০৯:৩২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ত্রি-স্মৃতি বিজড়িত বুদ্ধ পূর্ণিমা এবং বৌদ্ধিক আদর্শ

গৌতম বুদ্ধের বোধিসত্ত্ব অধ্যায় শুরু হয় দীপঙ্কর সম্যকসম্বুদের নিকট বুদ্ধত্ব প্রার্থনা করে বর প্রাপ্ত হবার পরই। সে সময় তিনি ‘সুমেধ তাপস’ নামে ত্রিবেদজ্ঞ, পঞ্চাভিজ্ঞাধারী ও অষ্ট সমাপত্তি ধ্যানলাভী তাপস ছিলেন। দীপঙ্কর বুদ্ধ পরবর্তী তেইশজন সম্যকসম্বুদ্ধের সাথে বোধিসত্ত্ব গৌতমের সাক্ষাত হয়। সর্বশেষ বোধিসত্ত্বরূপে তিনি কাশ্যপ সম্যকসম্বুদ্ধের সাক্ষাত লাভ করেন। সে সময় তিনি ত্রিবেদ পারদর্শী ‘জ্যোতিঃপাল’ নামক ব্রাহ্মণ ছিলেন। কাশ্যপ সম্যকসম্বুদ্ধের ধর্মানুশানের পর তিনি কপিলাবস্তুর ধার্মিক রাজা শুদ্ধোধনের উরষে, মহীয়সী-পূণ্যবতী রাণী মহামায়ার গর্ভে সিদ্ধার্থ গৌতম নামে জন্মগ্রহণ করেন। মহাকারুণিক গৌতম বুদ্ধ বিশ্বের সকল প্রাণীর দুঃখ-বেদনাকে নিজের দুঃখ বলে হৃদয়ে উপলব্ধি করেন। তিনি দুঃখ মুক্তির সন্ধানে রাজপ্রাসাদের বিত্তবৈভব, সুখ ও স্বজনের মায়া ত্যাগ তথা সংসার জীবন ত্যাগ করে জন্ম, জরা, ব্যাধি ও মৃত্যু- এ চারটির কারণ উদ্ঘাটনে নিমগ্ন হন। দীর্ঘ ৬ বছর কঠোর সাধনার পর সিদ্ধার্থ গৌতম লক্ষাধিক চারি অসংখ্য কল্প পারমী সম্ভার পূর্ণ করে কাশ্যপ বুদ্ধের পর ভদ্রকল্পের চতুর্থ বুদ্ধ হিসেবে বৈশাখের সেদিনের পূর্ণিমার রাতের স্নিগ্ধ শুভ্র আলোর মতো অন্তর্লোক জ্ঞানালোয় উদ্ভাসিত হয়ে জগতে আবিভূর্ত হন, আর সে আলোয় তিনি স্নাত করালেন জগদ্বাসীকে। অবশেষে বৈশাখের সেদিনের পূর্ণিমার স্নিগ্ধ শুভ্র আলোয় মহাপরিনির্বাণ প্রাপ্ত হন। আজ মহাকারুণিক তথাগত বুদ্ধের মহান জীবনের প্রধান ত্রি-স্মৃতি বিজড়িত শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা।

ত্রি-স্মৃতি কী কী?

এক. রাজনন্দন সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্ম —

খ্রীষ্টপূর্ব ৬২৩ অব্দের এমনই এক শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা দিবসে মায়াদেবী কপিলাবস্তু থেকে পিতার রাজ্যে যাবার পথে অধুনা নেপালের তরাই অঞ্চলের অন্তর্গত লুম্বিনি উদ্যানে সিদ্ধার্থের জন্ম হয়। জন্মের পর রাজকুমার সিদ্ধার্থ উত্তর দিকে সপ্ত পদ্মের উপর সপ্তপদ গমন, অতঃপর তর্জনী উত্তোলন করে ভাষণ করেন-
“অগ্গোহমস্মি লোকস্স, জেট্ঠোহমস্মি লোকস্স, সেট্ঠোহমস্মি লোকস্স, অযং অন্তিম জাতি নত্থিদানি পুনব্ভবো’তি — আমিই জগতে অগ্র, জ্যেষ্ঠ ও শ্রেষ্ঠ। ইহাই আমার শেষ জন্ম; এর পর আর আমার জন্ম হবে না”।

দুই. সিদ্ধার্থ গৌতমের বুদ্ধত্বলাভ —
খ্রীষ্টপূর্ব ৫৮৮ অব্দের এমনই এক শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে রাজনন্দন সিদ্ধার্থ গৌতম অশ্বত্থ বৃক্ষমূলে বুদ্ধত্ব লাভ করে অনাবিল আনন্দে, বিমুক্তি সুখে আবেগ ভরা কন্ঠে যা ভাষণ করেছিলেন, তা-ই বুদ্ধের প্রথম বাণী বলে খ্যাত। সেদিন তিনি ভাষণ করেন-
“অনেক জাতি সংসারং সদ্ধাবিস্সং অনিব্বিসং
গহকারকং গবেসন্তো দুক্খা জাতি পুনপ্পু নং,
গহকারক! দিট্ঠোসি পুন গেহং ন কাহাসি,
সব্বতে ফাসুকা ভগ্গা গহকূটং বিসঙ্খিতং
বিসঙ্খারগতং চিত্তং তণ্হানং খয়মজ্ঝগা।”-এই দেহরূপ গৃহ নির্মাতার সন্ধান করতে গিয়ে তাকে না পেয়ে সংসারে অনেক জন্ম পরিভ্রমণ করেছি। পুনঃপুনঃ জন্ম গ্রহণ দুঃখজনক। হে গৃহ নির্মাতা, এখন আমি তোমার সন্ধান পেয়েছি। তুমি পুনরায় আমার দেহরূপ গৃহ নির্মাণ করতে পারবে না। তোমার সমূদয় পার্শ্বক ভগ্ন এবং গৃহকূট বিচ্ছিন্ন হয়েছে। সংস্কারমুক্ত চিত্ত সমূদয় তৃষ্ণার ক্ষয় সাধন করেছে।

তিন. গৌতম বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ —

খ্রীষ্টপূর্ব ৫৪৩ অব্দের এমনই এক শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে মহাকারুণিক গৌতম বুদ্ধ মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। সেদিন বুদ্ধ পরিনির্বাণ শয্যায় শায়িত অবস্থায় ভিক্ষুসংঘকে যে শেষ উপদেশ দেন, তা-ই বুদ্ধের অন্তিম বাণী। তিনি ভাষণ করেন-
“হন্দদানি ভিক্‌খবে আমন্তযামি বো বযধম্মা সঙ্খারা অপ্পমাদেন সম্পাদেথা’তি — ভিক্ষুগণ, সমপ্রতি তোমাদেরকে সম্বোধন করে বলছি যে, সংস্কার মাত্রই ধ্বংসশীল, অপ্রমাদের সাথে সর্বকার্য সম্পাদন কর”।

 

তথাগত বুদ্ধের জীবনের ত্রি-স্মৃতি বিজড়িত দিনটি সমগ্র বৌদ্ধ বিশ্বে যথাযত ধর্মীয় মর্যাদা এবং ভাব গাম্ভীর্যে উদ্যাপিত হয়। পিছিয়ে নেই আমাদের বাংলাদেশও। দেশের প্রতিটি বিহারে নানা ধর্মময় কর্মসূচীর মধ্যদিয়ে দিনটি উদ্যাপিত হতে যাচ্ছে। এই উদ্যাপনে প্রকাশ করা হচ্ছে বুদ্ধের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা, ভক্তি, কৃতজ্ঞতা। কিন্তু আমরা অনেক সময় এমন কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করি যা প্রকৃতরূপে বৌদ্ধিক আদর্শ, ভাবধারা-গাম্ভীর্য্য এবং বৌদ্ধিক নীতি-আচরণের পরিপন্থি। বিশেষ করে বুদ্ধ পূর্ণিমা তথা বৌদ্ধ পর্ব দিনকে কেন্দ্র করে যেসব সাংস্কৃতিক আয়োজন হয়, সেসবে বেশ কিছু অবৌদ্ধিক ক্রিয়াকলাপ দৃষ্ট হয়। বিগত বছরেও এমন অনেক সাংস্কৃতিক আয়োজন দেখে রীতিমত দুঃখ অনুভব করেছি।বিনয় পিটকানুসারে অপুণ্যকর পাঁচ প্রকার দানের মধ্যে নৃত্য-গীত দান অন্যতম। তবে, বুদ্ধপূজা মানসে নৃত্য-গীত করলে তা ভবিষ্যতে সুখ ফলপ্রদ হয় বলে থেরগাথা’য় সীবলি অপাদানে উল্লেখ রয়েছে। সেক্ষেত্রে, আমরা বুদ্ধ সংকীর্ত্তণের আয়োজন করতে পারি। কিন্তু যে নৃত্য-গীত কাম উদ্দীপক, অভক্তিমূলক, ধর্মীয় ভাবধারা বর্হিভূত তা কোনভাবেই পুণ্যকর হতে পারে না। তাছাড়া বুদ্ধ পূর্ণিমার ন্যায় প্রধান একটি ধর্মীয় উৎসব উদ্যাপনে এ ধরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বৌদ্ধিক আদর্শ বিবর্জিত। তাই এবারের বুদ্ধ পূর্ণিমা এবং ভবিষ্যতের সকল বৌদ্ধ ধর্মীয় পর্ব সমূহের সাথে যেন বৌদ্ধিক আদর্শ বহির্ভূত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যুক্ত করা না হয় সেদিকে আমাদের সজাগ থাকতে হবে।

প্রকৃতপক্ষে, আমাদের উচিত বুদ্ধ পূর্ণিমা এবং বৌদ্ধ ধর্মীয় পর্ব দিন সমূহে দান, শীল, ভাবনা এবং কুশল কর্মের মধ্যদিয়ে অতিবাহিত করা। তবে দান করার ক্ষেত্রে আমরা দেখাদেখি, প্রতিযোগীতা, নিজেকে প্রকাশ করার জন্য হলেও অনেকটা এগিয়ে রয়েছি। কিন্তু শীল পালন ও ভাবনানুশীলনে অগ্রগতি সেরূপে লক্ষ্য করা যায় না। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, “অলোভো দান হেতু। অদেসো সীল হেতু। অমোহো ভাবনা হেতু। — অলোভের হেতু হচ্ছে দান করা, অদ্বেষের হেতু হচ্ছে শীলপালন করা এবং অমোহের হেতু হচ্ছে ভাবনা করা”।

 

দান, শীল, ভাবনা এই তিন কুশল কর্ম সংসারচক্রকে বৃদ্ধি করে না, বরঞ্চ সংকুচিত করে। তাই আমাদের উচিত লোভ, দ্বেষ, মোহের অধীনস্থ না থেকে যথারূপে দান, শীল, ভাবনা অনুশীলনের মধ্যদিয়ে সর্ব দুঃখের অন্ত সাধন পূর্বক পরম শান্তি নির্বাণ লাভের পথে অগ্রসর হওয়া। এবং নির্বাণ লাভ না করা অবধি ত্রিশরণে সদা প্রতিষ্ঠিত থেকে তথাগত গৌতম বুদ্ধের ধর্মানুশাসন অনুসরণ ও মেনে চলার মধ্যদিয়ে অহিংসা, পরোপকার, সৌভাতৃত্ব-সম্প্রীতি, ঐক্যতা ও মৈত্রী-করুণা প্রেমে জীবন অতিবাহিত করা।

আসুন আজিকার শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা তিথিতে বৌদ্ধিক আদর্শে জীবন অতিবাহিত করার পণ গ্রহণ করি এবং উক্ত আদর্শ হতে যেন কখনো চ্যুত হতে না হই সে প্রার্থনা পূর্বক অনন্ত গুণসম্পন্ন বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘ, মাতা-পিতা, আচরিয়গণের প্রতি বন্দনা-পূজা, শ্রদ্ধা, ভক্তি অর্পণ করতঃ দূরের-কাছের সকল জ্ঞাতী, বন্ধু, শত্রু-মিত্র, কল্যাণকামী-অকল্যাণকামী সর্বোপরি সকলের প্রতি শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা তথা ২৫৬৭ বুদ্ধবর্ষের মৈত্রীময় শুভেচ্ছা জানায়।

শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা ২৫৬৭ বুদ্ধবর্ষ।
জয়তু বুদ্ধ সাসনম্।

শেয়ার করুন
আরও সংবাদ দেখুন

ত্রি-স্মৃতি বিজড়িত বুদ্ধ পূর্ণিমা এবং বৌদ্ধিক আদর্শ

আপডেট সময় ০৫:২৫:২৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ মে ২০২৩

গৌতম বুদ্ধের বোধিসত্ত্ব অধ্যায় শুরু হয় দীপঙ্কর সম্যকসম্বুদের নিকট বুদ্ধত্ব প্রার্থনা করে বর প্রাপ্ত হবার পরই। সে সময় তিনি ‘সুমেধ তাপস’ নামে ত্রিবেদজ্ঞ, পঞ্চাভিজ্ঞাধারী ও অষ্ট সমাপত্তি ধ্যানলাভী তাপস ছিলেন। দীপঙ্কর বুদ্ধ পরবর্তী তেইশজন সম্যকসম্বুদ্ধের সাথে বোধিসত্ত্ব গৌতমের সাক্ষাত হয়। সর্বশেষ বোধিসত্ত্বরূপে তিনি কাশ্যপ সম্যকসম্বুদ্ধের সাক্ষাত লাভ করেন। সে সময় তিনি ত্রিবেদ পারদর্শী ‘জ্যোতিঃপাল’ নামক ব্রাহ্মণ ছিলেন। কাশ্যপ সম্যকসম্বুদ্ধের ধর্মানুশানের পর তিনি কপিলাবস্তুর ধার্মিক রাজা শুদ্ধোধনের উরষে, মহীয়সী-পূণ্যবতী রাণী মহামায়ার গর্ভে সিদ্ধার্থ গৌতম নামে জন্মগ্রহণ করেন। মহাকারুণিক গৌতম বুদ্ধ বিশ্বের সকল প্রাণীর দুঃখ-বেদনাকে নিজের দুঃখ বলে হৃদয়ে উপলব্ধি করেন। তিনি দুঃখ মুক্তির সন্ধানে রাজপ্রাসাদের বিত্তবৈভব, সুখ ও স্বজনের মায়া ত্যাগ তথা সংসার জীবন ত্যাগ করে জন্ম, জরা, ব্যাধি ও মৃত্যু- এ চারটির কারণ উদ্ঘাটনে নিমগ্ন হন। দীর্ঘ ৬ বছর কঠোর সাধনার পর সিদ্ধার্থ গৌতম লক্ষাধিক চারি অসংখ্য কল্প পারমী সম্ভার পূর্ণ করে কাশ্যপ বুদ্ধের পর ভদ্রকল্পের চতুর্থ বুদ্ধ হিসেবে বৈশাখের সেদিনের পূর্ণিমার রাতের স্নিগ্ধ শুভ্র আলোর মতো অন্তর্লোক জ্ঞানালোয় উদ্ভাসিত হয়ে জগতে আবিভূর্ত হন, আর সে আলোয় তিনি স্নাত করালেন জগদ্বাসীকে। অবশেষে বৈশাখের সেদিনের পূর্ণিমার স্নিগ্ধ শুভ্র আলোয় মহাপরিনির্বাণ প্রাপ্ত হন। আজ মহাকারুণিক তথাগত বুদ্ধের মহান জীবনের প্রধান ত্রি-স্মৃতি বিজড়িত শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা।

ত্রি-স্মৃতি কী কী?

এক. রাজনন্দন সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্ম —

খ্রীষ্টপূর্ব ৬২৩ অব্দের এমনই এক শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা দিবসে মায়াদেবী কপিলাবস্তু থেকে পিতার রাজ্যে যাবার পথে অধুনা নেপালের তরাই অঞ্চলের অন্তর্গত লুম্বিনি উদ্যানে সিদ্ধার্থের জন্ম হয়। জন্মের পর রাজকুমার সিদ্ধার্থ উত্তর দিকে সপ্ত পদ্মের উপর সপ্তপদ গমন, অতঃপর তর্জনী উত্তোলন করে ভাষণ করেন-
“অগ্গোহমস্মি লোকস্স, জেট্ঠোহমস্মি লোকস্স, সেট্ঠোহমস্মি লোকস্স, অযং অন্তিম জাতি নত্থিদানি পুনব্ভবো’তি — আমিই জগতে অগ্র, জ্যেষ্ঠ ও শ্রেষ্ঠ। ইহাই আমার শেষ জন্ম; এর পর আর আমার জন্ম হবে না”।

দুই. সিদ্ধার্থ গৌতমের বুদ্ধত্বলাভ —
খ্রীষ্টপূর্ব ৫৮৮ অব্দের এমনই এক শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে রাজনন্দন সিদ্ধার্থ গৌতম অশ্বত্থ বৃক্ষমূলে বুদ্ধত্ব লাভ করে অনাবিল আনন্দে, বিমুক্তি সুখে আবেগ ভরা কন্ঠে যা ভাষণ করেছিলেন, তা-ই বুদ্ধের প্রথম বাণী বলে খ্যাত। সেদিন তিনি ভাষণ করেন-
“অনেক জাতি সংসারং সদ্ধাবিস্সং অনিব্বিসং
গহকারকং গবেসন্তো দুক্খা জাতি পুনপ্পু নং,
গহকারক! দিট্ঠোসি পুন গেহং ন কাহাসি,
সব্বতে ফাসুকা ভগ্গা গহকূটং বিসঙ্খিতং
বিসঙ্খারগতং চিত্তং তণ্হানং খয়মজ্ঝগা।”-এই দেহরূপ গৃহ নির্মাতার সন্ধান করতে গিয়ে তাকে না পেয়ে সংসারে অনেক জন্ম পরিভ্রমণ করেছি। পুনঃপুনঃ জন্ম গ্রহণ দুঃখজনক। হে গৃহ নির্মাতা, এখন আমি তোমার সন্ধান পেয়েছি। তুমি পুনরায় আমার দেহরূপ গৃহ নির্মাণ করতে পারবে না। তোমার সমূদয় পার্শ্বক ভগ্ন এবং গৃহকূট বিচ্ছিন্ন হয়েছে। সংস্কারমুক্ত চিত্ত সমূদয় তৃষ্ণার ক্ষয় সাধন করেছে।

তিন. গৌতম বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ —

খ্রীষ্টপূর্ব ৫৪৩ অব্দের এমনই এক শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে মহাকারুণিক গৌতম বুদ্ধ মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। সেদিন বুদ্ধ পরিনির্বাণ শয্যায় শায়িত অবস্থায় ভিক্ষুসংঘকে যে শেষ উপদেশ দেন, তা-ই বুদ্ধের অন্তিম বাণী। তিনি ভাষণ করেন-
“হন্দদানি ভিক্‌খবে আমন্তযামি বো বযধম্মা সঙ্খারা অপ্পমাদেন সম্পাদেথা’তি — ভিক্ষুগণ, সমপ্রতি তোমাদেরকে সম্বোধন করে বলছি যে, সংস্কার মাত্রই ধ্বংসশীল, অপ্রমাদের সাথে সর্বকার্য সম্পাদন কর”।

 

তথাগত বুদ্ধের জীবনের ত্রি-স্মৃতি বিজড়িত দিনটি সমগ্র বৌদ্ধ বিশ্বে যথাযত ধর্মীয় মর্যাদা এবং ভাব গাম্ভীর্যে উদ্যাপিত হয়। পিছিয়ে নেই আমাদের বাংলাদেশও। দেশের প্রতিটি বিহারে নানা ধর্মময় কর্মসূচীর মধ্যদিয়ে দিনটি উদ্যাপিত হতে যাচ্ছে। এই উদ্যাপনে প্রকাশ করা হচ্ছে বুদ্ধের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা, ভক্তি, কৃতজ্ঞতা। কিন্তু আমরা অনেক সময় এমন কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করি যা প্রকৃতরূপে বৌদ্ধিক আদর্শ, ভাবধারা-গাম্ভীর্য্য এবং বৌদ্ধিক নীতি-আচরণের পরিপন্থি। বিশেষ করে বুদ্ধ পূর্ণিমা তথা বৌদ্ধ পর্ব দিনকে কেন্দ্র করে যেসব সাংস্কৃতিক আয়োজন হয়, সেসবে বেশ কিছু অবৌদ্ধিক ক্রিয়াকলাপ দৃষ্ট হয়। বিগত বছরেও এমন অনেক সাংস্কৃতিক আয়োজন দেখে রীতিমত দুঃখ অনুভব করেছি।বিনয় পিটকানুসারে অপুণ্যকর পাঁচ প্রকার দানের মধ্যে নৃত্য-গীত দান অন্যতম। তবে, বুদ্ধপূজা মানসে নৃত্য-গীত করলে তা ভবিষ্যতে সুখ ফলপ্রদ হয় বলে থেরগাথা’য় সীবলি অপাদানে উল্লেখ রয়েছে। সেক্ষেত্রে, আমরা বুদ্ধ সংকীর্ত্তণের আয়োজন করতে পারি। কিন্তু যে নৃত্য-গীত কাম উদ্দীপক, অভক্তিমূলক, ধর্মীয় ভাবধারা বর্হিভূত তা কোনভাবেই পুণ্যকর হতে পারে না। তাছাড়া বুদ্ধ পূর্ণিমার ন্যায় প্রধান একটি ধর্মীয় উৎসব উদ্যাপনে এ ধরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বৌদ্ধিক আদর্শ বিবর্জিত। তাই এবারের বুদ্ধ পূর্ণিমা এবং ভবিষ্যতের সকল বৌদ্ধ ধর্মীয় পর্ব সমূহের সাথে যেন বৌদ্ধিক আদর্শ বহির্ভূত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যুক্ত করা না হয় সেদিকে আমাদের সজাগ থাকতে হবে।

প্রকৃতপক্ষে, আমাদের উচিত বুদ্ধ পূর্ণিমা এবং বৌদ্ধ ধর্মীয় পর্ব দিন সমূহে দান, শীল, ভাবনা এবং কুশল কর্মের মধ্যদিয়ে অতিবাহিত করা। তবে দান করার ক্ষেত্রে আমরা দেখাদেখি, প্রতিযোগীতা, নিজেকে প্রকাশ করার জন্য হলেও অনেকটা এগিয়ে রয়েছি। কিন্তু শীল পালন ও ভাবনানুশীলনে অগ্রগতি সেরূপে লক্ষ্য করা যায় না। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, “অলোভো দান হেতু। অদেসো সীল হেতু। অমোহো ভাবনা হেতু। — অলোভের হেতু হচ্ছে দান করা, অদ্বেষের হেতু হচ্ছে শীলপালন করা এবং অমোহের হেতু হচ্ছে ভাবনা করা”।

 

দান, শীল, ভাবনা এই তিন কুশল কর্ম সংসারচক্রকে বৃদ্ধি করে না, বরঞ্চ সংকুচিত করে। তাই আমাদের উচিত লোভ, দ্বেষ, মোহের অধীনস্থ না থেকে যথারূপে দান, শীল, ভাবনা অনুশীলনের মধ্যদিয়ে সর্ব দুঃখের অন্ত সাধন পূর্বক পরম শান্তি নির্বাণ লাভের পথে অগ্রসর হওয়া। এবং নির্বাণ লাভ না করা অবধি ত্রিশরণে সদা প্রতিষ্ঠিত থেকে তথাগত গৌতম বুদ্ধের ধর্মানুশাসন অনুসরণ ও মেনে চলার মধ্যদিয়ে অহিংসা, পরোপকার, সৌভাতৃত্ব-সম্প্রীতি, ঐক্যতা ও মৈত্রী-করুণা প্রেমে জীবন অতিবাহিত করা।

আসুন আজিকার শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা তিথিতে বৌদ্ধিক আদর্শে জীবন অতিবাহিত করার পণ গ্রহণ করি এবং উক্ত আদর্শ হতে যেন কখনো চ্যুত হতে না হই সে প্রার্থনা পূর্বক অনন্ত গুণসম্পন্ন বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘ, মাতা-পিতা, আচরিয়গণের প্রতি বন্দনা-পূজা, শ্রদ্ধা, ভক্তি অর্পণ করতঃ দূরের-কাছের সকল জ্ঞাতী, বন্ধু, শত্রু-মিত্র, কল্যাণকামী-অকল্যাণকামী সর্বোপরি সকলের প্রতি শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা তথা ২৫৬৭ বুদ্ধবর্ষের মৈত্রীময় শুভেচ্ছা জানায়।

শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা ২৫৬৭ বুদ্ধবর্ষ।
জয়তু বুদ্ধ সাসনম্।