আগামীকাল শুভ শ্রাবণী পূর্ণিমা তিথি।ত্রৈমাসিক বর্ষাবাসের ৫ম গৃহী উপোসথ, ২৫৬৭ বুদ্ধবর্ষ,৩০ আগস্ট , বুধবার ২০২৩ ইং।
আগামীকাল শুভ শ্রাবণী পূর্ণিমা। প্রথম বৌদ্ধ সঙ্ঘায়ন বা সংগীতি ও আনন্দ স্থবিরের অর্হত্ব লাভের পূণ্যময় বার্তায় শ্রাবণী পূর্ণিমা তিথি সমগ্র বৌদ্ধ বিশ্বের কাছে অন্যতম ধর্মীয় উৎসব । পবিত্র এ পূণ্য দিবসটি ধর্মীয় ভাব গাম্ভীর্য্যে, দান, উপোসথ শীল গ্রহণ, ভাবনানুশীলন, ধর্মশ্রবণ ইত্যাদি কুশল কর্ম সম্পাদনের মধ্যদিয়ে উদ্যাপিত হয়।
এবার আমরা এ পূণ্য তিথির বিশেষত্ব সম্পর্কে আলোচনা করব। সূত্র, বিনয়, অভিধর্ম এ তিন পিটকের সমন্বয়ে যে ত্রিপিটক বৌদ্ধধর্মের প্রধান গ্রন্থ, সে ত্রিপিটক সংকলনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। বুদ্ধের সুদীর্ঘ ৪৫ বছর ভাষিত ধর্মোপদেশ সমূহ পুস্তকাকারে লিপিবদ্ধ ছিলনা। সংগীতি আয়োজনের মধ্যদিয়ে তা লিপিবদ্ধ করা হয়। এভাবে এক এক করে ছয়টি সংগীতি আয়োজিত হয়।
সংগীতি (সম+গীত) অর্থ হল ধর্মসভা, সমাবেশ, সম্মেলন, সঙ্ঘায়ন, অধিবেশন ইত্যাদি। বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের তিন মাস পর অর্থাৎ চতুর্থ মাসে প্রথম সংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। এ সংগীতি আয়োজনের প্রধান কারণ ছিল, সুভদ্র নামক বৃদ্ধ প্রব্রজিত ভিক্ষুর বিনয় বর্হিভূত উক্তি। তিনি বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর ভিক্ষুসংঘের উদ্দেশ্য করে বলেন-হে ভিক্ষুগণ,
তোমরা শোক করিও না!
বিলাপ করিও না।
আমরা এখন মুক্ত। বুদ্ধের কঠোর ধর্ম অনুশাসন এখন আর আমাদের রক্ষা করতে হবে না। আমরা নিজেদের মত নিজেরাই চলতে পারবো। বুদ্ধের পরিনির্বাণে আমরা স্বাধীন।
ভিক্ষু সুভদ্রের মুখে এমন উক্তি শুনে বুদ্ধের প্রধান শিষ্য ও বিনয়শীল ভিক্ষুদের মাথায় যেন বাজ পরল! তাঁরা মহাকাশ্যপ স্থবিরের নিকট এ বিষয় উত্থাপন করেন। অতঃপর অর্হৎ মহাকাশ্যপ স্থবির রাজা বিম্বিসারের পুত্র মগধরাজ অজাতাশত্রুর পৃষ্ঠপোষকতায় রাজগৃহের বেভার পর্বতের সপ্তপর্ণী গুহায় পঞ্চশত অর্হৎ ভিক্ষুদের নিয়ে সংগীতির আয়োজন করেন।
এবার আসা যাক্ আনন্দ স্থবিরের অর্হত্ব লাভ প্রসঙ্গে। সংগীতির আয়োজন সম্পন্ন, কিন্তু আনন্দ স্থবির তখনো পর্যন্ত অর্হত্ব লাভ করেননি। উক্ত সংগীতিতে প্রবেশাধিকার রয়েছে শুধুমাত্র অর্হৎ ভিক্ষুরই, তদুপরি আনন্দ স্থবিরকে ব্যতীত সংগীতি আয়োজনও পূর্ণাঙ্গতা পাবে না। কারণ, তিনিই সুদীর্ঘ ২৫ বৎসর কাল অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় ঐকান্তিক শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠার সাথে বুদ্ধের সেবা করেছিলেন। তাঁর অবর্তমানে বুদ্ধ যেখানে গেছেন, যেসব ধর্ম দেশনা করেছেন; সেখান থেকে এসে সেসব ধর্মদেশনা পুনরায় আনন্দ স্থবিরের নিকট দেশনা করেছেন। সুতরাং, অর্হৎ মহাকাশ্যপ স্থবির সর্বসম্মতিক্রমে আনন্দ স্থবিরের জন্যও একটি আসন বরাদ্দ রাখেন।
এদিকে ভিক্ষুরা তাঁকে সংগীতিতে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। পরদিনই সংগীতির আয়োজন। আনন্দ স্থবির চিন্তা করলেন আমি এখনও তো অর্হৎ নই, আমার পক্ষে সংগীতিতে উপস্থিত হয়ে ধর্ম সঙ্ঘায়ন করা কি উচিত হবে? কখনো সংগীতিতে উপস্থিত হবেন ভেবেছেন, কখনো ভেবেছেন হবেন না! এভাবে নানা চিন্তা-ভাবনার পর তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলেন আমাকে যেকোনভাবেই অর্হত্ব মার্গফল লাভ করতেই হবে। সংগীতি আরম্ভের পূর্বরাতে তিনি কর্মস্থান ভাবনায় রত হলেন। নির্ঘুমে দীর্ঘরাত্রি পর্যন্ত চংক্রমণে বিদর্শন ভাবনা করতে করতে শেষ যামে শান্ত-ক্লান্ত দেহে একটু বিশ্রামের জন্য শষ্যাগ্রহণ করার ইচ্ছা পোষণ করলেন। যখন পাদদ্বয় ভূমি হতে তুলে মঞ্চোপরি উপাধানে মস্তক স্থাপন করে শয়ন করবেন এমন সময় হঠাৎ তাঁর অন্তর আকাশ দিব্যালোকে উদ্ভাসিত হয়ে গেল। তিনি বহু আকাঙ্খিত সাধনার উচ্চতর মার্গ অর্হত্ব ফলে প্রতিষ্ঠিত হলেন (সাধু সাধু সাধু)।
সংগীতি শুরু হল। সম্মেলন মণ্ডপে বুদ্ধের দেশিত ধর্ম-বিনয়ে সুদক্ষ ৪৯৯ জন অর্হৎ ভিক্ষু উপস্থিত। আনন্দ স্থবিরের আসনই শুধুমাত্র শূন্য। সংগীতির কার্যক্রম সূচনার পূর্ব মুহুর্তেই আনন্দ স্থবির ঋদ্ধিবলে আসন অলঙ্কিত করলেন। উপস্থিত অরহত ভিক্ষুদের মধ্যে সাধু সাধু সাধু ধ্বনি উচ্চারিত হতে লাগল। এরপর ধুতাঙ্গ শ্রেষ্ঠ অর্হৎ মহাকাশ্যপ স্থবিরের সভাপতিত্বে সংগীতির কার্যক্রম শুরু হল। তিনি সমবেত ভিক্ষুসংঘের সম্মতিক্রমে বিনয়ধর উপালি স্থবিরকে প্রথমে বিনয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। তারপর তিনি ধর্মভাণ্ডারিক খ্যাত আনন্দ স্থবিরকে ধর্ম সম্পর্কে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন। আনন্দ স্থবির সুনিপুণ কন্ঠে যথাযথভাবে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর প্রদান করলেন। তিনি সূত্রাদি ও অভিধর্ম বর্ণনা করেন। এভাবে দীর্ঘ সাতমাস সঙ্ঘায়নের মধ্যদিয়ে প্রথম সংগীতিতে ধর্ম ও বিনয় ত্রিপিটকারে (বিনয়, সূত্র, অভিধর্ম) সুশৃ্ঙ্খলাবদ্ধ করা হয়।