০৫:৪৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ১০ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আজ শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা

বৌদ্ধদের কাছে আষাঢ়ী পূর্ণিমা অত্যন্ত গুরুত্ববহ। এই পূর্ণিমা তিথিতে বুদ্ধের জীবনে কয়েকটি বিরল ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। যেমন : সিদ্ধার্থের প্রতিসন্ধি গ্রহণ, গৃহত্যাগ, প্রথম ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র দেশনা, যমক ঋদ্ধি প্রদর্শন, তাবতিংস স্বর্গে অভিধর্ম দেশনা।

বুদ্ধের জীবনের ঘটনাসমূহের বিবরণ

বাংলা বছরের তৃতীয় মাস আষাঢ়, এই মাসের পূর্ণিমাকে আষাঢ়ী পূর্ণিমা বলা হয়। নেপালের কপিলাবস্তু রাজ্যের রাজা শুদ্ধোধন ও রানী মহামায়া দেবী। রানী মহামায়া দেবীর গর্ভে সিদ্ধার্থ প্রতিসন্ধি গ্রহণ করেছিলেন। আষাঢ়ী পূর্ণিমা রাতে সুখে নিদ্রা যাচ্ছিলেন রানী, দেখতে পেলেন স্বর্গের দেবতারা তাকে পরিচর্যা করতে এসেছেন, সুশীতল জলময় সরোবরে স্নান করলেন, শুভ্র দিব্য বস্ত্র পরিধান করালেন, হিমালয়ের এক সুবর্ণ প্রাসাদে পুষ্পসর্যার শুইয়ে দিলেন। তারপর এক শ্বেত হস্তী এসে অভিবাদন জ্ঞাপনপূর্বক তাকে তিনবার প্রদক্ষিণ করে দক্ষিণপার্শ্ব স্পর্শ করে একটি শ্বেতপদ্ম মাতৃজঠরে প্রবেশ করলেন। রানীর স্বপ্নভঙ্গের পর রাজাকে স্বপ্নবৃত্তান্ত অবহিত করলে জ্যোতিষবিরদের মাধ্যমে জানতে পারলেন রানী পবিত্র সন্তানসম্ভবা। এক মহাগুণ-সমৃদ্ধ সন্তান লাভ করবেন, এ কথা শোনা মাত্রই রাজ্যময় জয়ধ্বনি দিতে শুরু করলেন।

শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে শুভলগ্নে, শুভক্ষণে সিদ্ধার্থ ভূমিষ্ঠ হলেন নেপালের লুম্বিনী উদ্যানে। যথারীতি রাজকীয় সুখে দিনযাপনের মাধ্যমে বড় হতে লাগলেন এবং সব ধরনের বিদ্যাশিক্ষায় পারদর্শিতা অর্জন করলেন। সিদ্ধার্থ যৌবনে পদার্পণে রাজা শুদ্ধোধন ও রানী মহামায়া দেবীর সিদ্ধান্তক্রমে গোপাদেবীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। সংসার জীবনে ক্রমেই তার বৈরাগ্য জীবনের প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলেন, মনের উদাসীনতা কাটাতে নগর ভ্রমণের ইচ্ছা পোষণ করলে রাজার নির্দেশক্রমে রাজকীয়ভাবে নগর ভ্রমণের ব্যবস্থা করলেন। অনাকাক্সিক্ষতভাবে দেখতে পেলেন নগরের চারদিক ভ্রমণে চারটি দৃশ্য, দৃশ্যগুলো যথাক্রমে জরাগ্রস্ত ব্যক্তি, ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তি, মৃত ব্যক্তি ও সন্ন্যাসী। এতে তার মন আরও বেশি বিচলিত হয়ে উঠেছে।

সংবাদ পেলেন গোপাদেবীর সন্তান প্রসব হয়েছে, সন্তানের নাম রাখা হয়েছে ‘রাহুল’। সিদ্ধার্থ মনে মনে ভাবতে লাগলেন রাহুলের জন্ম হয়েছে, সংসার বন্ধন সুদৃঢ় হতে চলেছে, আষাঢ়ী পূর্ণিমা সমাগত, আর দেরি করা যাবে না। স্ত্রী-সন্তানকে এক পলক দেখে ছন্দককে ডেকে সেদিন রাতেই গৃহত্যাগ করলেন।

সন্ন্যাস জীবনে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে বুদ্ধগয়ার বোধিমূলে সর্বজ্ঞতা জ্ঞান অর্জন করে সম্যক সম্বুদ্ধ হওয়ার পর ৭ সপ্তাহ ৭ স্থানে যথাক্রমে বোধিপালঙ্ক, অনিমেষ চৈত্য, চংক্রমণ স্থান, রতনঘর, অজপাল স্থান, মুছলিন্দ স্থান, রাজায়তনে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ অবস্থানের মাধ্যমে নৈর্বাণিক সুখ উপলব্ধিকালে চিন্তা করলেন এই অমৃতময়, গূঢ়তত্ত্বময়, নৈর্বাণিক ধর্মতত্ত্ব, অতিশয় গম্ভীর, দুরানুবোধ্য, পণ্ডিতদের জ্ঞানগম্য, কে বা ধারণ করতে পারবে!

তার চিন্তা জগতে এলেন সন্ন্যাস ব্রতকালে তার গুরু ঋষি আলাড় কালাম, রামপুত্র রুদ্রক, কিন্তু তারাও বেঁচে নেই, তারপর দেখতে পেলেন তার সতীর্থ ৫ জন কৌন্ডিণ্য, বপ্প, ভদ্দিয়, অস্তজিত ও মহানাম। সিদ্ধার্থ গৌতমের সংকল্পের কথা দেবরাজ ইন্দ্রসহ ব্রহ্মাগণ অবগত হলেন। পবিত্র আষাঢ়ী পূর্ণিমা আসন্ন, ব্রহ্মলোক থেকে ‘সহম্পতি’ নামক ব্রহ্মা বুদ্ধের কাছে এসে প্রার্থনা জানালেন তার আবিষ্কৃত ধর্ম জগতে প্রচার করতে (ধর্ম্মচক্র প্রবর্তন সূত্র, ভদন্ত ধর্মতিলক থেরো ও বীরেন্দ্র মুৎসুদ্দি অনূদিত সদ্ধর্ম রতœাকর)।

মহাকারুণিক বুদ্ধ আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে বরাণসী ইষিপতন মৃগদায়ে (সারনাথ) পঞ্চ বর্গীয় ভিক্ষুদের নিকট ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র দেশনা করেছিলেন। এখানে বলা হয়েছে, ভিক্ষুগণ! পঞ্চ উপাদান স্কন্ধ দুঃখ, যথা : জন্ম দুঃখ, জরা দুঃখ, ব্যাধি দুঃখ, মরণ দুঃখ, অপ্রিয় সংযোগ দুঃখ, প্রিয়বিয়োগ দুঃখ ইচ্ছিত বস্তুর অলাভজনিত দুঃখ এগুলোই হচ্ছে দুঃখ আর্য্যসত্য। কাম তৃষ্ণা, ভব তৃষ্ণা ও বিভব তৃষ্ণা ভেদে যেই তৃষ্ণা আছে তা দুঃখ সমুদয় আর্য্যসত্য। যেই

তৃষ্ণার অশেষরূপে বিরাগ, নিরোধ, ত্যাগ তা দুঃখ নিরোধ আর্য্যসত্য। চক্ষু করণী, জ্ঞান করণী, উপশমকর, অভিজ্ঞা সম্বোধি ও নির্বাণ লাভের যোগ্য সেই মধ্যম প্রতিপদা কি প্রকার? এই আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গই মধ্যম প্রতিপদা, যথা : সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক আজীব, সম্যক প্রচেষ্টা, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি। এই প্রকারে ধর্মচক্র দেশনাকালে প্রীতি জ্ঞাপন করে বলেছিলেন, ‘আয়ুষ্মান কৌন্ডিণ্য আঠারো কৌটি ব্রহ্মসহ স্রোতাপত্তি ফলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন, ধর্মচক্ষু লাভ করেছিলেন। তখন থেকেই ত্রিরত্ন গঠিত হয়েছিল যথা : বুদ্ধরত্ন ধর্মরতœ ও সংঘরত্ন।

মগধরাজ বিম্বিসারের অনুরোধে কপিলাবস্তু ও কোলিয়দের মধ্যে রোহিনী নদীর জল নিয়ে চলমান বিবাদ-মীমাংসার জন্য আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে শ্রাবস্তীর জনসম্মুখে বুদ্ধ জমক প্রতিহার্য অর্থাৎ দুই বিপরীতমুখী ঋদ্ধি প্রদর্শন করেছিলেন। বুদ্ধ আপন ঋদ্ধি বলে শূন্যের ওপর একটি মণিময় বিহার বানিয়ে তাতে আরোহণ করে ঋদ্ধি প্রদর্শন করেছিলেন। ঋদ্ধি প্রদর্শনকালে বুদ্ধের ঊর্ধ্বাঙ্গ থেকে অগ্নিশিখা উত্থিত হয়েছিল এবং নিম্নাঙ্গ থেকে বারিধারা বর্ষিত হতে থাকে। আবার ঊর্ধ্বাঙ্গ থেকে বারিধারা ও নিম্নাঙ্গ থেকে অগ্নিশিখা বের হতে থাকে। ডানপাশ ও বামপাশ থেকেও দুই বিপরীতমুখী ঋদ্ধি প্রদর্শন করেছিলেন। এভাবে উপস্থিত জনসম্মুখে বাইশ প্রকার ঋদ্ধি প্রদর্শন করেছিলেন। তখন বুদ্ধের গুণের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা, বিশ্বাস বৃদ্ধি পেতে থাকে। সহজেই বুদ্ধের কথায় উভয়ের বিবাদ-মীমাংসা হয়ে গিয়েছিল, যুদ্ধ বন্ধ হয়েছিল।

পুণ্যপুরুষ সিদ্ধার্থের জন্মের সাত দিন পর মাতা রানী মহামায়ার মৃত্যু হয়েছিল, মৃত্যুর পর তাবতিংস স্বর্গে উৎপন্ন হয়েছিল। সিদ্ধার্থ গৌতম সর্বজ্ঞতা জ্ঞান লাভের পর কৃতজ্ঞতাবশত মাকে ধর্মদান করার জন্য আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে তাবতিংস স্বর্গে গিয়ে তিন মাস অভিধর্ম দেশনা করেছিলেন।

উপাসক-উপাসিকাদের করণীয়

ত্রৈমাসিক বর্ষাবাসকালীন তারা বিহারে গিয়ে কুশলকর্ম সম্পাদন করেন ও উপোসথ শীল গ্রহণ করেন। দশ প্রকার কুশলকর্ম রয়েছে যথা : দান দেয়া, শীল পালন করা, সমথ-বিদর্শন ভাবনা অনুশীলন করা, ধর্মদান, ধর্মশ্রবণ, পুণ্য দান দেওয়া, পুণ্য অনুমোদন করা ইত্যাদি।

এখানে তাদের জন্যও আত্ম সংযমতাই মুখ্য। কায়, বাক্য ও মনে কোনো ধরনের অকুশল কাজ না করা বা অকল্যাণকর কাজ থেকে বিরত থাকা। সপ্তাহে একবার করে অষ্টমী, অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে শ্রদ্ধাশীল, ধার্মিক উপাসক-উপাসিকারা, ছেলে-মেয়ে সবাই পুণ্য চেতনা নিয়ে, পূজার উপকরণ বাতি, আগরবাতি, ফুল, ফল ও ভিক্ষুদের জন্য আহার নিয়ে নিকটস্থ বৌদ্ধ বিহারে যায়। সাধারণত সকালের পর্বে সমবেত বন্দনা, সাধারণের জন্য পঞ্চ শীল, যারা উপোসথ পালন করবেন, তাদের জন্য অষ্টশীল, ও শ্রমণদের জন্য দশশীল গ্রহণ। আবার যেসব উপাসক-উপাসিকা প্রতিনিয়ত ধ্যান করতে অভ্যস্ত, তারা সারা বছরই উপোসথ শীল পালন করে থাকেন। ভিক্ষুদের জন্য প্রতি অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে ‘পাতিমোক্ষ শীল’ আবৃত্তি বাধ্যতামূলক। এভাবেই প্রতিটি বৌদ্ধের জীবনমান উন্নত করার জন্য বুদ্ধ নির্দেশ দিয়েছেন।

লেখক : বৌদ্ধ দর্শনে ডক্টরেট ও ধর্মদূত ডিগ্রিপ্রাপ্ত।

sumanpriyabhikkhu@gmail.com

শেয়ার করুন
আরও সংবাদ দেখুন

চট্টগ্রাম সম্মিলিত বুদ্ধ পূর্ণিমা উদযাপন পরিষদ গঠন

You cannot copy content of this page

আজ শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা

আপডেট সময় ০৪:১০:১৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ অগাস্ট ২০২৩

বৌদ্ধদের কাছে আষাঢ়ী পূর্ণিমা অত্যন্ত গুরুত্ববহ। এই পূর্ণিমা তিথিতে বুদ্ধের জীবনে কয়েকটি বিরল ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। যেমন : সিদ্ধার্থের প্রতিসন্ধি গ্রহণ, গৃহত্যাগ, প্রথম ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র দেশনা, যমক ঋদ্ধি প্রদর্শন, তাবতিংস স্বর্গে অভিধর্ম দেশনা।

বুদ্ধের জীবনের ঘটনাসমূহের বিবরণ

বাংলা বছরের তৃতীয় মাস আষাঢ়, এই মাসের পূর্ণিমাকে আষাঢ়ী পূর্ণিমা বলা হয়। নেপালের কপিলাবস্তু রাজ্যের রাজা শুদ্ধোধন ও রানী মহামায়া দেবী। রানী মহামায়া দেবীর গর্ভে সিদ্ধার্থ প্রতিসন্ধি গ্রহণ করেছিলেন। আষাঢ়ী পূর্ণিমা রাতে সুখে নিদ্রা যাচ্ছিলেন রানী, দেখতে পেলেন স্বর্গের দেবতারা তাকে পরিচর্যা করতে এসেছেন, সুশীতল জলময় সরোবরে স্নান করলেন, শুভ্র দিব্য বস্ত্র পরিধান করালেন, হিমালয়ের এক সুবর্ণ প্রাসাদে পুষ্পসর্যার শুইয়ে দিলেন। তারপর এক শ্বেত হস্তী এসে অভিবাদন জ্ঞাপনপূর্বক তাকে তিনবার প্রদক্ষিণ করে দক্ষিণপার্শ্ব স্পর্শ করে একটি শ্বেতপদ্ম মাতৃজঠরে প্রবেশ করলেন। রানীর স্বপ্নভঙ্গের পর রাজাকে স্বপ্নবৃত্তান্ত অবহিত করলে জ্যোতিষবিরদের মাধ্যমে জানতে পারলেন রানী পবিত্র সন্তানসম্ভবা। এক মহাগুণ-সমৃদ্ধ সন্তান লাভ করবেন, এ কথা শোনা মাত্রই রাজ্যময় জয়ধ্বনি দিতে শুরু করলেন।

শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে শুভলগ্নে, শুভক্ষণে সিদ্ধার্থ ভূমিষ্ঠ হলেন নেপালের লুম্বিনী উদ্যানে। যথারীতি রাজকীয় সুখে দিনযাপনের মাধ্যমে বড় হতে লাগলেন এবং সব ধরনের বিদ্যাশিক্ষায় পারদর্শিতা অর্জন করলেন। সিদ্ধার্থ যৌবনে পদার্পণে রাজা শুদ্ধোধন ও রানী মহামায়া দেবীর সিদ্ধান্তক্রমে গোপাদেবীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। সংসার জীবনে ক্রমেই তার বৈরাগ্য জীবনের প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলেন, মনের উদাসীনতা কাটাতে নগর ভ্রমণের ইচ্ছা পোষণ করলে রাজার নির্দেশক্রমে রাজকীয়ভাবে নগর ভ্রমণের ব্যবস্থা করলেন। অনাকাক্সিক্ষতভাবে দেখতে পেলেন নগরের চারদিক ভ্রমণে চারটি দৃশ্য, দৃশ্যগুলো যথাক্রমে জরাগ্রস্ত ব্যক্তি, ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তি, মৃত ব্যক্তি ও সন্ন্যাসী। এতে তার মন আরও বেশি বিচলিত হয়ে উঠেছে।

সংবাদ পেলেন গোপাদেবীর সন্তান প্রসব হয়েছে, সন্তানের নাম রাখা হয়েছে ‘রাহুল’। সিদ্ধার্থ মনে মনে ভাবতে লাগলেন রাহুলের জন্ম হয়েছে, সংসার বন্ধন সুদৃঢ় হতে চলেছে, আষাঢ়ী পূর্ণিমা সমাগত, আর দেরি করা যাবে না। স্ত্রী-সন্তানকে এক পলক দেখে ছন্দককে ডেকে সেদিন রাতেই গৃহত্যাগ করলেন।

সন্ন্যাস জীবনে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে বুদ্ধগয়ার বোধিমূলে সর্বজ্ঞতা জ্ঞান অর্জন করে সম্যক সম্বুদ্ধ হওয়ার পর ৭ সপ্তাহ ৭ স্থানে যথাক্রমে বোধিপালঙ্ক, অনিমেষ চৈত্য, চংক্রমণ স্থান, রতনঘর, অজপাল স্থান, মুছলিন্দ স্থান, রাজায়তনে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ অবস্থানের মাধ্যমে নৈর্বাণিক সুখ উপলব্ধিকালে চিন্তা করলেন এই অমৃতময়, গূঢ়তত্ত্বময়, নৈর্বাণিক ধর্মতত্ত্ব, অতিশয় গম্ভীর, দুরানুবোধ্য, পণ্ডিতদের জ্ঞানগম্য, কে বা ধারণ করতে পারবে!

তার চিন্তা জগতে এলেন সন্ন্যাস ব্রতকালে তার গুরু ঋষি আলাড় কালাম, রামপুত্র রুদ্রক, কিন্তু তারাও বেঁচে নেই, তারপর দেখতে পেলেন তার সতীর্থ ৫ জন কৌন্ডিণ্য, বপ্প, ভদ্দিয়, অস্তজিত ও মহানাম। সিদ্ধার্থ গৌতমের সংকল্পের কথা দেবরাজ ইন্দ্রসহ ব্রহ্মাগণ অবগত হলেন। পবিত্র আষাঢ়ী পূর্ণিমা আসন্ন, ব্রহ্মলোক থেকে ‘সহম্পতি’ নামক ব্রহ্মা বুদ্ধের কাছে এসে প্রার্থনা জানালেন তার আবিষ্কৃত ধর্ম জগতে প্রচার করতে (ধর্ম্মচক্র প্রবর্তন সূত্র, ভদন্ত ধর্মতিলক থেরো ও বীরেন্দ্র মুৎসুদ্দি অনূদিত সদ্ধর্ম রতœাকর)।

মহাকারুণিক বুদ্ধ আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে বরাণসী ইষিপতন মৃগদায়ে (সারনাথ) পঞ্চ বর্গীয় ভিক্ষুদের নিকট ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র দেশনা করেছিলেন। এখানে বলা হয়েছে, ভিক্ষুগণ! পঞ্চ উপাদান স্কন্ধ দুঃখ, যথা : জন্ম দুঃখ, জরা দুঃখ, ব্যাধি দুঃখ, মরণ দুঃখ, অপ্রিয় সংযোগ দুঃখ, প্রিয়বিয়োগ দুঃখ ইচ্ছিত বস্তুর অলাভজনিত দুঃখ এগুলোই হচ্ছে দুঃখ আর্য্যসত্য। কাম তৃষ্ণা, ভব তৃষ্ণা ও বিভব তৃষ্ণা ভেদে যেই তৃষ্ণা আছে তা দুঃখ সমুদয় আর্য্যসত্য। যেই

তৃষ্ণার অশেষরূপে বিরাগ, নিরোধ, ত্যাগ তা দুঃখ নিরোধ আর্য্যসত্য। চক্ষু করণী, জ্ঞান করণী, উপশমকর, অভিজ্ঞা সম্বোধি ও নির্বাণ লাভের যোগ্য সেই মধ্যম প্রতিপদা কি প্রকার? এই আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গই মধ্যম প্রতিপদা, যথা : সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক আজীব, সম্যক প্রচেষ্টা, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি। এই প্রকারে ধর্মচক্র দেশনাকালে প্রীতি জ্ঞাপন করে বলেছিলেন, ‘আয়ুষ্মান কৌন্ডিণ্য আঠারো কৌটি ব্রহ্মসহ স্রোতাপত্তি ফলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন, ধর্মচক্ষু লাভ করেছিলেন। তখন থেকেই ত্রিরত্ন গঠিত হয়েছিল যথা : বুদ্ধরত্ন ধর্মরতœ ও সংঘরত্ন।

মগধরাজ বিম্বিসারের অনুরোধে কপিলাবস্তু ও কোলিয়দের মধ্যে রোহিনী নদীর জল নিয়ে চলমান বিবাদ-মীমাংসার জন্য আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে শ্রাবস্তীর জনসম্মুখে বুদ্ধ জমক প্রতিহার্য অর্থাৎ দুই বিপরীতমুখী ঋদ্ধি প্রদর্শন করেছিলেন। বুদ্ধ আপন ঋদ্ধি বলে শূন্যের ওপর একটি মণিময় বিহার বানিয়ে তাতে আরোহণ করে ঋদ্ধি প্রদর্শন করেছিলেন। ঋদ্ধি প্রদর্শনকালে বুদ্ধের ঊর্ধ্বাঙ্গ থেকে অগ্নিশিখা উত্থিত হয়েছিল এবং নিম্নাঙ্গ থেকে বারিধারা বর্ষিত হতে থাকে। আবার ঊর্ধ্বাঙ্গ থেকে বারিধারা ও নিম্নাঙ্গ থেকে অগ্নিশিখা বের হতে থাকে। ডানপাশ ও বামপাশ থেকেও দুই বিপরীতমুখী ঋদ্ধি প্রদর্শন করেছিলেন। এভাবে উপস্থিত জনসম্মুখে বাইশ প্রকার ঋদ্ধি প্রদর্শন করেছিলেন। তখন বুদ্ধের গুণের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা, বিশ্বাস বৃদ্ধি পেতে থাকে। সহজেই বুদ্ধের কথায় উভয়ের বিবাদ-মীমাংসা হয়ে গিয়েছিল, যুদ্ধ বন্ধ হয়েছিল।

পুণ্যপুরুষ সিদ্ধার্থের জন্মের সাত দিন পর মাতা রানী মহামায়ার মৃত্যু হয়েছিল, মৃত্যুর পর তাবতিংস স্বর্গে উৎপন্ন হয়েছিল। সিদ্ধার্থ গৌতম সর্বজ্ঞতা জ্ঞান লাভের পর কৃতজ্ঞতাবশত মাকে ধর্মদান করার জন্য আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে তাবতিংস স্বর্গে গিয়ে তিন মাস অভিধর্ম দেশনা করেছিলেন।

উপাসক-উপাসিকাদের করণীয়

ত্রৈমাসিক বর্ষাবাসকালীন তারা বিহারে গিয়ে কুশলকর্ম সম্পাদন করেন ও উপোসথ শীল গ্রহণ করেন। দশ প্রকার কুশলকর্ম রয়েছে যথা : দান দেয়া, শীল পালন করা, সমথ-বিদর্শন ভাবনা অনুশীলন করা, ধর্মদান, ধর্মশ্রবণ, পুণ্য দান দেওয়া, পুণ্য অনুমোদন করা ইত্যাদি।

এখানে তাদের জন্যও আত্ম সংযমতাই মুখ্য। কায়, বাক্য ও মনে কোনো ধরনের অকুশল কাজ না করা বা অকল্যাণকর কাজ থেকে বিরত থাকা। সপ্তাহে একবার করে অষ্টমী, অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে শ্রদ্ধাশীল, ধার্মিক উপাসক-উপাসিকারা, ছেলে-মেয়ে সবাই পুণ্য চেতনা নিয়ে, পূজার উপকরণ বাতি, আগরবাতি, ফুল, ফল ও ভিক্ষুদের জন্য আহার নিয়ে নিকটস্থ বৌদ্ধ বিহারে যায়। সাধারণত সকালের পর্বে সমবেত বন্দনা, সাধারণের জন্য পঞ্চ শীল, যারা উপোসথ পালন করবেন, তাদের জন্য অষ্টশীল, ও শ্রমণদের জন্য দশশীল গ্রহণ। আবার যেসব উপাসক-উপাসিকা প্রতিনিয়ত ধ্যান করতে অভ্যস্ত, তারা সারা বছরই উপোসথ শীল পালন করে থাকেন। ভিক্ষুদের জন্য প্রতি অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে ‘পাতিমোক্ষ শীল’ আবৃত্তি বাধ্যতামূলক। এভাবেই প্রতিটি বৌদ্ধের জীবনমান উন্নত করার জন্য বুদ্ধ নির্দেশ দিয়েছেন।

লেখক : বৌদ্ধ দর্শনে ডক্টরেট ও ধর্মদূত ডিগ্রিপ্রাপ্ত।

sumanpriyabhikkhu@gmail.com