৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ বাংগালীদের জন্য স্মরণীয় এবং ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত একটা ঘটনা। লাখো শহীদের আত্মত্যাগ ও লাখো মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত হয় সবুজের মাঝে রক্ত সূর্যখচিত একটি পতাকা, একটি স্বাধীন সার্বভেৌম দেশ বাংলাদেশ।তাই মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গর্ব, আমাদের প্রেরণার উৎস। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বেৌদ্ধ ভিক্ষুরা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কাজ করে গেছেন।যাদের জন্য আজ আমরা গর্বিত এবং অনুপ্রাণিত।
প্রয়াত মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের এবং শ্রীমৎ জ্যোতিঃপাল মহাথেরোর নাম উল্লেখযোগ্য।বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত ভিক্ষু সুনীথানন্দ রচিত “বাংলাদেশের বেৌদ্ধ বিহার ও ভিক্ষু জীবন” গ্রন্থে বর্ণিত আছে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রয়াত মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের বেৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের মাধ্যমে বেৌদ্ধ পরিচয় পত্র দিয়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে নিরাপদ আশ্রয়ে রেখেছিলেন।অনেক হিন্দু, মুসলমানকে প্রাণে রক্ষা করেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘটনাবলী নিয়ে তিনি ১৯৭২ সালে রচনা করেন “রক্তঝরা দিনগুলোতে” শীর্ষক একটি পুস্তিকা। বইটি “বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র” এর চতুর্থ খন্ডে হুবহু বর্র্ণিত আছে। প্রয়াত সংঘনায়ক ভিক্ষুর দূরদর্শীতায় বেৌদ্ধ পল্লীগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছিল।
যুদ্ধ পরবর্তী মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের অন্যান্য বেৌদ্ধ দেশের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন, আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতির মাধ্যমে বাংগালী বেৌদ্ধদেরকে বিশ্বের দরবারে সম্মানের আসনে উন্নীত করেছেন।সমাজসেবায় অনন্য কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ২০০৫ সালে রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার একুশে পদক (মরণোত্তর) এ ভূষিত হন।
বুদ্ধের নির্দেশিত অহিংসার পথে থেকে ও যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করা যায় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সংসারত্যাগী মহান ব্যক্তি পন্ডিত শ্রীমৎ জ্যোতিঃপাল মহাথেরো। উল্লেখ্য যে ১৯৯৬ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ বেৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের উদ্যোগে আয়োজিত সুধী সমাবেশে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধে বেৌদ্ধধর্ম গুরুদের অবদান শ্রদ্ধার সংগে স্মরণ করে বলেন, বেৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের প্রয়াত সভাপতি মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের ও সংঘের বর্তমান (তখনকার সময়ে) উপদেষ্টামন্ডলীর প্রধান পন্ডিত শ্রীমৎ জ্যোতিঃপাল মহাথেরো, এদের মধ্যে একজন স্বদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন, আশ্রয় দিয়েছিলেন, অন্যজন বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের প্রতিনিধি হয়ে, বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন। তিনি তার জন্মস্থান কুমিল্লার লাকসামে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বেশকিছু গ্রন্থ রচনা করেন। তন্মধ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতার আলোকে রচিত গ্রন্থ “বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামে”। মুক্তিযুদ্ধে, সমাজসেবায়, গ্রন্থ রচনায় অনন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ২০১০ সালে রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার একুশে পদক (মরণোত্তর) এবং ২০১১ সালে রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার স্বাধীনতা পদক (মরণোত্তর) এ ভূষিত হন।
সূত্র : বাংলার বেৌদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্য ও বেৌদ্ধ সংষ্কৃতি, অধ্যাপক শিমুল বড়ুয়া