইজি এস কে চৌধুরী, কক্সবাজারের উখিয়ার সুরক্ষিত বডুয়া, অমিয় কুমার বডুয়া, রামুর মাস্টার জ্ঞানেন্দ্র বডুয়া, দীপক কুমার বডুয়া, পরেশ বডুয়া, চকরিয়ার পরিমল বডুয়া, লোকনাথ বডুয়া, সাংবাদিক প্রিয়দর্শী বডুয়া প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম অগ্রগণ্য। বলা প্রয়োজন তাছাড়া আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছে যারা ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। গ্রাম ও অঞ্চলভিত্তিক মুক্তিযোদ্ধাদের নাম সংগ্রহ করে প্রকাশ করা এবং তাঁদের অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বহু বৌদ্ধ চাকুরিজীবী নিখোঁজ বৌদ্ধদের একটি তালিকা মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের তদানিন্তন সামরিক কর্মকর্তাদের কাছে পেশ করেছিলেন এবং তাদের উদ্ধারের জন্য আবেদন জানিয়ে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তাদের সংখ্যা ৪০ এর কাছাকাছি হবে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রাউজানের সুপতি রঞ্জন বডুয়া এম.এ (অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পাকিস্তান রেলওয়ে), চিত্তরঞ্জন বডুয়া (স্টোনো রেলওয়ে জামুয়াইন), ননী গোপাল বডুয়া এম.এ (আয়কর উকিল, লাখেরা), প্রকৌশলী প্রভাষ কুসুম বডুয়া এম.এ (লাখেরা), ইছামতি রাঙ্গুনিয়ার চিত্তরঞ্জন বডুয়া (সুপার টি এÐ টি, জোয়ারা) সে সময় টি এণ্ড টিতে যে সমস্ত বৌদ্ধ চাকুরি করতেন তারা অনেকেই নিখোঁজ হয় তাছাড়া বন্দরেরও অনেক বৌদ্ধ চাকুরিজীবী নিখোঁজ হয়।
মুক্তিযুদ্ধে বৌদ্ধ সমাজের প্রতিরোধ আন্দোলন ও ক্ষয়ক্ষতি সাধন
মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতি সাহস ও ঐক্যের মাধ্যমে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান জাতিবর্ণ নির্বিশেষে সবাই মিলেমিশে সেদিন পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, জীবন দিয়েছে স্বাধীনতার জন্য।
বাংলাদেশে জনসংখ্যার ক্ষেত্রে বৌদ্ধরা খুবই স্বল্প। তা সত্তে¡ও স্বাধিকার আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বৃহত্তর জনগোষ্ঠির সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বৌদ্ধ জনগণও নিঃস্বার্থভাবে দেশ ও জাতির স্বার্থে কাজ করেছে। সাম্যবাদী ও জাতীয়াতাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে বৌদ্ধরা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৌদ্ধরা পালন করেছে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা। ধর্মীয় বিষয়ানুভূতিতে নয়; মাতৃভূমিকে ভালবেসে বাঙালি বৌদ্ধসমাজ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো। কেউ অস্ত্র হাতে রণাঙ্গণে যুদ্ধ করেছে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে, কেউ সংগঠক হিসেবে কাজ করেছে, কেউ প্রবাসী সরকারের কর্মকর্তা হিসাবে কাজ করেছেন, কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের ও শরণার্থীদের আশ্রয়, সাহায্য দিয়েছে কিংবা সক্রিয় যুুদ্ধে অংশ নিয়েছে। বৌদ্ধরাও জীবন দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে, ইজ্জত দিয়েছে, ধন-সম্পদ হারিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তাদের মঠ, মন্দির, বিহার, চৈত্য। সে হিসেবে বৌদ্ধদের ত্যাগ তিতীক্ষা ও অবদান কম নয়।
পণ্ডিত জ্যোতিঃপাল মহাথেরকে বাংলাদেশের তথ্য মন্ত্রণালয় মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক বৌদ্ধদের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার বিবরণ প্রস্তুত করার জন্য আহŸান জানান। তিনি উল্লেখ করেন যে, ‘তদন্তের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বৌদ্ধ গ্রাম সীতাকুন্ড ও মিরেরসরাই থানা পরিদর্শন এবং তথ্য সংগ্রহ করেন। দ্বিতীয় পদক্ষেপ হিসেবে কুমিল্লা, নোয়াখালী, সোনাইমুড়ি ও অন্যান্য গ্রামের মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের নাম ও ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ি-ঘর, বৌদ্ধ বিহার, বুদ্ধমূর্তির ছবি সংগ্রহ করেন। এই ক্ষয়ক্ষতি ও আর্থিক মূল্যের পূর্ণ বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। তৃতীয় পদক্ষেপে তথ্যচিত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তথ্য মন্ত্রণালয়ের দু’জন ক্যামেরাম্যানসহ মিরেরসরাই, সীতাকুÐ, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, সাতকানিয়া, চকরিয়া, রামু, উখিয়া, কক্সবাজার, মহেশখালী, নীলাদ্বীপ এবং বার্মা বর্ডার, টেকনাফ, রামগড়সহ বিভিন্ন এলাকায় পনের দিন ধরে পরিদর্শন করে তথ্য ও আলোকচিত্র সংগ্রহ করেন। এসব তথ্য তিনি তথ্য মন্ত্রণালয়ে জমা প্রদান করেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন যে, `The amount of losses of Buddhist Community in currency at least 5 crore takas. At least 20 Buddhist temples were burbed to ashes. Thousands of women were raped. Thousands of houses were burned to ashes.’
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে মৃত্যুবরণ করেছে ৫ হাজার বাঙালি বৌদ্ধ, (পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি বৌদ্ধ ও কক্সবাজার, বরগুণা ও পটুয়াখালীর রাখাইন বৌদ্ধ নিহত হয় প্রায় ২-৩ হাজার, আহত হয় ২ হাজার), আহত হয়েছে ৪ হাজারের বেশি, ধর্ষিতা হয়েছে ১ হাজারেরও বেশি বৌদ্ধ নারী, বিনষ্ট হয়েছে তাঁদের ৫ কোটি টাকার ধনসম্পত্তি, ক্ষতিগ্রস্থ হয় ২০-২৫টির অধিক বৌদ্ধ বিহার, ভস্মীভূত হয় ১০টি বৌদ্ধ বিহার, বিধ্বস্ত হয় ১০০টির অধিক বুদ্ধমূর্তি, লুুন্ঠিত হয় শত শত বিহার, চুরি হয় বহু স্বর্ণ, রৌপ্য ও কষ্টিপাথরের মূর্তি ইত্যাদি ইত্যাদি। জানা যায় যে, একমাত্র কক্সবাজার জেলাতেই হানাদার বাহিনী একশত বুদ্ধমূর্তি বিধ্বস্ত করে, ৪টি বুদ্ধমূর্তি চুরি করে। ১৯৭১ সালের জুন মাসে মহেশখালীর রামার পাড় বিহার পুড়িয়ে দেয় এবং এতে ৪টি বুদ্ধমূর্তি বিধ্বস্ত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে শতকরা ৫০ ভাগ পল্লী পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও দেশীয় দোসররা জ্বালিয়ে দেয়। খাগড়াছড়ি মারিশ্যাতে তিন শত উপজাতীয় পুরুষকে হত্যা করা হয়। রাঙ্গামাটিতে ৪ শতের অধিক তরুণকে গুলি করে মারা হয়। উখিয়া থানার প্রায় বৌদ্ধ গ্রামের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে ৩০ জনের অধিক তরুণকে হত্যা করা হয়। উখিয়ার মহাজন বাড়িসহ বহু বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়, রামুতে ৪ জন বৌদ্ধ নেতার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু সংঘরাজ অভয়তিষ্য মহাথেরো এবং বহু শিষ্যদের উপর নির্যাতন চালানো হয়। কক্সবাজার, চকরিয়া হারবাং ও মহেশখালীর বহু বডুয়া ও রাখাইনের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং রাখাইন নারী পুরুষকে নানাভাবে নির্যাতন করা হয়। প্রায় শতাধিক তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়। অত্যাচার নির্যাতনে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীরা ভারতের ত্রিপুরা, আসাম, অরুণাচল ও অন্যান্য এলাকায় চলে যায়। অনেক রাখাইন চলে যায় বার্মায়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর বাঙালি বৌদ্ধরা বেশ কিছু স্থানে প্রতিরোধ গড়ে তোলে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে। চট্টগ্রামের রাউজান থানার আবুরখীল গ্রাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আবুরখীলে হিন্দু মুসলিমদের আশ্রয় দেয়। যার জন্য আবুরখীল গ্রামটি পাকিস্তানীদের শ্যেনদৃষ্টিতে পড়ে। এই এলাকা থেকে বৌদ্ধরা মদুনাঘাটে, ষোলশহর, কালুরঘাটে ই.পি.আর বাহিনী ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের খাদ্যদ্রব্য সরবরাহে বিভিন্নভাবে সাহায্যে সহযোগিতা করেছে। গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা সহায়ক সমিতি গঠন করে বৌদ্ধরা। সেখানে স্থাপিত হয় মিনি হাসপাতাল ডা. রেণুকনা বডুয়া বেশ কয়েকজন ডাক্তার নিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। গ্রামের বৌদ্ধ যুবকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে করেছে। আবুরখীল ছাড়াও পদুয়ার গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়ক ঘাটি গড়ে তোলা হয়। পদুয়ার জঙ্গলে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এক শক্তিশালী ঘাটি গড়ে তোলে সেখানকার বৌদ্ধ সমাজের লোকজনেরা। পাহাড়তলীর তালতলি পাহাড় ছিল অন্যতম নিয়োগদানের ও প্রশিক্ষণের কেন্দ্র। সংগীতাচার্য জগদানন্দ বডুয়া কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তাঁদের সাথে আর ছিল পাহাড়তলীর অনেক বৌদ্ধ যুবক। রাঙ্গুনিয়া থানার বেতাগী গ্রামের বৌদ্ধরাও একটি আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন করে। এখান থেকেই ক্যাপ্টেন করিম ও ক্যাপ্টেন আলম তাদের সেনাদের সুসংগঠিত করেন। উক্ত গ্রামের ডা. কিরণ চন্দ্র বডুয়া আহত মুক্তিসেনাদের চিকিৎসা করেন। কালুরঘাটের পূর্ব পাড়ে হাজারীচর ও কদুরখীলে গ্রামের বৌদ্ধরা অত্যন্ত সাহসী ও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মেজর জিয়া প্রথম কদুরখীলে অবস্থান করেন। এসময় তাঁকে সাহায্যে করেন শ্রীমৎ বোধিপাল মহাথের, ডা. বীরেন্দ্র লাল বডুয়া, বিমলেন্দু বডুয়া, ইন্দুভূষণ বডুয়া ও চিত্ত বডুয়া। এই কদুরখীল গ্রাম থেকেই মেজর রফিক তাঁর বাহিনীকে সংগঠিত করেন। এ সময় তাঁর সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন ডা. চারু চন্দ্র বডুয়া, ডা. রমেশ চন্দ্র বডুয়া, ডা. অরুণ কুমার বডুয়া চৌধুরী। জীবনের ঝুকি নিয়ে তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাজ করেন। এছাড়াও রাউজান থানার হোয়ারাপাড়া, বিনাজুরি, আধাঁরমানিক, ফতেনগর, পটিয়া থানার পিংগলা, কর্তালা, বেলখাইন এবং রাঙ্গুনিয়া থানার বেশ কয়েকটি গ্রামের বৌদ্ধ সমাজের লোকজনরা দুঃসাহসী ভূমিকা নিয়েছেন। তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন, আশ্রয় দিয়ে ও খাদ্য দিয়ে সাহায্যে করেছেন।
চট্টগ্রামের বাহিরেও কুমিল্লা, নোয়াখালী, ঢাকার বেশ কয়েকটি বৌদ্ধ এলাকার গ্রামগুলিতে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধাদের এবং শরণার্থীদের আশ্রয় কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলা হয়। এ প্রসঙ্গে অবশ্যই রাজধানী ঢাকা শহরের বৌদ্ধ বিহারের কথা উল্লেখ করতে হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতে ঢাকায় পাকিস্তানিদের হামলার পর ঢাকার বৌদ্ধ বিহারে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার নারী পুরুষ এসে আশ্রয় নেয়। এখানে প্রায় ৫ হাজার মানুষকে আশ্রয় দিয়ে তাঁদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করেন বৌদ্ধ নেতৃবৃন্দ। এই বৌদ্ধ বিহারের একটি গাড়ীতে চড়ে মুক্তিযোদ্ধারা যাতায়াত করতো। এসব কারণে হানাদারদের দ্বারা একদিন রাতে আক্রান্ত হয় এই বৌদ্ধ বিহার। দুষ্কৃতিকারীরা পÐিত বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরোর কক্ষে ঢুকে তাঁকে শাসায় এবং বেঁধে ফেলে। তারপর দু®কৃতিকারীরা চালায় লুটপাট। তারা বৌদ্ধ বিহার থেকে স্বর্ণের বুদ্ধমূর্তি, সোনার ফ্রেমের চশমা, টাইপরাইটারসহ আশ্রয়ার্থীদের জমা রাখা সোনাদানা ও অর্থ সম্পদ নিয়ে যায়। ২৫ মার্চ পাকিস্তানী আক্রমণের পর বাঙালিরা পাল্টা আক্রমণ এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধ শুরু হলে দেশের বৌদ্ধ এলাকার যুবকরাও যুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে ভারতে যান সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য। প্রশিক্ষণ শেষে ১১টি সেক্টরের বিভিন্ন রণাঙ্গণে তাঁরা যুদ্ধে লিপ্ত হয় পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে কতজন বাঙালি বৌদ্ধ অংশ নিয়েছিলেন তার কোন সুনির্দিষ্ট সংখ্যা দিতে না পারলেও এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বাংলাদেশের প্রতিটি এলাকা থেকে কমবেশি দু’চার থেকে দশজন বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। উল্লেখ্যযোগ্য অনেক নেতৃস্থানীয় বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধার নাম দেয়া যায় যারা জীবন বাজী রেখে দেশের মুক্তির জন্য বিভিন্ন রণাঙ্গণে লড়াই করেছেন। এ সমস্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আছেন আনন্দ বিকাশ বডুয়া, নৃপেন্দ্র লাল বডুয়া, নিরঞ্জন বডুয়া, বোধিপাল বডুয়া, সুকুমার বডুয়া, বীর সিন্দু বডুয়া, অনিল কুমার বডুয়া, সুনীল বডুয়া, প্রশান্ত বডুয়া, অজিত বডুয়া, মদন বডুয়া, অমিয় বডুয়া, বিপুল বডুয়া, অনুজ বডুয়া, সম্বোধি প্রসাদ বডুয়া, সাধন বডুয়া, সুরক্ষিত বডুয়া, পরেশ বডুয়া, প্রভাকর বডুয়া, বিজেন্দ্র লাল বডুয়া, ভারত বডুয়া প্রমুখ। সরাসরি সশ্রস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ ছাড়াও বেশ কিছু বাঙালি বৌদ্ধ নেতৃবৃন্দের মুুজিবনগর সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করেন। এ সমস্ত নেতৃবৃন্দের মধ্যে আছেন শ্রীমৎ জ্যোতিঃপাল মহাথের, অধ্যাপক ধর্মরক্ষিত মহাথের, শ্রীমৎ শান্তপদ মহাথের, ড. শাসন রক্ষিত ভিক্ষু, ডি পি বডুয়া, বীরউত্তম ধর্মদর্শী বডুয়া, প্রিয়তোষ বডুয়া, শীলব্রত চৌধুরী, পি আর বডুয়া, ড. বিকিরণ প্রসাদ বডুয়া, ড. প্রণব কুমার বডুয়া, ডা. অরবিন্দ বডুয়া, হেমেন্দ্র লাল মুৎসুদ্দি, অমিত প্রসাদ মুৎসুদ্দি, সুধাংশু বিমল বডুয়া, মিলন প্রভাস বডুয়া, সলিল বিহার বডুয়া, অরুন কুমার বডুয়া, ডা. বিকিরণ বডুয়া, ডা. রণজিত কুমার বডুয়া, মৃণাল কান্তি বডুয়া, অধ্যাপক জয়সেন বডুয়া, অধ্যক্ষ সুকোমল বডুয়া, নীলরতন বডুয়া, প্রণোদিত বডুয়া, সাংবাদিক ড. সঞ্জয় বডুয়া, সাংবাদিক শীলব্রত বডুয়া, সাংবাদিক বিপ্লব বডুয়া, উদয়ন বডুয়া, নলিনী রঞ্জন বডুয়া, স্বপন মুৎসুদ্দি, প্রকৌশল সরোজ কুমার বডুয়া প্রমুখ।
মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বিভিন্নভাবে ভারতে আশ্রয় নিয়ে যারা কাজ করেছেন তন্মধ্যে উল্লেখ্য হলে কথাসাহিত্যিক বিপ্রদাশ বডুয়া, সাহিত্যিক সুব্রত বডুয়া, প্রণোদিত বডুয়া, সাংবাদিক পার্থ প্রতিম বডুয়া, শীলব্রত বডুয়া, অনিল বড়য়া, বিপ্লব বডুয়া, ড. প্রণব কুমার বডুয়া এবং সুধাংশু বিমল বডুয়া কলকাতায় সাংবাদিক সম্মেলন করেন এবং আকাশবাণী কোলকাতা কেন্দ্রের মাধ্যমে একটি বিবৃতি প্রচার করেন। অন্যান্যদের মধ্যে সলিল বিহারী বডুয়া, প্রকৌশলী সরোজ কুমার বডুয়া, ডি আই জি শৈলেন্দ্র কিশোর চৌধুরী, বিমল প্রতাপ বডুয়া, জেলাজজ শীলব্রত বডুয়া, সাংবাদিক ড. সঞ্জয় বডুয়া, ডা. রনজিৎ কুমার বডুয়া, অধ্যাপক সরোজ কুমার বডুয়া, ডা: সামন্তভদ্র মুৎসুদ্দি, অধ্যাপক ধর্মরক্ষিত মহাথের, ড. শাসন রক্ষিত মহাথের এবং প্রয়াত শান্তপদ মহাথের প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ ভারতে আশ্রয় নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় কাজ করেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য তৎপর ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে বৌদ্ধদের গৌরবময় ভূমিকা পর্যালোচনা
১৯৭১ সালে ২৫ শে মার্চ এবং তৎপরবর্তীকালে পাকসেনা ও তাদের দোসরদের সশস্ত্র আক্রমণ থেকে বৌদ্ধরা রেহাই পায়নি। অনেক বৌদ্ধ বিহার ও বৌদ্ধ গ্রাম লুণ্ঠিত হয়েছে। কোন কোন স্থানে মেয়েদের সম্ভবরহানী ও লুন্ঠিত হয়েছে। এ সময় কেউ কেউ প্রাণভয়ে মিয়ানমার ও ভারতে আশ্রয় নেয়। কিন্তু এর মাঝেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে বাঙালি বৌদ্ধরা কোনো কোনো গ্রামে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তন্মধ্যে রাউজান থানার আবুরখীল গ্রামের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আবুরখীল গ্রামের বহু হিন্দু নরনারী আশ্রয় নেয়। এ গ্রাম থেকে মদুনাঘাট, ষোলশহর ও কালুঘাটে ইপি আর বাহিনীর ও মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য সরবরাহ করা হয়। গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং মিনি হাসপাতাল স্থাপন করে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতেন। এয়ার মার্শাল সুলতান মাহমুদের ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান এই গ্রামেই শহীদ হন এবং তাকে এখানেই করব দেয়া হয়। স্বাধীনতার পর এয়ার মার্শাল সুলতান মাহমুদ ছোট ভাইয়ের কবর জিয়ারতের জন্য আবুলখীল আগমন করেন। আবুরখীলে ক্যাপ্টেন সুলতান মাহমুদ তার দলবল নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। এ গ্রামে অবস্থান গ্রহণ করে মুক্তিযোদ্ধা রুমী, রশ্মি, কামাল, ইদ্রিস, মোজাম্মেল, চিত্ত ও কেদার বিভিন্ন দিকে যুদ্ধ পরিচালনা করে। সেপ্টেম্বর মাসে আবুরখীলের কেরানীহাটে রাজাকারদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘর্ষ হয়। এতে অনেক রাজাকার মারা যায়। এ যুদ্ধে বিকাশ বডুয়া শহীদ হন।
আবুরখিল ছাড়াও পাহাড়তলী ও পদুয়া গ্রামে প্রতিরোধ তৎপরতা দেখা যায়। পদুয়ার জঙ্গলে স্থাপিত হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম ঘাঁটি। পাহাড়তলী গ্রামের তালতলী পাহাড় ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম রিক্রুটিং ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সঙ্গীতাচার্য জগদানন্দ বডুয়া এ কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তাঁর সাথে পাহাড়তলী গ্রামের সাহসী যুবকেরা কাজ করেছিল। রাঙ্গুনিয়া থানার বেতাগী গ্রামের বৌদ্ধ পল্লীতে ক্যাপ্টেন করিম ও ক্যাপ্টেন আলম আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। এই গ্রামের ডা. কিরণচন্দ্র বডুয়া আহত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ট্রানজিট ক্যাম্প স্থাপন করে চিকিৎসা করেন। এভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বৌদ্ধরা প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং এদেশের বৌদ্ধ গ্রামগুলোতে মুক্তিবাহিনীর আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে উঠে। প্রতিটি বৌদ্ধ গ্রামের অপেক্ষাকৃত তরুণ বৌদ্ধ ছেলেরা মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করে এবং মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখে।
কক্সবাজার জেলার রামু, কক্সবাজার, পালং ও উখিয়ার বৌদ্ধ গ্রামগুলিতে পাকবাহিনী ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ১৯৭১ সনের এপ্রিল মে মাসে পাকবাহিনী রামুর একাধিক মহাজন বাড়ি, কক্সবাজার শহরের প্রখ্যাত হেডমাস্টার অমিয় কুমার বডুয়া, অমিতশ্রী বডুয়া ও সঞ্জয় বডুয়াদের বাড়ি এবং রতœা পালং এর অম্বিকা চরণ বডুয়া, সাবেক ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ধনঞ্জয় বডুয়ার বাড়ি, আনন্দ কুমার বডুয়ার বাড়ি এবং ভালুকিয়া পালং এর যোগেন্দ্র সিকদারের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেন। কক্সবাজার জেলার উখিয়া থানার দীপক বডুয়া প্রথমদিকে পাকসেনাদের গুলিতে নিহত হয়। তিনি একাত্তরের চট্টগ্রামে প্রথম শহীদ বলে জানা জানা যায়। উখিয়া থানার রূমখা পালং গ্রামের ভট্ট বডুয়াকে হাত পা বেঁধে পাকবাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। কক্সবাজার জেলার স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা মোজাম্মেল হক, মোস্তাক আহমেদ, এডভোকেট আহমেদ হোসেন, শমসের আলম চৌধুরীসহ অন্যান্য নেতৃবর্গ, সংসদ সদস্য ও দুবাইর সাবেক রাষ্ট্রদূত সরওয়ার ওসমান চৌধুরী, সাবেক ইপি আর সদস্য পুলিশ বাহিনীর সদস্য ও স্থানীয় যুবকদের সাথে বৌদ্ধরা পার্শ্ববর্তী মিয়ানমারে আশ্রয় গ্রহণ করে। এ সময় উখিয়ার জিতেন্দ্র লাল বডুয়া নোয়াখালী সরকারি কলেজে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আহবানে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদানের উদ্দেশ্যে তিনি অন্যান্য মুক্তি যোদ্ধাদের সাথে মিয়ানমারের মিলিত হয় এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। জিতেন্দ্রলাল বডুয়া তখন মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম সংগঠক ও সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করায় এবং সরকারি চাকুরিতে যোগদান না করায় পাক সরকার তাকে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করেন। কালুরঘাট যুদ্ধে আহত ক্যাপ্টেন হারুণকে আহত অবস্থায় মিয়ানমারে আনয়ন করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। মিয়ানমার সীমান্তের গভীর জঙ্গলে মিয়ানমারে আশ্রয় গ্রহণকারী ইপি আর পুলিশ ছাত্র যুবক মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে স্থানীয় বৌদ্ধ যুবকেরা মিলিত হয় ও সংগঠিত হয় এবং একের পর এক মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। উখিয়ার ড. সঞ্জয় বডুয়া ঢাকায় সাংবাদিকতা পেশায় জড়িত থেকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে লেখালেখি করেন। উখিয়া থানার ভালুকিয়া পালং এর জমিদার যোগেন্দ্র লাল সিকদার ৫০জন মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় এবং শতশত মুক্তিযোদ্ধার আহারের যোগান দিয়েছিলেন। সরকারি গেজেটের নামের তালিকা অনুসারে কক্সবাজার জেলার বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সুরক্ষিত বডুয়া, পরিমল বডুয়া, জয়সেন বডুয়া, সুনীল বডুয়া, ধীমান বডুয়া, অরবিন্দ বডুয়া, উদয়ন বডুয়া, মিলন বডুয়া, দিলীপ বডুয়া, রমেশ বডুয়া, আশীষ বডুয়া, কৃষ্ণপ্রসাদ বডুয়া ও খোকা বডুয়া’র নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কক্সবাজারের বাঙালি বৌদ্ধদের ভূমিকা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনেক বৌদ্ধ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে, অনেকে শহীদ হন, অনেকে আহত হয় এবং অসংখ্য নারী পুরুষ নির্যাতিত ও নিপীড়িত ও হত্যার স্বীকার হন। এ সময় কক্সবাজারসহ চট্টগ্রামের বৌদ্ধরা পার্শ্ববর্তী বৌদ্ধদেশ বার্মায় অনেকে আশ্রয় গ্রহণ করেন। পরে বার্মায় আশ্রিত বৌদ্ধরা সংগঠিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। কক্সবাজার জেলার বৌদ্ধদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন রামু মেরেংলোয়ার শশাংক বডুয়া ও কামিনী বডুয়া, উখিয়া পালং এর ভট্ট বডুয়া, পিতা কালীধন বডুয়া-উখিয়া ও মনীন্দ্র লাল বডুয়া উখিয়া, কক্সবাজারের শশী কুমার বডুয়া, পিতা মৃত সীননাথ বডুয়া, চকরিয়ার ক্ষীরোধ মোহন বডুয়া (মানিকপুর) প্রমুখ। কিন্তু জেলাভিত্তিক মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় মাত্র ১২ জনকে কক্সবাজার জেলার বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নামোল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও নাম না জানা অনেক মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে। কক্সবাজারের রাখাইন বৌদ্ধ সমাজের অনেক মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন।
ড. প্রণব কুমার বডুয়া তাঁর মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি বৌদ্ধ স¤প্রদায় গ্রন্থের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণকারী ৪৮ জন বৌদ্ধ শহীদের পরিচয় লিপিবদ্ধ করেছেন। এ অনুচ্ছেদে তিনি ৩৫জন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ও পরিচয় প্রকাশ করেন। তা ছাড়া এ গ্রন্থে তিনি জেলা ওয়ারী বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের যে তালিকা প্রদান করেন তাতে দেখা যায় চট্টগ্রাম জেলা ২৩২, কক্সবাজার জেলায় ১২, নোয়াখালী জেলা ৩২, কুমিল্লা জেলায় ০১, খাগড়াছড়ি জেলায় ০২, বান্দরবান জেলায় ০১ জনের নাম দেখা যায়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বৌদ্ধদের অনেকে অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়ে অফিস আদালত ও চাকুরিতে যোগদান থেকে বিরত ছিলেন। অনেকে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সাথে যোগাযোগ স্থাপন পূর্বক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছিলেন। তাঁরা ভারতের বিভিন্ন স্থানে সভায় ভাষণ দিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেছেন এবং পাক সেনাদের অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরেন। অনেকে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সাথে ও বুদ্ধিজীবিদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে জ্যোতিঃপাল মহাথের, বঙ্গিশ ভিক্ষু, বিশুদ্ধানন্দ মহাথের, এস ধর্মপাল মহাথের, জিনানন্দ মহাথের, কুমিল্লার ধর্মরক্ষিত মহাথের, সংঘরক্ষিত ভিক্ষু, পূর্ণানন্দ মহাথের ও চট্টগ্রামের শান্তপদ মহাথের জাতিসংঘের মহাসচিব থেকে শুরু করে বিশ্ব বৌদ্ধ ফেলোশিপ (ডঋই) এর মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সমর্থন কামনা করেন।
প্রণোদিত বডুয়া, বিপ্রদাশ বডুয়া, সুব্রত বডুয়া ও রনধীর বডুয়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। পার্থ প্রতিম বডুয়া ভারতের সাপ্তাহিক ‘অমর বাংলা’ প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেন। বিপ্লব বডুয়া নামে আরেকজন সাহিত্যিক বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত ছিলেন বলে জানা যায়। তাঁর প্রচারিত কথিকা মুক্তাঞ্চলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রচারিত হয় বলে স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের ৫ম খÐে বর্ণিত আছে। স্বদেশে বিশুদ্ধানন্দ মহাথের এবং বিদেশে বৌদ্ধ রাষ্ট্রে জ্যোতিঃপাল মহাথের স্বাধীনতার স্বপক্ষে জনমত গঠন ও স্বাধীনতা লাভে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাই স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের বৌদ্ধরা একটি গুরুত্বপূর্ণ স¤প্রদায় হিসেবে মর্যাদা লাভ করে। বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষে সরকারি ছুটি এবং আষাঢ়ী পূর্ণিমা, আশ্বিনী পূর্ণিমা ও মাঘী পূর্ণিমা উপলক্ষে বৌদ্ধদের জন্য ঐচ্ছিক ছুটি নির্দিষ্ট করা হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ টিভি ও বেতারের সপ্তাহে স্বীকৃতিও যথাযথ আচরণের নির্দশন বলে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদানের স্বীকৃতি বৌদ্ধরা পায়নি। এখনো যথাযথভাবে তাদের অপরিসীম ভূমিকার মূল্যায়ন হয়নি। সেজন্য বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা এবং কমাÐারদের এ ব্যাপারে তৎপর হতে হবে। সরকারের সাথে সমন্বয় সাধন করে একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন করা।
স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের পরিচয়
দীর্ঘ প্রায় শত বছর সংগ্রামের পর ১৯৪৭ সালে পাক ভারত স্বাধীনতা লাভ করে সৃষ্টি হয় দুটি পৃথক রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান। ভারতের পশ্চিম মুসলিম অধ্যুষিত অংশ পশ্চিম পাকিস্তান এবং এর প্রায় দেড় হাজার মাইল পূর্বে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট অঞ্চল পূর্ববঙ্গকে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান এ দু’ প্রদেশকে নিয়ে গড়ে তোলা হয় পাকিস্তান নামক দেশ। দেশ বিভাগের পর থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব মুহুর্তে অর্থাৎ ১৯৭১ সালে পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান বরাবরই পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক শাসিত হয়ে আসছিল। শাসনের নামে তারা পূর্ব-পাকিস্তানীদের করেছে শোষণ নিপীড়ন এমনকি মুখের মাতৃভাষাকেও তারা স্তদ্ধ করে দিতে চেয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের জাতি ধর্ম নিবিশেষে ছাত্র জনতার প্রতিবাদের মুখে তাদের সেই হীন চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠি বাঙালিদের উপর সকল ক্ষেত্রে এমনভাবে নিপীড়ন শুরু করলো যে বাঙালিরা অনন্যেপায় হয়ে স্বাধিকার আন্দোলন করতে বাধ্য হলো। স্বাধিকার আন্দোলন অবশেষে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ লাভ করলো। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বীরদীপ্ত আহবান ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- এ অগ্নিমন্ত্রে উজ্জীবিত জাতি ধর্ম নারী পুরুষ আবাল বৃদ্ধ বণিতা ঐক্যবদ্ধ হলো ১৯৭১ সালে ২৫মার্চ নরঘাতক পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তৎকালীন সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে নিরীহ বাঙালি জাতির উপর ঝাপিয়ে পড়লো। আর পরদিন ২৬ মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলো। শত্রæকে প্রতিহত করার জন্য বঙ্গবন্ধুর পক্ষ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা কর হলো। শত্রæকে প্রতিহত করার জন্য বাঙালি ছাত্র জনতা সকল স্তরের মানুষ অস্ত্র হাত তুলে নিল। শুরু হলো স্বাধীনতা সংগ্রাম। সেই সংগ্রামে বাঙালি বৌদ্ধরাও নিজেদের সম্পৃক্ত করে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। লেখনী ও শব্দ সৈনিক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখেন বিপ্রদাস বডুয়া, সুব্রত বডুয়া প্রমুখ।
বাঙালি বৌদ্ধরা মূলত বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাংশে বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলায় বসবাসরত একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী অবস্থানগত ও সংখ্যাগত কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের বিচরণ ক্ষেত্র সীমিত পরিসরে সীমাবদ্ধ হলেও আনুপাতিক হারে তাদের অবদান কোনো অংশেই কম নয়। নেতৃত্বের অভাব থাকলেও তারা ব্রিটিশ শাসনামল থেকে প্রগতিশীল আন্দোলনেকে সমর্থন করেছে এবং সাধ্যমত ভূমিকা রেখেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় অনেক বাঙালি বৌদ্ধ যুবক অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধ করেছে অনেকে শহীদ হয়েছেন, অনেকে নিখোঁজ হয়েছেন, লুণ্ঠিত হয়েছে, বৌদ্ধদের ধন সম্পদ, অগ্নিদগ্ধ হয়েছে হাজার হাজার ঘর বাড়ি. নিগৃহীত লাঞ্চিত ও ধর্ষিত হয়েছে শত শত বৌদ্ধ তরুণী। এসব অত্যাচার নিপীড়ন থেকে গৈরিক বসনধারী বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও রেহাই পায়নি। অনেক বিহার লুুন্ঠিত হয়েছে, অপহৃত হয়েছে বহু মূল্যবান বুদ্ধমূর্তি। এসময়ে অনেক বৌদ্ধ জনসাধারণ আত্মরক্ষা করার জন্য আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হয়েছে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র বার্মা (মিয়ানমার) ও ভারতে।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের বাঙালি বৌদ্ধদের গৌরবময় আত্মত্যাগের ইতিহাস এখনো রচিত হয়নি। ১৯৯৮ সাল বাংলা একাডেমি থেকে ড. প্রণব কুমার বডুয়া (মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি বৌদ্ধ সম্প্রদায়), জ্যোতিঃপাল মহাথের (বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে) এবং বিশুদ্ধানন্দ মহাথের (রক্তঝরা দিনগুলি) ব্যতীত মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি বৌদ্ধ স¤প্রদায় অংশগ্রহণ ও অবদান সম্পর্কে আর কোন গ্রন্থ রচিত হয়নি। এছাড়া কয়েকটি গ্রন্থ ও সাময়িক পত্র এবং অন্যান্য জনের দু’একটি মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছাড়া তেমন উলে­খযোগ্য কোন তথ্যপূর্ণ ইতিহাস প্রকাশিত হয়নি। এ ব্যাপারে আরো গভীর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি বৌদ্ধদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা ও আত্মত্যাগের সঠিক ইতিহাস প্রকাশিত হলে বৌদ্ধ স¤প্রদায় এবং তাদের উত্তর প্রজন্ম নিঃসন্দেহে আত্মশ্লাঘা বোধ করবে।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ কিংবা পাকসেনা ও রাজাকার আলবদর কর্তৃক নির্যাতিত বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা
 দীপক বডুয়া  পিতা – মৃত বিজয়শ্রী বডুয়া, উখিয়া, কক্সবাজার (২৭ মার্চ প্রতিরোধ যুদ্ধে চট্টগ্রাম ডি সি হিলের পাদদেশে চেরাগী পাহাড়ের কাছে শহীদ হন। তিনি প্রথম একাত্তরের বৌদ্ধ শহীদ)।
 জিনানন্দ ভিক্ষু  গ্রাম – আধাঁরমানিক, রাউজান, চট্টগ্রাম। (তিনি পটিয়া থানার পাঁচরিয়া গন্ধকুটি বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ ছিলেন। স্বাধীনতার দুইদিন আগে রাজাকার কর্তৃক নিহত হন)।
সুধীর বডুয়া  পিতা – মৃত নীরেন্দ্র লাল বডুয়া গ্রাম – আবুরখীল রাউজান, চট্টগ্রাম (ইপিআর বাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং ময়মনসিংহ ৯ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধে শহীদ হন)।
 পংকজ বডুয়া  পিতা – সুরেন্দ্র লাল বডুয়া, গ্রাম হিংগলা, রাউজান, চট্টগ্রাম, (চট্টগ্রাম ১০ ডিসেম্বর থানার মোহাম্মদ আলীর হাটে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন)।
 বিকাশ বডুয়া  পিতা – মৃত দ্রোন কুমার বডুয়া, গ্রাম-খৈয়াখালী, রাউজান, চট্টগ্রাম। (সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন)।
 শুক্লধর বডুয়া  গ্রাম – দমদমা, মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম।
 মৃণাল কান্তি বডুয়া  গ্রাম – জোরালগঞ্জ, মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম।
 দুলাল কান্তি বডুয়া  গ্রাম – হিংগলা, রাউজান, চট্টগ্রাম।
 ঝন্টু বডুয়া  পিতা – অর্জুন বডুয়া গ্রাম আধাঁরমানিক, রাউজান, চট্টগ্রাম।
 আনন্দ প্রসাদ বডুয়া  গ্রাম – আবুরখীল, রাউজান, চট্টগ্রাম।
 বাগীশ্বর বডুয়া (প্রধান শিক্ষক) গ্রাম – আবুরখীল, রাউজান, চট্টগ্রাম।
 আনন্দ বডুয়া  গ্রাম – পারুয়া, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।
 মৃণাল কান্তি বডুয়া  পিতা – সতীশচন্দ্র বডুয়া, সোনাপাহাড়, মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম।
 শশাঙ্ক মোহন বডুয়া গ্রাম – মেরেংলোয়া, রামু, কক্সবাজার। (৯ মে হানাদার বাহিনী আওয়ামীলীগের কর্মী হওয়ার কারণে সুপারি গাছের সাথে বেঁধে গুলি করে হত্যা করে)।
 রমেশ বডুয়া (শিক্ষক) গ্রাম – গহিরা, রাউজান, চট্টগ্রাম।
 উমেশ চন্দ্র বডুয়া  গ্রাম – গহিরা, রাউজান, চট্টগ্রাম।
 বীরবাহু বডুয়া(প্রধান শিক্ষক)  গ্রাম – করলডাঙ্গা, পটিয়া, চট্টগ্রাম।
 সুমতি রঞ্জন বডুয়া (শিক্ষক) গ্রাম – শাকপুরা, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম (১০ ডিসেম্বর পাকসেনাদের গুলিতে নিহত হন)।
 ধূর্জ্জটি প্রসাদ বডুয়া  গ্রাম – শাকপুরা, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম (জেএসআই চট্টগ্রাম বন্দর, ২০ এপ্রিল পাকসেনা কর্তৃক শাকপুরাস্থ তপোবন বিহারে শহীদ হন)।
 রমেশ চন্দ্র বডুয়া  গ্রাম – শাকপুরা, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম (২০ এপ্রিল পাক সেনাদের গুলিতে নিহত হন)।
 সুনীল বডুয়া  গ্রাম – বৈদ্যপাড়া বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম।
 বিভূতি বডুয়া  গ্রাম – বেতাগী, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।
 কামিনী বডুয়া  গ্রাম – রামু মেরেংলোয়া, রামু কক্সবাজার।
 মনোরঞ্জন সিংহ  পিতা – বিপিন সিংহ, গ্রাম-আলীশ্বর, লাকসাম, কুমিল­া। (২১ নভেম্বর পাকবাহিনীর কনভয় আক্রমন করতে গিয়ে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন)।
 মিলন বডুয়া  গ্রাম – মোগলটুলি বডুয়া পাড়া, মোগলটুলি, চট্টগ্রাম।
 মনীন্দ্র লাল বডুয়া  গ্রাম – হলদিয়া পালং, উখিয়া, কক্সবাজার।
 শশী কুমার বডুয়া  পিতা – মৃত সীননাথ বডুয়া, কক্সবাজার, সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র।
 ক্ষীরোধ মোহন বডুয়া  গ্রাম – মানিকপুর, চকরিয়া, কক্সবাজার।
 সুনীল বডুয়া গ্রাম – সরোয়াতলী, চট্টগ্রাম।
 অনিল বডুয়া গ্রাম – ডাবুয়া, চট্টগ্রাম।
 সুশীল বডুয়া  গ্রাম – বৈদ্যপাড়া, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম।
 বিজয় রতন বডুয়া  গ্রাম – দমদমা, মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম।
 মনোহরি বডুয়া  গ্রাম – মায়ানী, মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম।
 রাসবিহারী বডুয়া  গ্রাম – মায়ানী, মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম।
 যোগেশ চন্দ্র বডুয়া  গ্রাম – মায়ানী, মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম।
 সুধাংশু বডুয়া  গ্রাম – মায়ানী, মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম।
 নাইদবাসী বডুয়া  গ্রাম – মায়ানী, মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম।
 বেনীমাধব বডুয়া গ্রাম – জোবরা, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
 দেবাশোক বডুয়া  গ্রাম – মোগলটুলী, চট্টগ্রাম।
 মিলন বডুয়া  গ্রাম – পাহাড়তলী মহামুনি, রাউজান, চট্টগ্রাম।
 নীরদ বরণ বডুয়া  গ্রাম – পাহাড়তলী মহামুনি, রাউজান, চট্টগ্রাম।
 রূপায়ন বডুয়া  গ্রাম – নোয়াপাড়া, রাউজান, চট্টগ্রাম।
 বাদল বডুয়া  গ্রাম – পাহাড়তলী, রাউজান, চট্টগ্রাম।
 ভট্ট বডুয়া  পিতা – কালীধন বডুয়া, উখিয়া, কক্সবাজার।
 দীপক বডুয়া  গ্রাম – আব্দুল্লাহপুর, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।
 জ্ঞানেন্দ্র বডুয়া (সদরঘাট) গ্রাম – রাউজান, চট্টগ্রাম।
 সুধাংশু বডুয়া  গ্রাম – হাইদচকিয়া, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।
 কামিনী বডুয়া  গ্রাম – রামু, কক্সবাজার।
 জীবন বডুয়া  গ্রাম – কৌশল্যার বাগ, কোমলগঞ্জ, নোয়াখালী।
 টুনু বডুয়া  গ্রাম – কৌশল্যার বাগ, কোমলগঞ্জ, নোয়াখালী।
 বীরেন্দ্র লাল বডুয়া  গ্রাম – কৌশল্যার বাগ, কোমলগঞ্জ, নোয়াখালী।
 চারুবালা বডুয়া  গ্রাম – আবুরখীল, রাউজান, চট্টগ্রাম।
 সারদা বডুয়া  গ্রাম – গহিরা, রাউজান, চট্টগ্রাম।
 ভবেশ চন্দ্র বডুয়া  পিতা – মৃত বিপিন চন্দ্র বডুয়া, গ্রাম-সাদেকনগর, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।
 বুদ্ধ কিঙ্কর বডুয়া  গ্রাম – দমদমা, মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম।
 সুকোমল বডুয়া (শিক্ষক) রাঙ্গামাটি সদর, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা।
 রূপায়ন বডুয়া গ্রাম – গুজরা নোয়াপাড়া, রাউজান, চট্টগ্রাম।
 সুধীর রঞ্জন বডুয়া  কর্ণফুলী পেপার মিল, চন্দ্রঘোনা। (২৯ এপ্রিল শহীদ হন)
 সুপতি রঞ্জন বডুয়া  গ্রাম-রাউজান, চট্টগ্রাম। চীফ ফাইনেন্সিয়াল এডভাইজার রেলওয়ে বোর্ড, ১৬ এপ্রিল গ্রেফতার হন পাক নৌবাহিনী কর্তৃক এবং ১৭ এপ্রিল তাঁকে সার্কিট হাউজে হত্যা করা হয়।
 সঞ্চয়ন বড়য়া  গ্রাম – রাউজান, উপজেলা- রাউজান, চট্টগ্রাম।
 প্রভাস কুসুম বডুয়া  পিতা- অসিতী রঞ্জন বডুয়া, গ্রাম – ইছামতি, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম বিশ্বাবদ্যালয়ের প্রকৌশলী। (২১ এপ্রিল পাকবাহিনী তাঁর সার্সন রোডস্থ বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করে)।
 চিত্তরঞ্জন বডুয়া  গ্রাম – জোয়ারা, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম। (টিএÐটি, ২৯ এপ্রিল শহীদ হন)।
 তড়িৎ কান্তি বডুয়া  গ্রাম – রাউজান, চট্টগ্রাম। (টিএÐ টি, ২৯ এপ্রিল শহীদ হন)।
 হীরেন্দ্র লাল বডুয়া  চন্দ্রঘোনা পেপার মিলে কর্মরত ছিলেন। (২৯ এপ্রিল শহীদ হন)।
 পরাগ বডুয়া  গ্রাম – সাতবাড়িয়া, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম। (২৯ এপ্রিল শহীদ হন)।
 ধর্মদর্শী বডুয়া  টি এন্ড টিতে চাকুরীত ছিলেন। (২৯ এপ্রিল শহীদ হন)।
 সুবিমল বডুয়া  টি এÐ টিতে চাকুরীরত ছিলেন। (২৯ এপ্রিল শহীদ হন)।
 সুনীল মুৎসুদ্দি  আওয়ামীলীগের রাঙ্গামাটি থানা কমিটির দপ্তর সম্পাদক ছিলেন।
 চিত্ত রঞ্জন বডুয়া  গ্রাম – রাউজান, উপজেলা- রাউজান,  চট্টগ্রাম।
 ভবেশ বডুয়া  গ্রাম – জানারখীল সাদেক নগর, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।
 নিপুন কান্তি বডুয়া  ইলিয়াস বিল্ডিং, চকবাজার, চট্টগ্রাম। (৩ মে তুলে নিয়ে পাকসেনারা হত্যা করে)
সত্যরঞ্জন বডুয়া  গ্রাম – রাউজান, উপজেলা- রাউজান,  চট্টগ্রাম।
 বিধুভূষণ  বডুয়া  গ্রাম – মাদার্শা, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
 রমেশ চন্দ্র বডুয়া  গ্রাম – মাদার্শা, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
 সুভাষ বডুয়া  গ্রাম – মাদার্শা, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
 বঙ্কিম বডুয়া  গ্রাম – মাদার্শা, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
 ননীগোপাল বডুয়া  গ্রাম – লাখেরা, পটিয়া, চট্টগ্রাম।
 নীলকমল বডুয়া  গ্রাম – কধুরখীল, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম।
 মিনা বডুয়া  গ্রাম – দমদমা, মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম।
 ভূপেন্দ্র লাল বডুয়া  গ্রাম – চান্দগাঁও, চট্টগ্রাম।
 সুরেন্দ্র লাল বডুয়া  গ্রাম – চান্দগাঁও, চট্টগ্রাম।
 তপন কুমার বডুয়া  গ্রাম – চান্দগাঁও, চট্টগ্রাম।
 মনীন্দ্র লাল বডুয়া  গ্রাম – চান্দগাঁও, চট্টগ্রাম।
 কামিনী বডুয়া গ্রাম – গহিরা, হাটহজার, চট্টগ্রাম।
সুকোমল বডুয়া গ্রাম – দমদমা, মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম।
বীরেন্দ্র লাল বডুয়া
মনোরঞ্জন সিংহ গ্রাম – বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী।
গ্রাম – দত্তপুর, কুমিল্লা।
বিমল বডুয়া পিতা – মৃত মনমোহন কড়–য়া, গ্রাম – নানুপুর, ফটিকছড়ি।
সমীরণ বডুয়া  গ্রাম – পান্থশালা মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম।
হিমাংশু বডুয়া  গ্রাম – বরমা, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম।
সঞ্চয় ভূষণ বডুয়া  বন্দরে চাকুরিরত ছিলেন।
হীরেন্দ্র লাল বডুয়া  বন্দরে চাকুরিরত ছিলেন।
এস. আর. বডুয়া  বন্দরে চাকুরিরত ছিলেন।
ভি. পি. বডুয়া  বন্দরে চাকুরিরত ছিলেন।
বি. এস. বডুয়া  বন্দরে চাকুরিরত ছিলেন।
কৃষ্ণ প্রসাদ বডুয়া রামু, কক্সবাজার।
সাধন বডুয়া গ্রাম – ঢেমশা, সাতকানিয়া।
মিলন বডুয়া বড় হাতিয়া, সাতকানিয়া।
রনজিত বডুয়া মিয়াপুর, নোয়াখালী।
সুশান্ত বডুয়া ইছামতি, রাঙ্গুনিয়া।
কাজল বডুয়া ইছামতি, রাঙ্গুনিয়া।
অনুজ কুমার বডুয়া হাইদচকিয়া, ফটিকছড়ি।
ধীমান বডুয়া রামু, কক্সবাজার।
অরবিন্দু বডুয়া রামু, কক্সবাজার।
নিপুল কান্তি বডুয়া গ্রাম – ঘাটচেক, রাঙ্গুনিয়া।
মহান মুক্তিযুদ্ধে মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের এবং দশম সংঘরাজ পÐিত জ্যোতিঃপাল মহাথের অনন্য অসাধারণ অবদান রাখেন। বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামে বাঙালি বৌদ্ধ নেতৃবৃন্দ প্রধানত দুই ভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। প্রথমত: দেশের অভ্যন্তরে বৌদ্ধদের জান মাল রক্ষায় প্রয়াত মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরর নেতৃত্বে অভ্যন্তরীণ মিশনারী কাজ, দ্বিতীয়ত: মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গঠন ও সমর্থন লাভে সংঘরাজ পÐিত জ্যোতিঃপাল মহাথের বহির্বিশ্বের বৌদ্ধদেশসমূহ পরিভ্রমণ। উল্লেখ্য যে এ দুইজন মহান সাংঘিক ব্যক্তিত্ব কৃতকর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ পÐিত জ্যোতিঃপাল মহাথের মহান একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক এবং সংঘনায়ক বিশদ্ধানন্দ মহাথের, ভাষাকন্যা প্রতিভা মুৎসুদ্দি, কবিয়াল ফণী ভূষণ বডুয়া এবং এবং কথাসাহিত্যিক বিপ্রদাশ বডুয়া মহান একুশে পদক লাভ করেছেন।
চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর আদিবাসী বীরাঙ্গনা
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৌদ্ধদের অবদান ছিল অপরিসীম। মানব ইতিহাসে সংঘটিত অজ¯্র গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের ঘটনার মধ্যে স্বল্পতম সময়ে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষ নিহত ও ধর্ষিত হয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিয্ুেদ্ধ পাকিস্তানী বাহিনী কর্তৃক। এদেশের বাঙালি জনগোষ্ঠী ছাড়াও হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে বাঙালি বডুয়া বৌদ্ধ, আদিবাসী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বহু নর-নারী। বাংলাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ স্বতস্ফূত ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। বাঙালি বডুয়া বৌদ্ধ, পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অনেক বৌদ্ধ নর-নারীরা মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আদিবাসী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অনেক নারী বীরঙ্গনা রয়েছে। তাঁরা নিরবে নিভৃতে তাদের গøানি মাথায় নিয়ে দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষে নিবেদিত ছিলেন।
ইতিহাসে দেখা যায়, বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর মধ্যে অনেকেই পাকসেনা এবং এদেশীয় দোসরদের দ্বারা আহত ও নিহত হয়েছেন; আবার অনেকে নির্যাতিত, নিপীড়িত ও ধর্ষিত হয়েছেন। সেই ভয়ানক দিনের কথা মনে করলে এখনো অনেকে শিহরিত হয়ে যান। বাঙালি বডুয়া বৌদ্ধ অনেকে নিহত ও ধর্ষিত হয়েছে। বিশেষ করে চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর আদিবাসী বৌদ্ধ নারীরা নির্যাতিত, নিপিড়িত ও ধর্ষিত হয়েছিল অধিক। অনেক নারী আত্মসম্মানবোধ আর সামাজিক লোক লজ্জার ভয়ে নির্যাতিত, নিপীড়িত কিংবা ধর্ষিত হয়েও প্রকাশ করেননি। এমন বৌদ্ধ নারীর সংখ্যাও নিহাত কম নয়। আদিবাসী বীরাঙ্গনা বৌদ্ধ নারীদের নিয়ে কাজ করেছেন সুরমা জাহিদ। তিনি ‘এই সংগ্রামে আমিও আদিবাসী বীরাঙ্গনা’শিরোনামে অন্বেষা প্রকাশন থেকে ২০১৪ সালে তাঁর গবেষণা কর্ম প্রকাশ করেছেন। তাঁর এ গবেষণা গ্রন্থে আদিবাসী বীরাঙ্গনা নারীদের কথা, অভিমত, নির্যাতনের চালচিত্র পর্যালোচনা করেছেন। আদিবাসী বীরাঙ্গনাদের সেই পাশবিক নির্যাতনের কথা এখনো মানুষকে পীড়িত করে।  নি¤েœ কয়েকজন আদিবাসী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বৌদ্ধ বীরাঙ্গনার নাম ও পরিচয় তুলে ধরা হলো।
কক্সবাজারের আদিবাসী বৌদ্ধ বীরঙ্গনা থোঁঞো তনচংঙ্গ্যা, চেনচেন্নু রাখাইন, এবং স্বর্ণ কুমারী ত্রিপুরা। পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটির জক্কুনী ত্রিপুরা, হেমাঙ্গিনী ত্রিপুরা, বিজলী সাঁওতাল, রাজবেলা সাওতাল। পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান এর হামে চিং মার্মা, কৃষ্ণপুটি তনচংঙ্গ্যা প্রমুখ। পার্বত্য চট্টগ্রাম খাগড়াছড়ি জেলায় ধর্ষিত আদিবাসী বীরাঙ্গনারা হলেন- আভা মার্মা, লামাচ মার্মা, চেন্দাউ মার্মা প্রমুখ। দীর্ঘ সময় পরে হলেও আদিবাসী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বৌদ্ধ বীরাঙ্গনাদের মূল্যায়ন ও সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করা প্রয়োজন।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠির স্বাধীনতা স্বজাত্যবোধের চিরায়ত ধর্মীয় ধারায় কালে কালে প্রগতিশীল আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদান ছিল অপরিসীম। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বৌদ্ধদের অংশগ্রহণ এবং স্বাধীনতা লাভের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। বৌদ্ধরা এদেশের ভূমিজ সন্তান। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বৌদ্ধ স¤প্রদায়ের অংশগ্রহণ, বহির্বিশ্বের বৌদ্ধ রাষ্ট্রসমূহ হতে সমর্থন আদায় ও অনন্য অবদান স্মরণীয়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন। সরকার বা রাষ্ট্রীয়ভাবে বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধার তালিকা, স্বীকৃতি প্রদান, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য সহায়তা প্রদান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার এত বছর পরও বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের নামের úূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন করা হয়নি।
বাঙালি বডুয়া বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর মুক্তিযোদ্ধাদের সামগ্রিক মূল্যায়ন, কর্মের সঈকৃতি, সম্মাননার জন্য জাতীয় উদ্যোগ প্রয়োজন। এখনো বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন ভাবে হতাশা ও অসহায় অবস্থায় রয়েছে। এ গবেষণাকর্মে চট্টগ্রামের বাঙালি বডুয়া বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধদের মধ্যে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, সহায়তা দান, নৈতিক সমর্থন ও কূটনীতিক সহযোগিতা দিয়েছে তাদের অবদান ও মুক্তিযোদ্ধদের একটি সংক্ষিপ্ত নামের তালিকা প্রণয়ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। সেই সাথে শহীদ বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বিবরণও প্রদান করা হয়েছে। তবে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের অংশগ্রহণ ও অবদান বিষয়ে ক্রোশপত্র প্রকাশ করা প্রয়োজন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও ভূমিকা পালন করা এবং সমাজকর্মে অবদান রাখার জন্যে রাষ্ট্রীয় মহান স্বাধীনতা পদক ও মহান একুশে পদক লাভ করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর পরেও বাঙালি বডুয়া বৌদ্ধ সম্প্রদায় মনে করেন তাদের এ অনন্য অসাধারণ অবদানের যোগ্য মূল্যায়ন হওয়া উচিত। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিসহ এ পর্যন্ত বৌদ্ধদের মধ্যে কেউ কেউ সম্মান লাভ করলেও আরো অধিকভাবে দেশ মাতৃকার জন্য উৎসর্গীত, স্বদেশপ্রেমী মানুষের মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন।