০৭:২০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বুদ্ধের জীবনাদর্শে কর্মবীর বোধিমিত্র মহাথেরো

  • বিপ্লব বড়ুয়া
  • আপডেট সময় ০১:২৮:৫০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২০ মার্চ ২০২৪
  • ৮০৯ বার পড়া হয়েছে

বুদ্ধের জীবনাদর্শে কর্মবীর বোধিমিত্র মহাথেরো
(আবির্ভাব- ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দ, প্রয়াণ-১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ)

ধর্ম দিয়ে কর্ম নয়, কর্ম দিয়েই ধর্ম। সাময়িক সময়ের জন্য ধর্ম মনকে পরিবর্তন করে কিন্তু কর্মকে কোনো অবস্থাতে পরিবর্তন করতে পারেনা। কর্মকে পরিবর্তন করতে হলে প্রতিনিয়ত একাগ্রতা, নিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে কাজের পিছনে ছুটতে হবে। সেটি যে কাজই হোক না কেন। যে অতি সামান্য ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র কাজ করে তার জীবনেও কোনো না কোনো সময় পরিবর্তন আসবে। কিন্তু জীবনকে সুন্দর ও পরিশীলিত করার ক্ষেত্রে ধর্মের গুরুত্ব অপরিসীম।

বৌদ্ধদর্শনে কর্ম ও কর্মফল হল বৌদ্ধধর্মের মৌলিক ধারণা। বুদ্ধ কর্মকে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং কর্মের মধ্যে দিয়ে ধর্মকে জানতে ও বুঝতে বলেছেন। কর্মবিহীন ধর্ম হচ্ছে অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতো অবস্থা। কর্ম হচ্ছে একটি প্রাতিস্বিক, মৌলিক, অভিন্ন শব্দ। কর্ম, কর্মই। কর্মের মধ্যে ভিন্নতা থাকতে নেই। কোনটি বড়, কোনটি ছোট এমনকোনো বাঁধাধরা ছকের মধ্যে কর্ম কেন্দ্রীভূত নয়। তবে একথা ঠিক যে, সঠিক সময়ে সঠিক কর্মটি সম্পাদন করতে পারাটা হচ্ছে মানুষের আসল কৃতিত্ব। ধরুন, আপনি কিছুক্ষণ অলস সময় পাড় করছেন এমন সময় যদি কোনো একটি বইয়ের প্রতি মনোযোগি হয়ে পড়েন তৎসময়ে মনে করতে হবে জ্ঞান অর্জনের জন্য এই সময়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বল্প সময়ে বই পড়ে যে জ্ঞানটি অর্জন করেছেন, দেখবেন এই অর্জিত জ্ঞানটি এক সময় আপনার কাজে দেবে। আবার ধরুন ভালো কিছু জানার আশায় সময় ব্যয় করে একটি অনুষ্ঠানে গেলেন, সেখানে গিয়ে বিষয়বস্তু সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জনে ব্যর্থ হলে সময় ও অর্থ দুটোই বৃথা হয়ে যায়। আর কিঞ্চিৎ পরিমানও যদি জ্ঞান অর্জিত হয় সেটিও এক সময় কাজ দেবে। বলতে গেলে জীবনে নানা বিষয়ে অভিজ্ঞতা থাকলে কোনো জায়গায় ঠেকতে হয় না। সুন্দর ভাষায় কথা বলতে পারাটাও একটি বড় অর্জন। যে সঠিক জ্ঞান দিয়ে এই অর্জনটা আয়ত্ব করেছে তার কাছে এটি অনেক বড় সম্পদ। যে সামান্য কয়েক মাসের জন্য দোকানের চাকরি করে সেই কর্মটিও একসময় মূল্যবান হয়ে দেখা দেবে। প্রত্যেক কাজের মধ্যে কোনো না কোনো কিছু শেখার আছে, জানার আছে। আমাদের বুঝতে হবে সব মানুষ দিয়ে সব কাজ হয় না। প্রত্যেকটি কাজের আলাদা আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। কোনো কাজকে খাটো করে দেখার অবকাশ নাই। যে কাজের কোনোরকম তৃপ্তি নেই, সেই কাজ কারো জীবনে ফল বয়ে আনে না। কাজ হচ্ছে হৃদয়ের গভীরে প্রসন্নতা সৃষ্টির এক অপার্থিব ভালবাসার বহুমাত্রিক উপাদান।

আজকে যাকে উদ্দেশ্য করে আমার সহস্রাধিক শব্দের বাক্য বন্দনা নিবেদন করছি, তিনি এই বৌদ্ধ সমাজেরই একজন সৃষ্টিশীল, আবাল্যব্রম্মচারী, কর্মবীর বৌদ্ধ সন্নাসী। তিনি পুরো জীবনটাই উৎসর্গ করে দিয়েছেন মানব মুক্তির জন্য। কাজ করেছেন সমাজ-সদ্ধর্মের উন্নতি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে। তিনি ছিলেন সত্যের পূজারী। কথার মধ্যে কোনোরকম রাখঢাক ছিল না। যা যাকে বলতে চাইতেন সামনা-সামনি বলে দিতেন, পিছনে বলা মানুষগুলো ছিল তাঁর অপছন্দের। কে তার নাম করবে, কিংবা কে বদনাম করবে সেটি নিয়ে তিনি কোনো সময়েই মাথা ঘামাতেন না। তাই এই ধর্মগুরু কারো কাছে যেমন প্রিয় ছিলেন, আবার কারো কাছে তিনি ছিলেন ঘোর অপ্রিয়। পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি সৎ পথের মানুষগুলো অপ্রিয় হওয়ার সংখ্যায় বেশি।

তিনি কাজ করতেন নীরবে নিভৃতে। ৬৫ বছরের জীবনে বৌদ্ধ সমাজ-সংস্কৃতির জন্য অনেক কিছু করে গেছেন। বৌদ্ধ তীর্থস্থান ‘চক্রশালা’ থেকে শুরু করে অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের তিনি কর্ণধার ছিলেন। তাঁর জীবনপঞ্জির দিকে চোখ বুলালে আপনারা ধর্মগুরুর কর্মপরিধি সম্পর্কে অনুধাবন করতে পারবেন। আমি শুধু পরম শ্রদ্ধেয় ধর্মগুরকে বাহ্যিক দিক থেকে যতটুকু অনুধাবন করেছি তার একটি সংক্ষিপ্ত আলোকপাতের অংশ হল আমার লেখার অবতারণা। এইসব গুণী ধর্মগুরুদের ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া না গেলে নবপ্রজন্ম প্রকৃত ইতিহাস থেকে ছিটকে পড়বে। ইতিহাস হচ্ছে আলামত সদৃশ্য। যে কোন পরিস্থিতিতে আমাদেরকে ইতিহাসের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন বুনতে হবে। ইতিহাস আমাদেরকে দিয়ে যায় একটি স্বর্ণালী অতীত। এই অতীত যারা স্মরণে রাখে না, তারা কাঙ্খিত শক্তি ফিরে পায় না। অটুট, মনোবল, শক্তি, সাহসের প্রেরণাদায়ী হচ্ছে ইতিহাস। ইতিহাস থেকে কোনোবস্থাতে বিচ্যুতি ঘটানো যাবে না। এই আবাল্যচারী ধর্মগুরু ইতিহাসের অংশ হিসেবে যুগ-যুগান্তর চিন্তাশীল মানুষের আস্থার ঠিকানায় বসত গড়ে নেবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

তিনি ছিলেন কাজের মানুষ। কর্মবীর। মানুষের মৃত্যু হয়, কর্মবীরের মৃত্যু হয় না। যারা সমাজ সদ্ধর্মে খারাপ কাজ করে তাদের অস্থিত্ব বিলীন হয়ে যায়, ধ্বংস হয়ে যায়। কর্মি বা আদর্শবান মানুষের কখনো মৃত্যু হয় না। তিনি অজ¯্র-অবিনাশী শ্রদ্ধায় মানুষের অন্তরে বিরাজ করবে। নমস্য, স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে থাকবেন ভদন্ত বোধিমিত্র মহাথেরো। আমৃত্যু তিনি শাসন সদ্ধর্মের জন্য, মানুষের জন্য, মানবতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। জন্ম, শৈশব থেকে মুত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত তিনি স্ব-গ্রামে কাটিয়েছেন। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা স্বাভাবিকভাবে বিভিন্ন বিহারে অবস্থান করেন কিন্তু তিনি তা করেননি। ধর্মপ্রচার ও জাগরণের ক্ষেত্র হিসেবে নিজগ্রামকেই বেছে নিয়েছেন, এই দিকটি ছিল তাঁর জীবনের এক অনন্যতা। তিনি বিহার ও গ্রামকে মনেরমতো সাজিয়েছেন, গড়ে তুলেছেন। গ্রামের বহু সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন, গ্রামবাসী তথা সমগ্র বৌদ্ধ সমাজকে ধর্মদানে উজ্জ্বীবিত করেছেন, সমাজ ও দেশের সেবা করেছেন। মানবীয় মূল্যবোধ যার মধ্যে নেই তারা কোনোভাবে এই কাজগুলো করতে পারে না। ভান্তের মধ্যে সে জাতীয় মূল্যবোধ গুলো ছিল বলেই তিনি উদারভাবে কাজ করেছেন, সদ্ধর্মের সেবা করেছেন। বাংলাদেশে অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও গুণ সম্পন্ন বৌদ্ধ ভিক্ষুর কথা যদি বলি তাহলে অনায়সে বলতে হবে পরম পূজনীয় বোধিমিত্র মহাথের’র কথা। যেমন তাঁর ভাষাবোধ, তেমনি তাঁর শব্দ চয়ন, এক দীর্ঘদেহী ও ভরাট কন্ঠের মানুষ। এই গ্রামের অনেকের কাছ থেকে শুনেছি ভান্তের চাহনিতেই অনেকের হৃদয়ে নাকি রীতিমতো কম্পন শুরু হতো। এই দশা আমারো হয়েছিল। প্রথম প্রথম এমন ভয় পেতাম কিছু জানার থাকলেও সহজে জিজ্ঞাসা করতাম না। একদিন বৌদ্ধ সমাজের একটি বড় ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি সংবাদ তৈরী করতে হচ্ছে। প্রতিবেদন লিখতে গিয়ে ভান্তের শরণাপন্ন হয়েছিলাম এবং ভান্তেকে কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সেই থেকে ভয়টা কাটতে শুরু করে। ভান্তে আমাকে অবলীলায় উত্তর দিলেন-। বাহ্যিক দৃষ্টিকোন থেকে তাঁকে যতই ইস্পাতসম কঠিন ভেবেছিলাম তাঁর সাথে কথা না বলাবধি কেউ বুঝতে পারবে না আসলে তাঁর ভিতরের মনটি কত নরম-কোমল। তিনি ২০০২ সালে বাংলাদেশ বৌদ্ধ ভিক্ষু মহাসভার মহাসচিবের দায়িত্ব নিয়েছিল ২০২৩ সালে মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত প্রায় একটানা ২১ বছর সেই দায়িত্বে অটল থেকেছেন। এই একটি মাত্র সাংগঠনিক পদবীই বলে দেয় তিনি কেমন ভিক্ষু ব্যক্তিত্ব ছিলেন। এছাড়া তিনি আরো অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন। ভ্রমণ করেছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।

প্রতিদিন কতো মানুষ মারা যাচ্ছে, কার খবর কে রাখে! বৌদ্ধসহ সর্বজনীন সমাজে এই পর্যন্ত কতো মানুষ মরল কেউ কি হিসেব দিতে পারবেন? না কোনোভাবে সম্ভব নয়। আবার এমন কিছু মানুষ আছেন তাঁরা যেন মরেও অমর। কারণ তাদের ক্ষেত্র হচ্ছে একমাত্র কর্ম। কর্মের মধ্যেই যার যার স্থান নির্ণয় হয়।

তাঁর ভিক্ষু ও শ্রামণ্য জীবনের দুই উপাধ্যায় গুরু ছিলেন বৌদ্ধধর্ম প্রচার ও প্রসারের দুই আলোকিত কর্মবীর, দিকপাল মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের ও সংঘনায়ক এস. ধর্মপাল মহাথের। কী রকম ধীমান ভিক্ষু ছিলেন তাঁদের শিষ্য প্রয়াত ভদন্ত বোধিমিত্র মহাথের এ এক উজ্জ্বল, অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। এ রকম আরো বৌদ্ধ ভিক্ষু ও সমাজ বিদগ্ধ ব্যক্তি ছিলেন, যারা সামগ্রিক বৌদ্ধ সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছিল। তেমনি এই সুন্দর সমাজ-সদ্ধর্ম ও বিহার ছেড়ে ইহলোক পাড়ি জমালেও তিনি কখনো মানুষের অন্তর থেকে বিলীন হবে না। ভান্তে সর্বক্ষেত্রে ধুলিকনার ন্যায় গ্রামের নাড়িনক্ষত্রের সাথে মিশে গেছেন। যা অনেকের বেলায় সম্ভব হয়নি। তাঁর সমবয়সীদের মধ্যে অনেকে আছেন তাঁরা ক’জনে পূজনীয় বোধিমিত্র মহাথের’র মতো গৌরবনীয় ব্যক্তিত্ব হতে পেরেছেন একবার ভাবুন তো ? তিনি পেরেছেন কারণ তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষু। একজন সার্থক, সফল, ত্যাগী বৌদ্ধ ভিক্ষু হতে গেলে তাঁকে অনেক সুখ-আহ্লাদ বর্জন করতে হয়।

তিনি করেছেন বলে আজ মহান হয়েছেন, পূজনীয় হয়েছেন। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা হচ্ছে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের আলোকবর্তিকাসম। তবে দুঃখের বিষয়, আগেকার মতো প্রকৃত ত্রিপিটকশাস্ত্র পণ্ডিত ভিক্ষুর বড় অভাব! অধিকাংশ ভিক্ষু ত্যাগের চেয়ে লাভ সৎকারে ব্যস্ত সময় কাটায়। বর্তমান সময়ে এমন এমন ভিক্ষুর আবির্ভাব হচ্ছে তাদের মধ্যে অধিকাংশ ভিক্ষুর জীবনযাপন, আচরণ ও ভবিষ্যৎ ধর্মচর্চা নিয়ে বৌদ্ধ সমাজের বিদগ্ধজনেরা খুব বেশি সন্দিহান! বৌদ্ধ ভিক্ষু থাকতে হলে একটি বিহারের প্রয়োজন হয়। তাঁদের মধ্যে কোনো রকম লোভ-লালসা থাকতে পারবেনা। কোনো একজন গৃহীও ভিক্ষুর জীবনাচরণের ওপর কোনোরকম বিদ্বেষ বা সন্দেহ পোষণ করলে সাথে সাথে তিনি স্থান ত্যাগ করবেন। এটিই হচ্ছে বুদ্ধের রীতিনীতি। তিনি শুধু ধর্মচর্চা নিয়ে অনাড়ম্বর-অনাসক্ত জীবন উপভোগ করবেন। এখন দেখা যায় তার উল্টো। বৌদ্ধ বিহারকে কেন্দ্র করে ধর্মে, কর্মে, সমাজ-সম্প্রদায় সুসংগঠিত হয়, বিনয়শীল হয়, নমনীয় হয়। ধর্মাপরায়ন হলে পরিবার-সমাজ-দেশ সুন্দর হয়। আমাদেরকে ধার্মিক হওয়ার পাঠ নিতে হবে কিন্তু এ কথা অতীব সত্য যে, আজকাল ধার্মিক হতে গিয়ে ধর্মান্ধ হওয়ার প্রবণতার সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। মনে রাখতে হবে ধার্মিকগণ হচ্ছেন সমাজের বন্ধু আর অপর দিকে ধর্মান্ধরা হচ্ছেন সমাজের শত্রæ। আমরা যদি সত্য কি, মিথ্যা কি বুঝি, আমরা যদি ভালো আর মন্দের মধ্যে তফাৎ বুঝি, তাহলে আমাদেরকে বুঝতে হবে ধার্মিক কারা, আর ধর্মান্ধ কারা। ধর্মান্ধরা বিপথগামী। বর্তমান দেশে দেশে যে হিংসা-বিদ্বেষের মধ্যে দিয়ে বড় বড় অঘটনের জন্ম নিচ্ছে তার একমাত্র প্রধান কারণ হচ্ছে ধর্মান্ধতা! এক শ্রেনীর ধর্মান্ধগোষ্ঠী ধর্মকে এখন বিষাক্ত ওষুধের মতো ব্যবহার করছে। ধর্মগুরুর ছদ্মবেশে ঠকবাজরা অহরহ মিথ্যার পাহাড় গড়ছে। এই হীন চক্রান্ত থেকে যতদিন আমরা বের হতে পারবো না, ততদিন পর্যন্ত আমাদের জীবন প্রণালীতে হিংসার পরিবর্তে অহিংসার মাত্রাটা ক্রমশঃ বাড়তেই থাকবে। তাই সময় এসেছে নিজেকে বদলিয়ে ফেলার। সবার জীবন আনন্দময় হোক।

কর্মবীর ভদন্ত বোধিমিত্র মহাথেরো, গৃহীনাম- সুনীলরঞ্জন বড়ুয়া, জন্মস্থান গ্রাম-পাঁচরিয়া, উপজেলা- পটিয়া, জেলা- চট্টগ্রাম। আবির্ভাব- ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দ, প্রয়াণ-১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ, শ্রামণ্য ধর্মে দীক্ষা- ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দ ( উপাধ্যায় গুরু ২৮তম সংঘনায়ক এস. ধর্মপাল মহাথের), উপসম্পদা গ্রহণ- ১লা জুন ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দ (উপাধ্যায় গুরু- মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের), পিতার নাম- জয়সেন বড়ুয়া, মাতার নাম- অনিতা বড়ুয়া, সর্বোচ্চ শিক্ষা- এম. এ. (পালি)- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিনয়-সূত্র-অভিধর্ম বিশারদ। তিনি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একজন নির্লোভ নিরাহংকার ত্যাগী বৌদ্ধ ধর্মগুরু। তাঁর পুরো জীবনটাই ঝলমলে আলোকোজ্জল বর্ণিল ছটায় পরিপূর্ণ।

তাঁর প্রতি অতল শ্রদ্ধা।

‘সব্বে সত্তা সুখীতা ভবন্তু’ জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।

লেখক: সাংবাদিক-প্রাবন্ধিক।

শেয়ার করুন
আরও সংবাদ দেখুন

সৈয়দবাড়ী ধর্ম প্রবর্তন বৌদ্ধ বিহার দ্বিতীয় ভবনের দ্বারোদ্‌ঘাটন , কর্মবীর করুণাশ্রী থের’র “মহাথের বরণ” ১৯ , ২০ ডিসেম্বর

You cannot copy content of this page

বুদ্ধের জীবনাদর্শে কর্মবীর বোধিমিত্র মহাথেরো

আপডেট সময় ০১:২৮:৫০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২০ মার্চ ২০২৪

বুদ্ধের জীবনাদর্শে কর্মবীর বোধিমিত্র মহাথেরো
(আবির্ভাব- ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দ, প্রয়াণ-১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ)

ধর্ম দিয়ে কর্ম নয়, কর্ম দিয়েই ধর্ম। সাময়িক সময়ের জন্য ধর্ম মনকে পরিবর্তন করে কিন্তু কর্মকে কোনো অবস্থাতে পরিবর্তন করতে পারেনা। কর্মকে পরিবর্তন করতে হলে প্রতিনিয়ত একাগ্রতা, নিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে কাজের পিছনে ছুটতে হবে। সেটি যে কাজই হোক না কেন। যে অতি সামান্য ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র কাজ করে তার জীবনেও কোনো না কোনো সময় পরিবর্তন আসবে। কিন্তু জীবনকে সুন্দর ও পরিশীলিত করার ক্ষেত্রে ধর্মের গুরুত্ব অপরিসীম।

বৌদ্ধদর্শনে কর্ম ও কর্মফল হল বৌদ্ধধর্মের মৌলিক ধারণা। বুদ্ধ কর্মকে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং কর্মের মধ্যে দিয়ে ধর্মকে জানতে ও বুঝতে বলেছেন। কর্মবিহীন ধর্ম হচ্ছে অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতো অবস্থা। কর্ম হচ্ছে একটি প্রাতিস্বিক, মৌলিক, অভিন্ন শব্দ। কর্ম, কর্মই। কর্মের মধ্যে ভিন্নতা থাকতে নেই। কোনটি বড়, কোনটি ছোট এমনকোনো বাঁধাধরা ছকের মধ্যে কর্ম কেন্দ্রীভূত নয়। তবে একথা ঠিক যে, সঠিক সময়ে সঠিক কর্মটি সম্পাদন করতে পারাটা হচ্ছে মানুষের আসল কৃতিত্ব। ধরুন, আপনি কিছুক্ষণ অলস সময় পাড় করছেন এমন সময় যদি কোনো একটি বইয়ের প্রতি মনোযোগি হয়ে পড়েন তৎসময়ে মনে করতে হবে জ্ঞান অর্জনের জন্য এই সময়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বল্প সময়ে বই পড়ে যে জ্ঞানটি অর্জন করেছেন, দেখবেন এই অর্জিত জ্ঞানটি এক সময় আপনার কাজে দেবে। আবার ধরুন ভালো কিছু জানার আশায় সময় ব্যয় করে একটি অনুষ্ঠানে গেলেন, সেখানে গিয়ে বিষয়বস্তু সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জনে ব্যর্থ হলে সময় ও অর্থ দুটোই বৃথা হয়ে যায়। আর কিঞ্চিৎ পরিমানও যদি জ্ঞান অর্জিত হয় সেটিও এক সময় কাজ দেবে। বলতে গেলে জীবনে নানা বিষয়ে অভিজ্ঞতা থাকলে কোনো জায়গায় ঠেকতে হয় না। সুন্দর ভাষায় কথা বলতে পারাটাও একটি বড় অর্জন। যে সঠিক জ্ঞান দিয়ে এই অর্জনটা আয়ত্ব করেছে তার কাছে এটি অনেক বড় সম্পদ। যে সামান্য কয়েক মাসের জন্য দোকানের চাকরি করে সেই কর্মটিও একসময় মূল্যবান হয়ে দেখা দেবে। প্রত্যেক কাজের মধ্যে কোনো না কোনো কিছু শেখার আছে, জানার আছে। আমাদের বুঝতে হবে সব মানুষ দিয়ে সব কাজ হয় না। প্রত্যেকটি কাজের আলাদা আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। কোনো কাজকে খাটো করে দেখার অবকাশ নাই। যে কাজের কোনোরকম তৃপ্তি নেই, সেই কাজ কারো জীবনে ফল বয়ে আনে না। কাজ হচ্ছে হৃদয়ের গভীরে প্রসন্নতা সৃষ্টির এক অপার্থিব ভালবাসার বহুমাত্রিক উপাদান।

আজকে যাকে উদ্দেশ্য করে আমার সহস্রাধিক শব্দের বাক্য বন্দনা নিবেদন করছি, তিনি এই বৌদ্ধ সমাজেরই একজন সৃষ্টিশীল, আবাল্যব্রম্মচারী, কর্মবীর বৌদ্ধ সন্নাসী। তিনি পুরো জীবনটাই উৎসর্গ করে দিয়েছেন মানব মুক্তির জন্য। কাজ করেছেন সমাজ-সদ্ধর্মের উন্নতি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে। তিনি ছিলেন সত্যের পূজারী। কথার মধ্যে কোনোরকম রাখঢাক ছিল না। যা যাকে বলতে চাইতেন সামনা-সামনি বলে দিতেন, পিছনে বলা মানুষগুলো ছিল তাঁর অপছন্দের। কে তার নাম করবে, কিংবা কে বদনাম করবে সেটি নিয়ে তিনি কোনো সময়েই মাথা ঘামাতেন না। তাই এই ধর্মগুরু কারো কাছে যেমন প্রিয় ছিলেন, আবার কারো কাছে তিনি ছিলেন ঘোর অপ্রিয়। পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি সৎ পথের মানুষগুলো অপ্রিয় হওয়ার সংখ্যায় বেশি।

তিনি কাজ করতেন নীরবে নিভৃতে। ৬৫ বছরের জীবনে বৌদ্ধ সমাজ-সংস্কৃতির জন্য অনেক কিছু করে গেছেন। বৌদ্ধ তীর্থস্থান ‘চক্রশালা’ থেকে শুরু করে অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের তিনি কর্ণধার ছিলেন। তাঁর জীবনপঞ্জির দিকে চোখ বুলালে আপনারা ধর্মগুরুর কর্মপরিধি সম্পর্কে অনুধাবন করতে পারবেন। আমি শুধু পরম শ্রদ্ধেয় ধর্মগুরকে বাহ্যিক দিক থেকে যতটুকু অনুধাবন করেছি তার একটি সংক্ষিপ্ত আলোকপাতের অংশ হল আমার লেখার অবতারণা। এইসব গুণী ধর্মগুরুদের ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া না গেলে নবপ্রজন্ম প্রকৃত ইতিহাস থেকে ছিটকে পড়বে। ইতিহাস হচ্ছে আলামত সদৃশ্য। যে কোন পরিস্থিতিতে আমাদেরকে ইতিহাসের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন বুনতে হবে। ইতিহাস আমাদেরকে দিয়ে যায় একটি স্বর্ণালী অতীত। এই অতীত যারা স্মরণে রাখে না, তারা কাঙ্খিত শক্তি ফিরে পায় না। অটুট, মনোবল, শক্তি, সাহসের প্রেরণাদায়ী হচ্ছে ইতিহাস। ইতিহাস থেকে কোনোবস্থাতে বিচ্যুতি ঘটানো যাবে না। এই আবাল্যচারী ধর্মগুরু ইতিহাসের অংশ হিসেবে যুগ-যুগান্তর চিন্তাশীল মানুষের আস্থার ঠিকানায় বসত গড়ে নেবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

তিনি ছিলেন কাজের মানুষ। কর্মবীর। মানুষের মৃত্যু হয়, কর্মবীরের মৃত্যু হয় না। যারা সমাজ সদ্ধর্মে খারাপ কাজ করে তাদের অস্থিত্ব বিলীন হয়ে যায়, ধ্বংস হয়ে যায়। কর্মি বা আদর্শবান মানুষের কখনো মৃত্যু হয় না। তিনি অজ¯্র-অবিনাশী শ্রদ্ধায় মানুষের অন্তরে বিরাজ করবে। নমস্য, স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে থাকবেন ভদন্ত বোধিমিত্র মহাথেরো। আমৃত্যু তিনি শাসন সদ্ধর্মের জন্য, মানুষের জন্য, মানবতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। জন্ম, শৈশব থেকে মুত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত তিনি স্ব-গ্রামে কাটিয়েছেন। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা স্বাভাবিকভাবে বিভিন্ন বিহারে অবস্থান করেন কিন্তু তিনি তা করেননি। ধর্মপ্রচার ও জাগরণের ক্ষেত্র হিসেবে নিজগ্রামকেই বেছে নিয়েছেন, এই দিকটি ছিল তাঁর জীবনের এক অনন্যতা। তিনি বিহার ও গ্রামকে মনেরমতো সাজিয়েছেন, গড়ে তুলেছেন। গ্রামের বহু সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন, গ্রামবাসী তথা সমগ্র বৌদ্ধ সমাজকে ধর্মদানে উজ্জ্বীবিত করেছেন, সমাজ ও দেশের সেবা করেছেন। মানবীয় মূল্যবোধ যার মধ্যে নেই তারা কোনোভাবে এই কাজগুলো করতে পারে না। ভান্তের মধ্যে সে জাতীয় মূল্যবোধ গুলো ছিল বলেই তিনি উদারভাবে কাজ করেছেন, সদ্ধর্মের সেবা করেছেন। বাংলাদেশে অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও গুণ সম্পন্ন বৌদ্ধ ভিক্ষুর কথা যদি বলি তাহলে অনায়সে বলতে হবে পরম পূজনীয় বোধিমিত্র মহাথের’র কথা। যেমন তাঁর ভাষাবোধ, তেমনি তাঁর শব্দ চয়ন, এক দীর্ঘদেহী ও ভরাট কন্ঠের মানুষ। এই গ্রামের অনেকের কাছ থেকে শুনেছি ভান্তের চাহনিতেই অনেকের হৃদয়ে নাকি রীতিমতো কম্পন শুরু হতো। এই দশা আমারো হয়েছিল। প্রথম প্রথম এমন ভয় পেতাম কিছু জানার থাকলেও সহজে জিজ্ঞাসা করতাম না। একদিন বৌদ্ধ সমাজের একটি বড় ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি সংবাদ তৈরী করতে হচ্ছে। প্রতিবেদন লিখতে গিয়ে ভান্তের শরণাপন্ন হয়েছিলাম এবং ভান্তেকে কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সেই থেকে ভয়টা কাটতে শুরু করে। ভান্তে আমাকে অবলীলায় উত্তর দিলেন-। বাহ্যিক দৃষ্টিকোন থেকে তাঁকে যতই ইস্পাতসম কঠিন ভেবেছিলাম তাঁর সাথে কথা না বলাবধি কেউ বুঝতে পারবে না আসলে তাঁর ভিতরের মনটি কত নরম-কোমল। তিনি ২০০২ সালে বাংলাদেশ বৌদ্ধ ভিক্ষু মহাসভার মহাসচিবের দায়িত্ব নিয়েছিল ২০২৩ সালে মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত প্রায় একটানা ২১ বছর সেই দায়িত্বে অটল থেকেছেন। এই একটি মাত্র সাংগঠনিক পদবীই বলে দেয় তিনি কেমন ভিক্ষু ব্যক্তিত্ব ছিলেন। এছাড়া তিনি আরো অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন। ভ্রমণ করেছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।

প্রতিদিন কতো মানুষ মারা যাচ্ছে, কার খবর কে রাখে! বৌদ্ধসহ সর্বজনীন সমাজে এই পর্যন্ত কতো মানুষ মরল কেউ কি হিসেব দিতে পারবেন? না কোনোভাবে সম্ভব নয়। আবার এমন কিছু মানুষ আছেন তাঁরা যেন মরেও অমর। কারণ তাদের ক্ষেত্র হচ্ছে একমাত্র কর্ম। কর্মের মধ্যেই যার যার স্থান নির্ণয় হয়।

তাঁর ভিক্ষু ও শ্রামণ্য জীবনের দুই উপাধ্যায় গুরু ছিলেন বৌদ্ধধর্ম প্রচার ও প্রসারের দুই আলোকিত কর্মবীর, দিকপাল মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের ও সংঘনায়ক এস. ধর্মপাল মহাথের। কী রকম ধীমান ভিক্ষু ছিলেন তাঁদের শিষ্য প্রয়াত ভদন্ত বোধিমিত্র মহাথের এ এক উজ্জ্বল, অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। এ রকম আরো বৌদ্ধ ভিক্ষু ও সমাজ বিদগ্ধ ব্যক্তি ছিলেন, যারা সামগ্রিক বৌদ্ধ সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছিল। তেমনি এই সুন্দর সমাজ-সদ্ধর্ম ও বিহার ছেড়ে ইহলোক পাড়ি জমালেও তিনি কখনো মানুষের অন্তর থেকে বিলীন হবে না। ভান্তে সর্বক্ষেত্রে ধুলিকনার ন্যায় গ্রামের নাড়িনক্ষত্রের সাথে মিশে গেছেন। যা অনেকের বেলায় সম্ভব হয়নি। তাঁর সমবয়সীদের মধ্যে অনেকে আছেন তাঁরা ক’জনে পূজনীয় বোধিমিত্র মহাথের’র মতো গৌরবনীয় ব্যক্তিত্ব হতে পেরেছেন একবার ভাবুন তো ? তিনি পেরেছেন কারণ তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষু। একজন সার্থক, সফল, ত্যাগী বৌদ্ধ ভিক্ষু হতে গেলে তাঁকে অনেক সুখ-আহ্লাদ বর্জন করতে হয়।

তিনি করেছেন বলে আজ মহান হয়েছেন, পূজনীয় হয়েছেন। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা হচ্ছে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের আলোকবর্তিকাসম। তবে দুঃখের বিষয়, আগেকার মতো প্রকৃত ত্রিপিটকশাস্ত্র পণ্ডিত ভিক্ষুর বড় অভাব! অধিকাংশ ভিক্ষু ত্যাগের চেয়ে লাভ সৎকারে ব্যস্ত সময় কাটায়। বর্তমান সময়ে এমন এমন ভিক্ষুর আবির্ভাব হচ্ছে তাদের মধ্যে অধিকাংশ ভিক্ষুর জীবনযাপন, আচরণ ও ভবিষ্যৎ ধর্মচর্চা নিয়ে বৌদ্ধ সমাজের বিদগ্ধজনেরা খুব বেশি সন্দিহান! বৌদ্ধ ভিক্ষু থাকতে হলে একটি বিহারের প্রয়োজন হয়। তাঁদের মধ্যে কোনো রকম লোভ-লালসা থাকতে পারবেনা। কোনো একজন গৃহীও ভিক্ষুর জীবনাচরণের ওপর কোনোরকম বিদ্বেষ বা সন্দেহ পোষণ করলে সাথে সাথে তিনি স্থান ত্যাগ করবেন। এটিই হচ্ছে বুদ্ধের রীতিনীতি। তিনি শুধু ধর্মচর্চা নিয়ে অনাড়ম্বর-অনাসক্ত জীবন উপভোগ করবেন। এখন দেখা যায় তার উল্টো। বৌদ্ধ বিহারকে কেন্দ্র করে ধর্মে, কর্মে, সমাজ-সম্প্রদায় সুসংগঠিত হয়, বিনয়শীল হয়, নমনীয় হয়। ধর্মাপরায়ন হলে পরিবার-সমাজ-দেশ সুন্দর হয়। আমাদেরকে ধার্মিক হওয়ার পাঠ নিতে হবে কিন্তু এ কথা অতীব সত্য যে, আজকাল ধার্মিক হতে গিয়ে ধর্মান্ধ হওয়ার প্রবণতার সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। মনে রাখতে হবে ধার্মিকগণ হচ্ছেন সমাজের বন্ধু আর অপর দিকে ধর্মান্ধরা হচ্ছেন সমাজের শত্রæ। আমরা যদি সত্য কি, মিথ্যা কি বুঝি, আমরা যদি ভালো আর মন্দের মধ্যে তফাৎ বুঝি, তাহলে আমাদেরকে বুঝতে হবে ধার্মিক কারা, আর ধর্মান্ধ কারা। ধর্মান্ধরা বিপথগামী। বর্তমান দেশে দেশে যে হিংসা-বিদ্বেষের মধ্যে দিয়ে বড় বড় অঘটনের জন্ম নিচ্ছে তার একমাত্র প্রধান কারণ হচ্ছে ধর্মান্ধতা! এক শ্রেনীর ধর্মান্ধগোষ্ঠী ধর্মকে এখন বিষাক্ত ওষুধের মতো ব্যবহার করছে। ধর্মগুরুর ছদ্মবেশে ঠকবাজরা অহরহ মিথ্যার পাহাড় গড়ছে। এই হীন চক্রান্ত থেকে যতদিন আমরা বের হতে পারবো না, ততদিন পর্যন্ত আমাদের জীবন প্রণালীতে হিংসার পরিবর্তে অহিংসার মাত্রাটা ক্রমশঃ বাড়তেই থাকবে। তাই সময় এসেছে নিজেকে বদলিয়ে ফেলার। সবার জীবন আনন্দময় হোক।

কর্মবীর ভদন্ত বোধিমিত্র মহাথেরো, গৃহীনাম- সুনীলরঞ্জন বড়ুয়া, জন্মস্থান গ্রাম-পাঁচরিয়া, উপজেলা- পটিয়া, জেলা- চট্টগ্রাম। আবির্ভাব- ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দ, প্রয়াণ-১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ, শ্রামণ্য ধর্মে দীক্ষা- ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দ ( উপাধ্যায় গুরু ২৮তম সংঘনায়ক এস. ধর্মপাল মহাথের), উপসম্পদা গ্রহণ- ১লা জুন ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দ (উপাধ্যায় গুরু- মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের), পিতার নাম- জয়সেন বড়ুয়া, মাতার নাম- অনিতা বড়ুয়া, সর্বোচ্চ শিক্ষা- এম. এ. (পালি)- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিনয়-সূত্র-অভিধর্ম বিশারদ। তিনি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একজন নির্লোভ নিরাহংকার ত্যাগী বৌদ্ধ ধর্মগুরু। তাঁর পুরো জীবনটাই ঝলমলে আলোকোজ্জল বর্ণিল ছটায় পরিপূর্ণ।

তাঁর প্রতি অতল শ্রদ্ধা।

‘সব্বে সত্তা সুখীতা ভবন্তু’ জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।

লেখক: সাংবাদিক-প্রাবন্ধিক।