চৈত্র্যের প্রচন্ড রৌদ্র। যেন আগুনের হল্কা পড়ছে। পুড়ছে চারিদিক। বাড়ি থেকে যখন বের হয়েছি সূর্য মামা তখন মধ্য গগণে। শহরে দ্রুত ফিরতে হবে। তাই যেতে হবে তাড়াতাড়ি। বাড়ি থেকে ১কিলোমিটার দূরে। উদ্দেশ্য পটিয়া ঊনাইনপূরা শ্রী শ্রী বুদ্ধপাদ মন্দিরে। এসময়ে ওখানে কেউ থাকে না। মন্দির গেইটে তালা ঝুলানো থাকে। পাশে বাজার আছে, বাজারে উত্তম বড়ুয়া ও সুমন বিকাশ বড়ুয়া নামের দুজনের দুটো ওষুধের দোকান আছে। ওই দুটো দোকানে চাবি থাকে। তাই তেমন কষ্ট পেতে হয় না মন্দিরে প্রবেশে। এ মন্দিরটি বাঙালি বৌদ্ধ সমাজের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যমন্ডিত বৌদ্ধ দর্শনীয় স্থান। আজকাল বৌদ্ধরা যে সব বিহারকে পূণ্যভূমি বলে তকমা দেয় তাঁর তুলনায় হাজারো বেশি পূর্ণ্যময় ভূমি ‘শ্রী শ্রী বুদ্ধপাদ মন্দির ‘। মানে বাংলাদেশে একমাত্র বুদ্ধের পায়ের ছাপ (চিহ্ন) আছে এ মন্দিরে। কি নেই মন্দির। বাঙালি বৌদ্ধ সমাজকে আলোকিত করা এভূমির সুসন্তান, যুগশ্রেষ্ঠ দুই সংঘমনিষার শ্মশানসহ স্মৃতি মন্দির, আরও এক সংঘমনিষার স্মৃতি মন্দির (পরে বিস্তারিত লেখার আশা আছে)। শ্রীলংকার নাগরিক পল সাহেব প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধের অস্থিধাতু মন্দির। আছে বুদ্ধের পরিনির্বাণ মূর্তিসমেত মন্দির ।
সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ঋদ্ধ স্থান হচ্ছে শ্রী শ্রী বুদ্ধপাদ মন্দির। পটিয়ার ঊনাইনপূরা গ্রামে এ পবিত্র মন্দিরটি অবস্থিত। চট্টগ্রাম -কক্সবাজার মহাসড়কের আমজুর হাট থেকে ২ কিলোমিটার পশ্চিমে মৌলভীহাট লাগোয়া এ মন্দিরটির অবস্থান। বলে রাখা ভালো, কালের পরিক্রমায় ঊনাইনপূরা গ্রামের এ অংশটি বরলিয়া ইউনিয়নে এবং বাড়ইকাড়া গ্রামের অংশ বিশেষ। মূল ঊনাইনপূরা গ্রাম জঙ্গলখাইন ইউনিয়নে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় পর্যন্ত দুই ইউনিয়ন ছিলো এক ইউনিয়ন। জঙ্গলখাইন ইউনিয়নের অস্তিত্ব ছিল না। তবে সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠানদি এবং সামাজিকতা ঊনাইনপূরা লঙ্কারাম এবং ঊনাইনপূরা গ্রামের সাথে সম্পৃক্ত। বলা যায় ভারত -বাংলাদেশের ছিটমহলের মতো সমৃদ্ধ মন্দির সংলগ্ন পাড়াটির অবস্থান। বৌদ্ধ পুনঃজাগরণে এ পাড়ার অবদান চিরস্মরণীয়।
বহু শতাব্দী পূর্বে বলা যায়, এ গ্রামের প্রথম সংঘমনিষা
শ্রীমৎ জয়ধরা মহাস্থবির (রাউলি) এর উদ্যোগে এই বুদ্ধ পাদ মন্দিরের ভিটার ভিত্তি স্থাপিত হয় এবং বহু কাল যাবৎ এ স্থানে মাটির দেয়ালের মন্দির ছিল।
কালক্রমে ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে ঊনাইনপূরা গ্রামের সন্তান বাঙালি বৌদ্ধ সমাজ আলোকিত সংঘমনিষা সংঘরাজ আচার্য পূর্ণাচার ধর্মাধার চন্দ্রমোহন মহাস্থবির শ্রীলংকা থেকে বিদ্যাশিক্ষা শেষ করে স্বদেশে ফিরে আসেন। এই মন্দির প্রাঙ্গণে পাকা মন্দির প্রতিষ্ঠাপূর্বক বুদ্ধপাদ চিহ্ন (বুদ্ধের পায়ের ছাপ) স্থাপন করেন। সেই বছর থেকে তাঁর ভাই চন্ডীচরণ বৈদ্যের উদ্যোগে ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে ‘বুদ্ধপাদ মেলা ‘ প্রবর্তন করা হয়। এ মেলাকে আচারিয়ার মেলা বা চন্ডী বৈদ্যের মেলা বলা হয়ে থাকে। পরবর্তীতে আর্য্যশ্রাবক জ্ঞানীশ্বর মহাস্থবির শ্রীলংকা হতে দেশে ফেরার সময় ত্রিপিটকে বর্ণিত বুদ্ধের পদচিহ্নের অনুকরণে রেঙ্গুনের নিকটবর্তী কোমেন্ডাইনের দক্ষ স্থপিত দ্বারা একটি শ্বেত পাথরের খোদাইকৃত বুদ্ধপাদ নিয়ে আসেন। তা ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে পূর্বোক্ত বুদ্ধপাদের স্থানে স্থাপন করা হয়।
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে এই বুদ্ধপাদ চিহ্ন মন্দির প্রাঙ্গণে বুদ্ধের আড়াই হাজার বৎসর জন্মজয়ন্তী উৎসব মহাসমারোহে উদযাপিত হয়।
কালেকালে এ সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের পরিচয় বহনকারী স্থানের সংস্কার ও উন্নয়ন মূলক বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধ জনসাধারণের ভূমিকা অনন্য।
দ্বাদশ সংঘরাজ ড. ধর্মসেন মহাস্থবির মহোদয়ের ঐকান্তিক চেষ্টা এবং সর্বশেষ তাঁর অনুপ্রেরণায় মন্দিরটি অনন্য সুন্দর হয়ে উঠেছে। মন্দির সংলগ্ন পাড়ার বিশিষ্ট সমাজসেবক রাজনীতিবিদ প্রয়াত ডা.নেত্র রঞ্জন বড়ুয়া ও তাঁর সন্তানরা, ধার্মিক উপাসক প্রয়াত মৃনাল কান্তি বড়ুয়া ও তাঁর সন্তানসহ ঊনাইনপূরা গ্রামবাসী তথা পূর্ণার্থীরা এগিয়ে এসে মন্দিরের সৌন্দর্য বর্ধন করেছেন। পূর্ণাচার সমাধি মন্দির ও কৃপাশরণ স্মৃতি মন্দির সুদৃশ্য ভাবে নির্মাণ করেন অখিল ভারতের সংঘনায়ক ড.ধর্মবিরিয়ো মহাথেরো। সেই সময়ে ভান্তের সাথে তদারকি করেন ঊনাইনপূরা সুহৃদ সম্মিলনীর সাবেক সভাপতি তরুণ কান্তি বড়ুয়া ও ভান্তের ছোট ভাই।
এছাড়াও মন্দিরের নানা উন্নয়ন কর্মকান্ডে যুক্ত ছিলেন ডা.বিভূতি ভূষণ বড়ুয়া, বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতির চেয়ারম্যান অজিত রঞ্জন বড়ুয়া, দেশপ্রিয় বড়ুয়া দীলিপ, দীপক বড়ুয়া বাপ্পি মোটরস, নাইখাইন গ্রামের বিশিষ্ট সমাজসেবী পঞ্চানন বড়ুয়া, সাতবাড়িয়া গ্রামনিবাসী অধ্যাপক জিনপ্রিয় বড়ুয়া, ঊনাইনপূরা সুহৃদ সম্মিলনীর সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে নিত্যময় চৌধুরী, মিলিন্দ রাজ বড়ুয়া চৌধুরী, মৃদুল কান্তি বড়ুয়া, তুষিত রঞ্জন বড়ুয়া, দেবমিত্র বড়ুয়াসহ অনেকই। ঊনাইনপূরা গ্রামবাসীসহ পূর্ণার্থীদের আর্থিক সহযোগিতা তথা দানে ঐতিহ্য মন্ডিত পূর্ণ ভূমি আলোকিত হয়ে উঠেছে।